হোয়াইট হাউসে রুমানা
- লিডারশিপ ডেস্ক
বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে আছে লাখ লাখ প্রতিভাবান বাংলাদেশি। এ খবর নতুন নয়। যারা নিজ নিজ প্রতিভায় সমুজ্জ্বল হয়ে আলো ছড়াচ্ছেন প্রতিনিয়ত। বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ সব স্থানে। এরকমই একটি স্থান হলো আমেরিকার প্রেসিডেন্টের বাস ভবন ও প্রধান কার্যালয় হোয়াইট হাউস। এখান থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সব সিদ্ধান্ত ও কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই হাউসে সিনিয়র অ্যাডভাইজার হিসেবে কাজ করেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত রুমানা আহমেদ। উল্লেখ্য, প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক উপ-উপদেষ্টা বেন রোডসের সহকারী হিসেবে কাজ করছেন এই তরুণী। নিজেকে বাঙালি মুসলিম আমেরিকান বলতেই পছন্দ করেন রুমানা। ২৭ বছর বয়সী এই বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত রুমানা রাষ্ট্রীয় অনেক স্পর্শকাতর ও গোপন বিষয়েও কাজ করে আসছেন সাফল্যের সঙ্গে।
জন্ম ও পড়াশোনা
বাঙালি পরিবারে জন্ম নেওয়া রুমানার বেড়ে ওঠা যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ডে। খুব ছোটবেলা থেকেই পরিবার ও বন্ধুদের সময় দিতে ও ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করতেন তিনি। রুমানার আরও একটি পছন্দের বিষয় ছিল বাস্কেট বল খেলা। রুমানা জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি থেকে পড়াশোনা শেষ করেন। ছোটবেলায় একবার হোয়াইট হাউসে গিয়েছিলেন অন্য দর্শনার্থীদের মতোই। কিন্তু এখানেই তার কর্মক্ষেত্র হবে তা আগে কখনো ভাবেননি রুমানা।
পথচলা হোয়াইট হাউসে
রুমানা যখন চাকরি করতে এলেন হোয়াইট হাউসে, তখন ভয় পেয়েছিলেন কিছুটা। শঙ্কা ছিল, সহকর্মীরা একজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মুসলমান নারীকে সহজভাবে নিতে পারা নিয়ে। তবে অল্পদিনেই তার শঙ্কা কেটে যায়। শুরু থেকেই হোয়াইট হাউসে সবার সহযোগিতা পেয়ে এসেছেন রুমানা। রুমানা যখন জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছিলেন তখন হোয়াইট হাউসে ইন্টার্ন হওয়ার আবেদন জানান। প্রেসিডেন্ট ওবামার পরিবর্তনের বাণী তখন উৎসাহ জোগাত রুমানাকে। তবে তখন ভেবেছিলেন, কিছুদিন কাজ করেই বিদায় নেবেন। কিন্তু নির্বাচিত হওয়ার পর কাজের প্রতি অধিক আগ্রহী হয়ে ওঠেন তিনি। ইন্টার্ন শেষ হলে তিনি আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যান এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। পরে হোয়াইট হাউস থেকে আবার ডাক পান রুমানা। পরবর্তীতে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করতে থাকেন এবং পদোন্নতি লাভ করেন। হোয়াইট হাউসে সিনিয়র অ্যানালিস্ট হিসেবে কাজ করেন ২০১১ সালের আগস্ট থেকে ২০১২ সালের জুন পর্যন্ত। এরপর এক্সিকিউটিভ অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কাজ করেন পাবলিক এনগেজমেন্টের প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড ডিরেক্টরের সঙ্গে।
এরও দুই বছর পর ২০১৪ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা বেন রোডসের হয়ে কাজ করেন রুমানা আহমেদ।
রুমানা প্রসঙ্গে বেন রোডস বলেন, আমি প্রতিদিন তার ওপর নির্ভার হয়ে নির্ভর করি। বৈশ্বিক বাণিজ্য থেকে মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক সব কিছুতেই রুমানার ওপর নির্ভর করা যায়। এই যেমন কিউবার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নেও তিনি ভূমিকা রাখলেন। আবার এশিয়ার দেশগুলোকেও তিনি ভালো বোঝেন। তিনি দেশের প্রতি খুবই অনুগত। বিশ্বাস আর দায়িত্বকে তিনি গুলিয়ে ফেলেন না। তিনি নতুন প্রজন্মের আমেরিকান মুসলমানদের জন্য নমুনা হাজির করছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের বাল্টিমোরে ওবামার মসজিদ পরিদর্শনের দায়িত্ব ছিল রুমানার
বছরের শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বাল্টিমোরের মসজিদ পরিদর্শনের সময় যাবতীয় সব দায়িত্ব ছিল রুমানার। এ প্রসঙ্গে এক ব্লগে রুমানা জানান প্রেসিডেন্টের মসজিদ পরিদর্শন ব্যাপারটি তার অনুভূতিতে নাড়া দিয়েছে। এ সময় ৯/১১-এর হামলার সময়ের কথা মনে করে বলেন, আমি তখন অষ্টম গ্রেডের ছাত্র ছিলাম। একজন মুসলমান হিসেবে দিনগুলো আমেরিকায় আমার জন্য কঠিন হয়ে উঠল। স্কুলের সহপাঠীরাও অন্য রকমভাবে তাকাচ্ছিল। কোনো শিশুর পক্ষে সেটা বেশ ভারী ব্যাপার ছিল। তবে আজ পরিস্থিতি আলাদা। অন্যদের মতো আমিও একজন আমেরিকান। ধর্মের প্রতি আমার অনুরাগ, আমেরিকার মূল্যবোধ আমাকে সাহসী করেছে। আমি সরকারি চাকরিতে স্বচ্ছন্দ এখন। হোয়াইট হাউসের ওয়েস্ট উইংয়ের দরজা ঠেলে ঢুকি যখন ভেবে আনন্দিত হই যে দেশকে নিজের দেশ ভাবি, সে দেশের নিরাপত্তা রক্ষায় আমি ভূমিকা রাখছি।
শক্ত মানসিকতার রুমানা
মানসিকভাবে খুব শক্ত মানুষ রুমানা। যে কোনো বাধা সামনে আসা মাত্রই তিনি বিন্দুমাত্র না বিচলিত হয়ে তা ডিঙানোর সাহস রাখেন। বিশ্বাস করেন, শান্তিপূর্ণ উপায়েই যে কোনো প্রকার বিরোধীদের জবাব দেওয়া যায়। তিনি আমেরিকার সব মানুষের ওপর পূর্ণ আস্থা রাখেন এবং মনে করেন, আমেরিকা সব বাধা পেরিয়ে যেতে পারবে। রুমানা ষাটের দশকের সিভিল রাইটস মুভমেন্টের এক্ষেত্রে উল্লেখ করে বলেন, ইতিহাস সাক্ষী, মানুষ সমস্যা আর কষ্টের মধ্যেও ঐক্য গড়ে তুলতে পারে এবং আনতে পারে। নারীর ক্ষমতায়নও তার আগ্রহের অন্যতম একটি বিষয়।
বাঙালি সংস্কৃতির ধারক রুমানা
বাঙালি সংস্কৃতির ধারক রুমানা জানান খুব ছোটবেলাতেই মা-বাবা তাকে আমেরিকা ও বাংলাদেশের সংস্কৃতির সঙ্গে ভালোভাবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। শিক্ষিত করেছেন ইসলামী শিক্ষায়ও। বিশ্বাস করে শান্তিপূর্ণভাবে যে কোনো সমস্যা সমাধান করা সম্ভব। রুমানা বলেন, একবার আরিজোনার এক মসজিদের সামনে কিছু মানুষ বন্দুক হাতে দাঁড়িয়েছিল এ জন্য যে বের হওয়া মাত্রই মুুসলমানদের হত্যা করা হবে। কিন্তু সেদিন তারা সফল হয়নি। পর দিনই মসজিদের ইমাম সাহেব ওই লোকদের মসজিদের ভিতরে আমন্ত্রণ জানান। তাদের মধ্য থেকে একজন মসজিদে প্রবেশ করার পর তিনি ফিরে এসে তার সঙ্গীদের বলেন, আমরা ইসলাম সম্পর্কে ভুল বুঝে বসে আছি। রুমানার পছন্দের অভিনেতা বিখ্যাত অভিনয় শিল্পী অ্যাডাম স্কট।
.
জো বাইডেনের সঙ্গে
দুই বছর আগে রুমানা ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে মরক্কো গিয়েছিলেন। উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের নারী উদ্যোক্তাদের নিয়ে তিনি সমাবেশ করেছিলেন এবং বিশ্ব মহিলা দিবস উদযাপনে উৎসাহ জুগিয়েছিলেন।
দর্শন
মানুষ হিসেবে রুমানার দর্শন যে কারও জন্য অনুপ্রেরণীয়। তার মতে মানুষ যেমনই হোক, ভালো ব্যবহার কর। এমনই দর্শন রুমানার। রুমানা বলেন, মানুষ সে যে গোত্রের বা ধর্মেরই হোক, সম্মান জানানোর বিষয়টিই প্রথমে আসবে। তার দাবি মানুষের হাসি বদলে দিতে পারে যে কোনো অনাহূত পরিস্থিতি। রুমানা বলেন, আপনার হাসিমুখ পরিস্থিতি বদলে দিতে পারে। রুমানা মনে করেন ধৈর্য দিয়েই হিংসা মোকাবিলা করতে হয়। আমি বিশ্বাস করি আপনি যদি পরিশ্রম করেন এবং নিয়ম মেনে চলেন তবে আমেরিকায় আপনি যে কোনো কাজে সফলতা পাবেন। আপনি একজন বাঙালি হিজাব পরিহিত মুসলমান হয়েও আপনার স্বপ্ন পূরণ করতে পারবেন এবং দেশের হয়ে কাজ করতে পারবেন এমনকি তা হোয়াট হাউসেও।