ঘরে বাইরে সফল সঙ্গীতা
- লিডারশিপ ডেস্ক
যে সময় মেয়েদের ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত হওয়াটা অনেকটা দুরূহ ব্যাপার, সেই সময় স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে মেধা ও প্রচেষ্টায় নিজেকে গড়ে তুলেছেন একজন সফল নারী উদ্যোক্তা হিসেবে। তিনি হচ্ছেন সঙ্গীতা আহমেদ। তিনি স্কাইরুম ডাইনিং লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। এ ছাড়া দীর্ঘদিন ধরে নারী আন্দোলনের সাথেও যুক্ত আছেন। তার বহুমুখী প্রতিভার কারণেই উঠে এসেছেন এই প্রজন্মের আগ্রহের তালিকায়।
একজন ব্যবসায়ী হিসেবে সঙ্গীতা আহমেদের শুরুটা হয়েছিল ১৯৮৭ সালে। মায়ের সাথে গুলশান ১-এ তখন একটি বুটিক হাউস চালু করেন তিনি। সেসময় বুটিক হাউসের খুব একটা চল ছিল না। কিন্তু মা-মেয়ে অল্প ক’দিনেই এই ব্যবসায় সাফল্যের মুখ দেখেন। এরপর ১৯৯৮ সালে সঙ্গীতা আহমেদ স্বামীর সাথে এভিগ্রাফ নামে একটি মিডিয়া প্রোডাকশন হাউস শুরু করেন। সেসময় একুশে টেলিভিশনে প্রচারিত এই প্রোডাকশন হাউসের তৈরি ‘বলতে চাই’, ‘সরাসরি’-এ দুটি অনুষ্ঠান ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। একই বছর বিটিভিতে এবং বাংলাদেশ বেতারে সঙ্গীতা আহমেদ ইংরেজি সংবাদপাঠিকা হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। ২০০০ সালে টাইম আউট নামে গুলশানে একটি রেস্টুরেন্ট দেন তিনি। গ্রাহক চাহিদার কারণে এর দ্বিতীয় শাখাটি ২০০৪ সালে খোলা হয়। বর্তমানে স্কাইরুম নামে আরও একটি রেস্টুরেন্ট তিনি পরিচালনা করছেন। এরই মাঝে ২০০১ সালে তিনি যোগ দেন বাংলাদেশ উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (বিডব্লিউসিসিআই)-তে। তিনি গত ১৩ বছর ধরে বিডব্লিউসিসিআই-এর সাথে জড়িত আছেন। এটা মহিলা ব্যবসায়ীদের একটা ট্রেড বডি। প্রথমে সাধারণ সদস্য, পরে পরিচালনা পর্ষদ সদস্য এবং বর্তমানে এর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন সঙ্গীতা আহমেদ।
ছোটবেলা থেকেই সঙ্গীতা আহমেদের মধ্যে ব্যবসার প্রতি আগ্রহ ছিল, চাকরি করার ইচ্ছা তার কখনোই ছিল না। এজন্যই মাকে সাথে নিয়ে প্রথম ব্যবসা শুরু করেন। এরপর তিনি পড়াশোনার জন্য দেশের বাইরে চলে যান। পড়াশোনা শেষ করে সঙ্গীতা আহমেদ ১৯৯৮ সালে দেশে এসে মিডিয়াতে যোগ দেন। বর্তমানে বাংলাদেশ ওমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির মাধ্যমে ব্যবসায়ী মহিলাদেরকে ব্যবসার ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম সহায়তা দিয়ে যাচ্ছেন। নিজেকে একজন ব্যবসায়ী হিসেবে গড়ে তোলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি যে ব্যবসাই করেছি একটু ছোট আকারে করেছি, তবে সফল হয়েছি। আমি বিশ্বাস করি ব্যবসায় প্রথমত সততা। দ্বিতীয়ত একটি সঠিক পরিকল্পনা থাকতে হবে। এ ছাড়া বাজার ও গবেষণায় সময় দিতে হবে তবেই ব্যবসাতে সফল হওয়া যাবে বলে আমি মনে করি। আর নারীদের অবশ্যই আত্মবিশ্বাস থাকতে হবে। সমাজ বা পরিবার থেকে বাধা আসবে বলে ভয় পেয়ে পিছু হটে গেলে ব্যবসায় সাফল্য পাওয়া যাবে না।’
সঙ্গীতা আহমেদ জানালেন, মূলত বিডব্লিউসিসিআই বাংলাদেশের নারী উদ্যোক্তাদের জন্য একটি বিশাল প্লাটফর্ম। নারী উদ্যোক্তাদের উন্নয়নের জন্য ব্যবসা সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির উপর এই প্রতিষ্ঠানটি জোর দিয়ে থাকে। বর্তমানে দেশের ৬৪টি জেলাতেই নারী উদ্যোক্তা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচি পরিচালনা করছে প্রতিষ্ঠানটি। পাশাপাশি নারী উদ্যোক্তাদের ব্যবসা সম্পর্কিত তথ্য সহায়তা, উত্পাদিত পণ্যের বাজারজাতকরণ সহায়তা, ঋণ প্রাপ্তি সহায়তা এবং স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সাথে নেটওয়ার্ক তৈরির ব্যাপারেও কাজ করছে। সঙ্গীতা আহমেদের মতে, আমাদের দেশে নারীবান্ধব ব্যবসা নীতিমালা ও ব্যবসায়িক পরিসরের ঘাটতি রয়েছে। তাই সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে ও বিভিন্ন অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সাথে তারা ব্যাপক পলিসি অ্যাডভোকেসি করছেন, যেন আমাদের দেশে নারী উদ্যোক্তাদের ব্যবসা পরিচালনার জন্য সহায়ক একটি পরিবেশ তৈরি হয়। বিডব্লিউসিসিআই সম্পর্কে সঙ্গীতা আহমেদ বলেন, ‘২০০১ সালে যখন এটা শুরু হয় তখন আমরা ১৪ জন সদস্য ছিলাম এবং এটাই বাংলাদেশের নারীদের একমাত্র চেম্বার অব কমার্স। বর্তমানে আমাদের আড়াই থেকে তিন হাজার সদস্য রয়েছেন। এখানে আমরা নারীদের ব্যবসা ক্ষেত্রে যত রকম সমস্যা হয় বা যেসব বাঁধার সম্মুখীন হতে হয়, প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের সেগুলোর সমাধান দিয়ে থাকি।’
নিজের স্বাচ্ছন্দ্যবোধের কথা বলতে গিয়ে সঙ্গীতা আহমেদ বলেন, ‘নিজের কাজে ষোলআনা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। কারণ আমি মনে করি, নারী উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করার সবচেয়ে ইতিবাচক দিক হলো এখানে নিজের মতো করে সময় গুছিয়ে কাজ করা সম্ভব। তাই নিজের ব্যবসা সফলভাবে চালানোর পাশাপাশি পরিবারকেও সময় দেওয়া যায়।’ একটি দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে নারীদের অংশগ্রহণ কতটা প্রভাব ফেলে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যেখানে আমাদের দেশের অর্ধেক জনসংখ্যাই নারী, সেখানে এই বিপুল জনসংখ্যাকে কাজে লাগানোটা জরুরি। ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাওয়া মানে দেশেরই অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হওয়া। শুধু তাই নয়, অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হলেই নারীর ক্ষমতায়নের পথ প্রশস্ত হবে, ফলে নারী নির্যাতনের মতো সামাজিক ব্যাধিও ক্রমে লোপ পাবে।’ নতুন প্রজন্মের যারা নিজেদের বিভিন্ন ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে জড়িত করছেন তাদের মূল্যায়নে সঙ্গীতা আহমেদ বলেন, ‘নতুন যে নারীরা উদ্যোক্তা হিসেবে তৈরি হচ্ছেন তারা অনেক সচেতন বলে আমি মনে করি। তারা অনেক সম্ভাবনাময়ী। সঠিক প্রশিক্ষণ আর ব্যবসা উপযোগী সহায়ক পরিবেশ পেলে এই নারী-উদ্যোক্তারা দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে বড় একটা ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। তাদের প্রতি আমার পরামর্শ—মানসিক দৃঢ়তা হারালে চলবে না। উদ্যোক্তা সে-ই যে ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত। এটা মনে রেখেই কর্মপরিকল্পনা ঠিক করা উচিত। আরেকটি বিষয় হলো, আমাদের নারী উদ্যোক্তাদের আরও বেশি করে ব্যবসার কাজে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। তা ছাড়া আমি মনে করি, নারী উদ্যোক্তাদের কোনো না কোনো অ্যাসোসিয়েশন বা চেম্বারের সদস্য হওয়া উচিত। কারণ এতে ব্যবসায়িক যোগাযোগের সুযোগ বেড়ে যায়, প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নিজের দক্ষতা বৃদ্ধি করা যায় এবং সর্বোপরি মনে জোর পাওয়া যায়।’ ভবিষ্যৎ নিয়ে সঙ্গীতা আহমেদের স্বপ্ন হলো—নারী উদ্যোক্তারা মূলধারার ব্যবসায় নিজেদের আরও বেশি সম্পৃক্ত করবে এবং বাংলাদেশ একটি মধ্যআয়ের দেশে পরিণত হবে।
একনজরে সঙ্গীতা আহমেদ
জন্ম তারিখ ও স্থান :৪ জুলাই, ঢাকা
মায়ের নাম :রেনু আহমেদ
বাবার নাম :ড. তোফায়েল আহমেদ
প্রথম স্কুল :অগ্রণী গার্লস্ স্কুল, ঢাকা
প্রিয় মানুষ :বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
প্রিয় উক্তি :’নারীর সফলতা, দেশের উজ্জ্বলতা।’
প্রিয় পোশাক :টাঙ্গাইলের শাড়ি
অবসর কাটে যেভাবে :বই পড়ে, ভ্রমণ করে
সাফল্যের সংজ্ঞা :সততা ও নিষ্ঠা।