দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য সুদীপ্তর উদ্যোগ
- লিডারশিপ ডেস্ক
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের এক বিকেল! খুলনার একুশে বইমেলা প্রাঙ্গণ। হাজারো মানুষের ভিড়। সেই ভিড়ের এক কোণে একটি স্টলে এক তরুণ একটা বইয়ের প্রথম পাতা থেকে কিছু পড়ে শোনাচ্ছিলেন আরেকজনকে। এরপর আরেকটা। এ রকম বেশ কয়েকটা বইয়ের অংশ পড়ে শোনানোর পর শ্রোতার চাহিদা অনুযায়ী কেনা হয় কয়েকটি বই। যার জন্য বই কেনা হলো, সেই তরুণ কোনো দিন পৃথিবীর আলো দেখেননি।
ঘটনাটি কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করে সদ্য কলেজে পা রাখা বইপ্রেমী এক তরুণ। সে জানতে পারে, যিনি বই পড়ে শোনাচ্ছিলেন তিনি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ছেলেটির বড় ভাই। অফিস শেষে বাসায় ফিরে ভাইকে বিভিন্ন বই পড়ে শোনান। আগে নিয়মিত বই পড়ে শোনানো হলেও ব্যস্ততার কারণে এখন আর খুব বেশি হয়ে ওঠে না।
দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ছেলেটির বইয়ের প্রতি এই ভালোবাসায় মুগ্ধ হয় সদ্য কৈশোর পেরিয়ে আসা তরুণ। সেই সঙ্গে ছেলেটির নিজে না পড়তে পারার কষ্ট তার মনে গভীর দাগ কাটে। সেদিনের মতো মেলা থেকে বেরিয়ে বাড়ি ফেরে সে, কিন্তু মনের মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে ঘটনাটি। ভাবতে থাকে বইয়ের প্রতি ভালোবাসা আছে, কিন্তু দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী এমন মানুষদের জন্য কিছু একটা করার। ভাবনায় আসে, ‘তারা নিজে পড়তে না পারুক, আমি তো পড়ে শোনাতে পারি।’ যেই ভাবনা সেই কাজ। শুরু করে বইয়ের অডিও রেকর্ডিং করার কাজ।
উদ্যমী এই তরুণের নাম সুদীপ্ত সাহা। খুলনা পাবলিক কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র সে। ‘দৃষ্টি এবার মিলবে বইয়ে’ স্লোগান নিয়ে সুদীপ্ত প্রতিষ্ঠা করে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘শ্রুত’। আর এসব ধারণ করা অডিওর জন্য গড়ে তোলে একটি ওয়েবসাইট। ওই ওয়েবসাইটে এখন বিভিন্ন ক্যাটাগরির ১৮টি বইয়ের ১৩০টির মতো অডিও ক্লিপ পাওয়া যাচ্ছে। যে কেউ চাইলে সেগুলো শুনতে পারবে। আরও কিছু অডিও রেকর্ডিংয়ের কাজ শেষ। বিজ্ঞানভিত্তিক কিছু ব্লগ রেকর্ডিংয়েরও কাজ চলছে।
গত শনিবার সকালে কথা হয় সুদীপ্তর সঙ্গে। সে বলল, ‘গল্প, উপন্যাস, নোট, ব্লগ আমরা আনন্দ নিয়ে পড়ি। অথচ হয়তো ইচ্ছা থাকার পরও শুধু দৃষ্টিশক্তি না থাকায় অনেকে সেই আনন্দটা পাচ্ছে না। ওদের সামান্য একটু পড়ার আনন্দ দেওয়ার জন্যই শ্রুত যাত্রা শুরু করেছে। ধীরে ধীরে হাজারো দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীর জন্য গড়ে তোলা হবে অসংখ্য শ্রুত-বই।’
লক্ষ্যের কথা জানিয়ে সুদীপ্ত জানায়, বাংলা সাহিত্যের ভান্ডার ভীষণ সমৃদ্ধ। বাংলায় লেখা হাজারো বই একবার দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরাও পড়ুক। সব না হোক কিছু। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের বই পড়ার প্রচলিত পদ্ধতি ব্রেইল। কিন্তু সব বইয়ের ব্রেইল করা সম্ভব নয়। তাই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের বই পড়ার আনন্দদানের ব্যবস্থা করা এবং তাদের সাহিত্যচর্চায় উৎসাহিত করাই শ্রুতর লক্ষ্য।
সুদীপ্ত তার উদ্যোগের কথা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জানিয়ে অন্যদেরও এগিয়ে আসার আহ্বান জানায়। বইয়ের প্রতি ভালোবাসা আর মানুষের জন্য কিছু করার তাগিদ থেকে এ কাজে যুক্ত হয় দেশের বিভিন্ন প্রান্তের আরও কয়েকজন। তারাই এখন অডিওর সংখ্যা বাড়ানোর কাজ করে যাচ্ছে। তারা একেকটি বইকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে অডিও রেকর্ডিং করে। সাধারণত একেকটা পর্ব রেকর্ডিং হয় ৮ থেকে ১২ মিনিটের। তারপর সেটি ইউটিউবের মাধ্যমে শ্রুতর নিজস্ব ওয়েবসাইটে আপলোড করা হয়।
শ্রুতর সদস্য ও স্বেচ্ছাসেবীরা বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের ওপর লেখা আটটি বইয়ের অডিও নিয়ে ‘একাত্তরকে শোনো’ নামের একটি অ্যাপ তৈরির কাজ করছে। ডিসেম্বরের মধ্যে কাজটি শেষ হবে বলে আশা করছে তারা। পর্যায়ক্রমে সেখানে মুক্তিযুদ্ধের ওপর লেখা সব বই যোগ করার ইচ্ছা আছে তাদের।
শ্রুতর এই কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে চাইলে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মুহাম্মদ আলমগীর বলেন, তরুণ প্রজন্মের নানা অবক্ষয়ের খবরের মধ্যেও এ ধরনের ভালো কাজ প্রেরণা জোগায়। প্রতিবন্ধকতা যে জ্ঞানচর্চায় বাধা হতে পারে না, এই তরুণদের দৃষ্টিভঙ্গি তা প্রমাণ করছে। আশা করছি তাদের এ কাজ আরও সমৃদ্ধ হবে।
খুলনা নগরের গোয়ালখালীতে সরকারি দৃষ্টি ও বাক-শ্রবণপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক কাজী মুহাম্মদ ইব্রাহীম বলেন, ‘এই উদ্যোগ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জ্ঞানের ভান্ডার সমৃদ্ধ করবে। অডিওগুলো পেলে আমি শোনার ব্যবস্থা করে দেব।’
সুদীপ্ত ছাড়া শ্রুতর নিয়মিত সদস্যরা হলো মাহদী মুশফিক কামাল, তাসফিয়া তাহসিন ও বগুড়ার সৌরভ সাহা।
এ ছাড়া স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করছে অন্যান্য জেলার কয়েকজন কিশোর–কিশোরি ও তরুণ–তরুণী।
শ্রুতর স্বেচ্ছাসেবী হতে চাইলে
সুদীপ্ত জানায়, বেশি বেশি বইয়ের অডিও করার জন্য আরও অনেক স্বেচ্ছাসেবকের প্রয়োজন। স্বেচ্ছাসেবক হতে হলে http://www.shruto.org ওয়েবসাইটে ঢুকতে হবে। এখানে ‘হতে চাইলে স্বেচ্ছাসেবী কণ্ঠ’ নামে একটি অংশ আছে, সেখানে কিছু তথ্যসহ একটি বক্সে আহমেদ ছফার লেখার একটি অংশ আছে—ওই অংশটুকু রেকর্ড করে info.shruto@gmail.com ঠিকানায় পাঠাতে হবে। তারপর যাচাই-বাছাই শেষে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে চূড়ান্ত করা হবে।
বর্তমানে যেসব বইয়ের অডিও আছে
ছোটদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা, একাত্তরের চিঠি, একাত্তরের দিনগুলি, একাত্তর এবং আমার বাবা, উইংস অব ফায়ার, যখন ছোট ছিলাম, আনা ফ্রাংকের ডায়েরি, তিতুনি এবং তিতুনি, ক্রেনিয়াল, গাব্বু, মহাজাগতিক কিউরেটর, সেরিনা, রামের সুমতি, রহস্য ও আতঙ্কের গল্প, ফটেং, আমার বন্ধু রাশেদ এবং All Quiet On the Western Front (অনুবাদ)।