তিনি সমুদ্রের মানচিত্রী
- লিডারশিপ ডেস্ক
অধ্যাপক ড. সাইদুর রহমান চৌধুরী জিওলজিক্যাল ওশানোগ্রাফি পড়ান। তিনি ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সেস অ্যান্ড ফিশারিজের অধ্যাপক। অনেকে একে সামুদ্রিক বিজ্ঞান ও মৎস্যবিদ্যা ইনস্টিটিউট নামেও চেনেন। অনেক দিন ধরে পড়াতে গিয়ে তিনি উপলব্ধি করলেন, বঙ্গোপসাগরের নিচের পূর্ণাঙ্গ মানচিত্র না থাকায় ছেলেমেয়েরা বিষয়টি ভালোভাবে বুঝতে পারে না। তখন থেকেই সমুদ্রসীমার মানচিত্র তৈরির ভাবনাটি তাঁকে পেয়ে বসল। ২০০৬ সাল থেকে কাজ শুরু করলেন। বছরদুয়েক বঙ্গোপসাগরের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও সেগুলো বিশ্লেষণে কাটল। অবশেষে তিনি তৈরি করলেন ‘দ্য জিওলজিক্যাল ওয়ার্ল্ড ম্যাপ।’ এই কাজের সাফল্যেই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, শুধু বঙ্গোপসাগর নিয়ে মানচিত্র তৈরি করবেন। তাতে সাগরের তলদেশের গভীরতা, সমুদ্রসীমা, ঋতুভেদে সমুদ্রের স্রোত, লবণাক্ততা, তাপমাত্রাসহ নানা তথ্য থাকবে। এটি গবেষক, আগ্রহীদের কাজে লাগবে।
২০১৪ সালের ৮ জুলাই ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমার রায় পাওয়া গেল। তার দুই দিন পরে, ১০ জুলাই ‘বাংলাদেশের সমুদ্রপ্রদেশ’ নামের মানচিত্রটি প্রকাশ করা হয়। এই মানচিত্র তৈরির জন্য অধ্যাপক ড. সাইদুর রহমান চৌধুরী অসংখ্যবার বঙ্গোপসাগরে গিয়েছেন, সাগরের তলদেশের গভীরতা-প্রকৃতি, সাগরকে ঘিরে থাকা দেশগুলোর অর্থনৈতিক সীমানা, আমাদের অর্থনৈতিক সীমানা, মত্স্য ও চিংড়ি আহরণ ক্ষেত্র, ভৌগোলিক নাম, গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক পয়েন্টগুলো চিহ্নিত করেছেন। মানচিত্রে নানা গভীরতায় সাগরের আয়তন ও কোন অংশের কী অর্থনৈতিক ব্যবহার হতে পারে সেগুলো দেখানো হয়েছে।
বঙ্গোপসাগরের মানচিত্র তৈরিই এই ইনস্টিটিউটের প্রথম সাফল্য নয়। ড. সাইদুর ও অধ্যাপক ড. শাহাদাত হোসেন মিলে ২০০৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের মানচিত্রও তৈরি করেছেন। তাতে ক্যাম্পাসের প্রধান সড়ক, অনুষদ, বিভাগ, মাঠ, ছাত্রাবাস, মসজিদ চিহ্নিত আছে। এর নাম ‘ক্যাম্পাস গাইড ম্যাপ’। এ ছাড়া তিনি পার্বত্য এলাকার যেসব খাল-বিল থেকে নদীতে পানি এসে পড়ে, সেসব রিভার বেসিন ও ৭৫টি পর্বতশৃঙ্গ চিহ্নিত করে বিস্তারিত পর্বত মানচিত্র ও পর্বতের পূর্ণাঙ্গ তালিকা করেছেন। দেশে এই ক্ষেত্রে এটিই প্রথম কাজ।
এ ছাড়াও ইনস্টিটিউটে নানা ধরনের গবেষণা ও আবিষ্কার হয়। এগুলোর মধ্যে উপকূলীয় এলাকায় আধুনিক মত্স্য চাষ পদ্ধতি, উপকূল ও নদ-নদীতে ইলিশের প্রজনন ক্ষেত্র চিহ্নিতকরণ, একাধিক মাছের নতুন প্রজাতি আবিষ্কার উল্লেখযোগ্য। ২০১৪ সালে পরিবেশ নিয়ে গবেষণার জন্য ইনস্টিটিউটকে জাতীয় পরিবেশ পদক দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে গেল পাঁচ দশকে ইনস্টিটিউটের অধীনে আড়াই হাজার গবেষণা হয়েছে। এর অন্তত ৮০০টি নানা আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। সর্বশেষ ইনস্টিটিউট বঙ্গোপসাগরের ৩১৭টি শামুক-ঝিনুকের [সি-শেল] সচিত্র ক্যাটালগ প্রকাশ করেছে। দেশের প্রথম এই ক্যাটালগে ১৮১টি প্রজাতি প্রথমবারের মতো শনাক্ত হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবেও এখানকার অধ্যাপকরা গবেষণা করে চলেছেন। ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. শাহাদাত হোসেন ‘নানদুস মেনি’ নামে মেনি মাছের নতুন প্রজাতি, ‘হেটারোপেনাসটার মেনি’ নামে শিং মাছের একটি প্রজাতি শনাক্ত করেছেন। শুধু শিক্ষকরাই নন, অনুষদের ছাত্রছাত্রীরাও গবেষণার সঙ্গে যুক্ত আছেন। যেমন সাগরের পানিকে পানযোগ্য করতে সাবেক শিক্ষার্থীদের নিয়ে সহযোগী অধ্যাপক ড. শেখ আফতাব উদ্দিন ২০১০ সালে কক্সবাজারে গবেষণা শুরু করেন। টানা গবেষণা শেষে তাঁরা স্বল্প খরচের সুপেয় পানি তৈরি যন্ত্র আবিষ্কার করেছেন। এটি সেই এলাকাগুলোতে ব্যবহার হচ্ছে।
তবে নানা সমস্যা পেরিয়ে তাঁরা কাজ করছেন বলে জানালেন ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকরা। ৩৫০ জনেরও বেশি শিক্ষার্থীর এই অনুষদে আধুনিক একাডেমিক ভবন, ভালো গবেষণাগার—কোনোটাই নেই। আলাদা পরিবহনও নেই। শুধু আছে সেশন জট। এসব বিষয়ে ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. শাহাদাত হোসেন জানান, ‘অন্য ইনস্টিটিউট বা বিভাগের মতো অত সুযোগ-সুবিধা না থাকলেও আমাদের অনেক অর্জন আছে। সেশন জট কমানোর চেষ্টা করছি। ভবন সংস্কারের প্রকল্প প্রস্তাব ইউজিসিতে জমা দেওয়া আছে।’