খেলতে খেলতে পড়াশোনা
- লিডারশিপ ডেস্ক
বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের উদ্দেশ্য হলো এমন একটি সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলা, যেখানে কোনো জ্ঞান অর্জনে ধনী-গরিবের ভেদাভেদ থাকবে না। সমাজে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও যেসব শিশুর হয়ে ওঠে না পড়ালেখা করা, পছন্দমতো বই পড়া, নাচ শেখা, গান শেখা কিংবা আঁকা-আঁকি করার, সেসব শিশুর স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে কাজ করছে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন।
শিক্ষা মানুষের মনোবিকাশের পথ উন্মুক্ত করে। শুধু তাই নয়, জীবনের সব ধরনের বিষয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। শিক্ষা জাগ্রত করে মানুষের ভেতরকার ঘুমন্ত বিবেককে। আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা যথেষ্ট প্রশংসনীয় হলেও এর যথার্থ প্রয়োগের অভাবে শিশুদের অসীম চিন্তা ও চেতনার পথকে ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে অনেকটাই আবদ্ধ করে রাখছে। সমাজে এক শ্রেণির শিক্ষার্থী আছে, যারা আর্থিক দুর্বলতা অথবা দিকনির্দেশনার অভাবে প্রতিযোগিতামূলক শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে ছিটকে পড়ছে। এসব সুবিধাবঞ্চিত শিশু ও ছাত্রছাত্রীর স্বার্থে এগিয়ে চলেছে ‘বিদ্যানন্দ’ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বিদ্যানন্দ এমন একটি শিক্ষা সহায়ক প্রতিষ্ঠান, যেখানে সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা আনন্দের সঙ্গে শিক্ষা লাভ করে থাকে।
ছিল বাবা-মা আর পাঁচ ভাই-বোনের অভাব-অনটনের সংসার। পড়ালেখায় বোন শ্রিপা দাশ ভালো হলেও, ভাই কিশোর কুমার দাশ ছিল একটু দুর্বল। স্কুলে যা পড়ানো হতো, ঠিকভাবে বুঝতেও পারত না সে। সে পড়া বোঝার জন্য কারও কাছে প্রাইভেট পড়বে বা কোচিং করবে সে সামর্থ্যও ছিল না তার পরিবারের। দুর্বল স্মৃতিশক্তির কারণে পরিবার কিংবা বিদ্যালয়ে কারও দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেনি কিশোর কুমার। বরং মনোযোগের অভাব আছে ভেবে অবহেলিত হয়েছে শৈশবে। লেখাপড়ার ইতি ঘটেছে মাধ্যমিকের পরই। তারপরও থেমে থাকেনি ওই কিশোর কুমার দাশ। সব দুঃখ আর দুর্দশা পেছনে ফেলে নতুন পথ খুঁজে নেয় সে। শিপ্রা বলেন, কিশোর কুমার চাইতেন এমন একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করবেন, যেখানে তার মতো অবহেলিত শিশুরা আনন্দের সঙ্গে শিক্ষা লাভ করবে। আর সে ইচ্ছা থেকেই প্রতিষ্ঠা করা হয় ‘বিদ্যানন্দ’ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি।
সুদূর পেরুপ্রবাসী কিশোর কুমার দাশ ২০১৩ সালের আগস্টে বিদ্যানন্দের ভাবনা নিয়ে কথা বলেন বোন শিপ্রা দাশের সঙ্গে। শিপ্রা দাশের শিক্ষা নিয়ে কিছু করার ইচ্ছা থাকায় ভাই কিশোর তাকে বিদ্যানন্দের কার্যক্রম শুরু করতে বলেন। পড়ব, খেলব, শিখব- এই মূলমন্ত্র নিয়েই ব্যক্তিগত উদ্যোগের মধ্য দিয়ে ২০১৩ সালের ২২ ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জে শুরু হয় বিদ্যানন্দের কার্যক্রম। বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের উদ্দেশ্য হলো এমন একটি সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলা, যেখানে কোনো জ্ঞান অর্জনে ধনী-গরিবের ভেদাভেদ থাকবে না। সমাজে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও যেসব শিশুর হয়ে ওঠে না পড়ালেখা করা, পছন্দমতো বই পড়া, নাচ শেখা, গান শেখা কিংবা আঁকা-আঁকি করার, সেসব শিশুর স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে কাজ করছে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন। এ ছাড়া আমরা দেখি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যারা দুর্বল শিক্ষার্থী তারা দুর্বলই থেকে যায়। একজন মেধাবী শিক্ষার্থী এদের তুলনায় অনেকাংশে একটু বেশি সেবা পেয়ে থাকে শিক্ষকদের কাছ থেকে। প্রতিযোগিতামূলক শিক্ষা ব্যবস্থায় এসব অবহেলিত শিক্ষার্থী সঠিক দিকনির্দেশনা পেলে তাদের ভেতরকার সম্ভাবনাটা বেরিয়ে আসবে। আর এ লক্ষ্যেই বিদ্যানন্দ বিনামূল্যে আনন্দদায়ক উপকরণের মাধ্যমে মৌলিক জ্ঞান বিকাশিত করে লেখাপড়ায় শিশুদের আগ্রহী করে তুলতে কাজ করে আসছে। শুরুটা ছোট করে হলেও লক্ষ্যটা ছিল অনেক বড়। মাত্র ১০ শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করা বিদ্যানন্দে বর্তমানে ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, রাজবাড়ী ও কক্সবাজার- এই ৫ শাখা মিলিয়ে সাড়ে সাত শতাধিক শিক্ষার্থী রয়েছে। এসব শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে ফ্রি কোচিং দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। বিদ্যানন্দের শিক্ষা কার্যক্রম সম্পর্কে শিপ্রা দাশ বলেন, আমরা চাই মুখস্থ বিদ্যায় নির্ভর না হয়ে আনন্দের সঙ্গে শিক্ষা অর্জন করবে শিশুরা এবং এগিয়ে যাবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ভয় দূর করে উচ্চশিক্ষার দিকে।
বিদ্যানন্দের শিক্ষা কার্যক্রম নিয়ে কর্মকর্তা আবু হাসান আবদুল্লাহ বলেন, ‘বিদ্যানন্দে প্রথম শ্রেণি থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা পর্যন্ত পড়ালেখায় সাহায্য করা হয়। যাদের বই-খাতা কেনার সামর্থ্য নেই তাদের বই-খাতাসহ পড়ার যাবতীয় জিনিসপত্র দিয়ে থাকি।’ তাছাড়া প্রতিষ্ঠানটি চারটি শাখায় সর্বসাধারণের জন্য লাইব্রেরি সুবিধাও দিয়ে আসছে। সব মিলিয়ে প্রায় আট হাজারেরও বেশি বইয়ের সমন্বয় গড়ে উঠেছে লাইব্রেরিগুলো। বইয়ের এই বিশাল ভাণ্ডারের জন্য কোনোরূপ সদস্য না হয়েও এখানে বইপ্রেমীরাও আসছে। উন্মুক্ত এই লাইব্রেরির মধ্য দিয়ে বইকে মানুষের কাছে পেঁৗছে দেওয়া এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি একজন শিক্ষার্থীকে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা এ প্রতিষ্ঠানের একটি অন্যতম লক্ষ্য। প্রতিষ্ঠানের কাজকে গতিশীল রাখতে শুরুর প্রথমদিন থেকেই বেতনভুক্ত কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বেতনভুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পাশাপাশি এখানে কাজ করছেন শতাধিক স্বেচ্ছাসেবকও। যারা নিরলসভাবে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের মানোন্নয়নের জন্য পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটির মাসিক খরচের ১০-১৫% মানুষের স্বেচ্ছায় দান থেকে আসে এবং বাকি যাবতীয় খরচ প্রতিষ্ঠাতা কিশোর দাশ নিজেই চালান।
বিদ্যানন্দের কার্যক্রম দেখতে গিয়ে কথা হয় নবম শ্রেণির ছাত্র জুম্মানের সঙ্গে। ২০১৪ সাল থেকে জুম্মান এখানে নিয়মিত ক্লাস করছে। মা গার্মেন্টে কাজ করে পরিবারে একাই উপার্জন করেন। তাই অভাব-অনটনের কারণে প্রায় বন্ধ হয়ে যেতে বসেছিল তার পড়ালেখা। সেই মুহূর্তে বিদ্যানন্দের সন্ধান পেয়ে পড়তে আসে এখানে। জুম্মান বলে, ‘পড়ালেখা করব কী, মাঝে মধ্যে খাওয়াই পেতাম না। আর এখানে পড়তে পারছি, খেতে পারছি।’ তার পাশেই বসে থাকা তিশা বলে, আগে পড়া বুঝতাম না, তাই পড়ালেখাকে ভয় পেতাম। এখানে একটা জিনিস না বুঝলে বারবার বোঝানো হয়।
বিদ্যানন্দের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠাতা কিশোর কুমার দাশ বলেন, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে তেমন না ভাবলেও ইচ্ছা আছে সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য একটি বিশেষ বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার। যেখানে বুদ্ধিমত্তার পরীক্ষা দিয়ে সুবিধাবঞ্চিত মেধাবীরা পড়ার সুযোগ পাবে। যাত্রা শুরুর অল্প দিনের মধ্যেই বিদ্যানন্দের কিছু কার্যক্রম বেশ সাড়া জাগিয়েছে। তার মধ্যে একটি হলো- ‘এক টাকার আহার’। শিশুরা যেন মনে না করে যে এটা দান কিংবা ভিক্ষা নয়, তাই তাদের কাছ থেকে এক টাকা নেওয়া হয়। এ কর্মসূচির উদ্দেশ্য শুধু শিশুদের ক্ষুধা মেটানোই নয়। এর আরেকটি উদ্দেশ্য হলো ক্ষুধা নিবারণের জন্য তারা যেন সমাজবিরোধী কাজে লিপ্ত না হয়। শুধু পড়ালেখাই নয়, মেধা বিকাশে এর পাশাপাশি স্বশিক্ষায় শিক্ষিতকরণ, নৈতিক মূল্যবোধের উন্নতি, সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি ইত্যাদি নিয়ে কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি। প্রতি মাসের কোনো শুক্রবার শিক্ষার্থীদের সিনেমা দেখানো হয়। আবার কোনো শুক্রবার তাদের চিন্তাশক্তি বৃদ্ধি আর মানবিক বিকাশে বিভিন্ন কর্মশালার আয়োজন করা হয়। তাছাড়া প্রতি মাসের শেষ শুক্রবার কিংবা বিশেষ কোনো উৎসবে বিভিন্ন আয়োজন করা হয় সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য। অন্যান্য কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে ফ্রেমে বাঁধা শৈশব, চলো বন্ধু হই ইত্যাদি। সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটি গোবিন্দগঞ্জের উচ্ছেদ হওয়া সাঁওতালদের পাশে দাঁড়িয়েছে।
বিদ্যানন্দের প্রতিষ্ঠাতা কিশোর কুমার দাশ ও শিপ্রা দাশ মনে করেন, মানুষের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি আর সহনশীলতাই পারে সমাজকে এগিয়ে নিতে। ছোট পরিসরে বেড়ে ওঠা এ প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম দেখে যদি অল্প কিছু মানুষও উৎসাহিত হয়ে এগিয়ে আসে- সেটাই হবে বিদ্যানন্দের সার্থকতা।