বিদেশে পাঠ্য দিলরুবার উপন্যাস
- লিডারশিপ ডেস্ক
‘লেখা আমার রক্তে, লিখতে না পারলে অসুস্থ হয়ে পড়ি।’ বাংলা একাডেমির এনামুল হক ভবনের দোতলায় বসে কথাগুলো যখন বলছিলেন তিনি, তাঁর চোখ তখন চকচক করছে উচ্ছ্বাসে। তিনি বাংলাদেশের মেয়ে। দীর্ঘদিন ধরে সুইডেনের বাসিন্দা। লেখেন ইংরেজি ভাষায়, তাঁর লেখা বই পড়ানো হয় যুক্তরাষ্ট্র-সুইডেনসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। মজার ব্যাপার হলো, তাঁর বই বেরিয়েছে বাংলাদেশ থেকে। ভাবছেন কে এই লেখক? আপনার চেনা কেউ কি?
দিলরুবা জেড আরা। বাংলাদেশের ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড (ইউপিএল) থেকে ব্লেম (২০০৫) ও লিস্ট অব অফেনসিস (২০০৬) নামে দুটি উপন্যাস বেরিয়েছে তাঁর। সদ্য সমাপ্ত ‘ঢাকা লিট ফেস্টিভ্যাল’-এ এসেছিলেন তিনি। ওই উৎসবের শেষ দিন ১৯ নভেম্বর এনামুল হক ভবনে বসে নানা কথাবার্তায় যে মুহূর্তে তিনি উন্মোচন করলেন তাঁর লেখালেখির খেরোখাতা, আমরা যেন দেখতে পাচ্ছিলাম তাঁর লেখকজীবনের স্থিরচিত্র।
ওই যে ঢাকার আজিমপুরে বেড়ে উঠছেন তিনি, তাঁদের বাসায় নিয়মিত বসছে সাহিত্য আসর। এখনকার দিলরুবা জেড আরা সেদিন, গত শতকের সেই ষাটের দশকে বাবা-মায়ের কাছে ছিলেন শুধুই ‘রুবা’। তো, খুব ছোট থেকেই রুবা দেখছেন তাঁদের বাসায় আসছেন কবি শামসুর রাহমান, সন্জীদা খাতুন, আহমদ ছফা—আরও কত কত নাম! ইংরেজি বই থেকে তাঁর বাবা তাঁকে পড়ে শোনাচ্ছেন বিভিন্ন পুরাণ কাহিনি। সেই সময় থেকেই তাঁর লেখালেখির শুরু।
বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক শাহেদ আলী ও চেমন আরার মেয়ে দিলরুবা জেড আরা লেখক হয়ে উঠেছেন দিনে দিনে। প্রথম দিকে লিখতেন বাংলায়, পরে থিতু হয়েছেন ইংরেজিতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করার পর বৈবাহিকসূত্রে তিনি পাড়ি জমালেন সুইডেনে। এরপর ঘরকন্যা সামলাতে লেখালেখিতে কিছুটা ছেদ। পরে লিখলেন ব্লেম নামের উপন্যাস। বাংলাদেশের ষাট দশকের প্রেক্ষাপটে ছয়টি তরুণ-তরুণীর কাহিনি নিয়ে গড়ে ওঠা এই আখ্যানটি প্রথমে অবশ্য তিনি লিখেছিলেন সুইডিশ ভাষায়। পরবর্তী সময়ে সেটি আবার লিখেছেন ইংরেজিতে।
উপন্যাস তো লেখা হলো, কিন্তু প্রকাশক পাওয়া যাবে কোথায়? যুক্তরাষ্ট্রের এক প্রকাশক বইটি প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন বটে কিন্তু সঙ্গে জুড়ে দিলেন বেশ কয়েকটি শর্ত। তবে শর্ত মানতে নারাজ দিলরুবা, ‘ওরা যখন শর্ত দিল, শর্ত আমি মানতে চাইনি, তবে থেমেও থাকিনি।’
অতঃপর বাংলাদেশের ইউপিএল বইটি প্রকাশ করল। প্রকাশের পরপর ওই উপন্যাসটি পাঠ্য হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটিতে। লাতিন আমেরিকার ইকুয়েডর ইউনিভার্সিটিতেও পাঠ্য ছিল উপন্যাসটি।
২০০৬-এ ইউপিএল বের করল দিলরুবার দ্বিতীয় উপাখ্যান লিস্ট অব অফেনসিস। এ বইও পড়ানো হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটিতে। বর্তমানে সুইডেনে ‘পোস্ট কলোনিয়াল সাহিত্য’-এর আওতায় পাঠ্য এই উপাখ্যান। বাংলাদেশের গ্রামীণ পটভূমিতে লেখা এই উপন্যাসে উঠে এসেছে সমাজ জীবন এবং আমাদের সংস্কৃতি।
‘বাংলাদেশ আমার বুকের ভেতরে’—দিলরুবা বললেন কথাটি, এরপর খানিকটা দম নিলেন। তারপর একনিশ্বাসে বলে চললেন, ‘যেখানে যে অবস্থায় থাকি, বাংলাদেশের মানুষজন আমার হৃদয়ে সব সময় কলরব করে।’
দিলরুবার গল্প শুনছি। আর দেখতে পাচ্ছি এক অদম্য নারীর মুখ, লেখালেখির মাধ্যমে তিনি এর মধ্যেই বাংলাদেশকে ছড়িয়ে দিচ্ছেন পৃথিবীর জানালায়।