‘কি হতে চাই সেটা আগে ঠিক করতে হবে’
- লিডারশিপ ডেস্ক
নিজ কর্মগুণে তিনি পৌঁছে গেছেন সফলতার অনন্য শিখরে। দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে তিনি এখন বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। তিনি হলেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ। ১৯৭২ সালে ঢাকায় জন্মগ্রহণকারী ড. নাজনীনের পিতৃভূমি নরসিংদী হলেও শৈশব কেটেছে ঢাকা ও খুলনায়। বাবার চাকরির সুবাদে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাজীবন খুলনায়। ছোটবেলা থেকে তিনি নানামুখী ক্রীড়া, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যেমন ছিলেন পারদর্শী তেমনি অর্জনও করেছেন অসংখ্য পুরস্কার। এসএসসি ও এইচএসসি উভয় পরীক্ষায় সম্মিলিত প্রথম স্থান অধিকারী এ মেধাবী শিক্ষার্থী উচ্চতর শিক্ষার জন্য ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে। সেখান থেকে তিনি ফার্স্ট ক্লাস সেকেন্ড হয়ে অনার্স এবং ফার্স্ট ক্লাস সেকেন্ড হয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। পরবর্তীতে তিনি উচ্চতর ডিগ্রির জন্য ব্রিটিশ স্কলারশিপে ইউনিভার্সিটি অব সাসেক্স থেকে উন্নয়ন অর্থনীতিতে দ্বিতীয়বার মাস্টার্স করেন। এছাড়া নেদারল্যান্ডসের ওয়াগানিংগাং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। একজন অর্থনীতিবিদ হিসেবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, শিল্প ও শ্রমিক ইস্যু, জেন্ডার ইস্যু ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং আঞ্চলিক বিষয়ে গবেষণার পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন সময়ে নারীর ক্ষমতায়ন ও নারীর উন্নয়ন বিষয়ে গবেষণালব্ধ প্রবন্ধ রচনা করেছেন। বর্তমানে তিনি পিকেএসএফ’র (পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন) জেনারেল বডির সদস্য, পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের পরিচালকের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বিশ্বব্যাংক, ইউনাইটেড নেশনসসহ অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে গবেষণা সংক্রান্ত বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে যুক্ত রয়েছেন। এছাড়া সরকারের সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়নের ১৯ সদস্যের কমিটির অর্থনীতিবিদ প্যানেলের সদস্য ছিলেন।
কর্মক্ষেত্রে সফল এ অর্থনীতিবিদ নারী জাগরণে তার মতামত ব্যক্ত করতে গিয়ে সম্ভাবনা, বাস্তব অবস্থা, প্রতিবন্ধকতা ও তা উত্তরণের উপায় এবং ভবিষৎ করণীয় নিয়ে কথা বলেছেন এক সাক্ষাৎকারে।
: আপনি অনেক আন্তর্জাতিক ও বহুজাতিক সংস্থা, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থায় অর্থনীতিবিদ হিসেবে যুক্ত রয়েছেন। সরকারের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়ন কমিটিরও সদস্য ছিলেন আপনি। এতো অল্প বয়সে এবং একজন নারী হিসেবে আপনার কাজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে চাচ্ছি।
নাজনীন আহমেদ : গবেষণা প্রক্রিয়াটি একটু জটিল। আমরা যখন গবেষণা করি তখন বিভিন্ন বিষয় খেয়াল রাখতে হয়। খুঁটিনাটি অনেক বিষয় গবেষণার মাধ্যমে তুলে আনতে হয়। যেহেতু আমি বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো হিসেবে কর্মরত; সেহেতু সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়কে গবেষণার বিষয়ে সহায়তা প্রদান আমাদের দায়িত্ব। আর যেহেতু আমি বাণিজ্য নিয়ে কাজ করি তাই প্রায়ই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন কমিটিতে বিভিন্ন বিষয়ে আমাকে রিসার্চ সাপোর্ট দিতে হয়। এরই ধারাবাহিকতায় আমিও সপ্তম পঞ্চমবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়ন কমিটিতে ছিলাম। ওই কমিটিতে সরাসরি আমার দুই শিক্ষকও ছিলেন। অল্প বয়সে গবেষক হওয়ার অভিজ্ঞতাটা দারুণ।
: নারী দিবসে ইয়াং জেনারেশন বিশেষ করে নারীদের উদ্দেশে কিছু বলুন।
নাজনীন আহমেদ: প্রত্যেককে অনেক বড় স্বপ্ন দেখতে হবে। আর স্বপ্নটা যেন অনেক বড় হয়। আমি স্বপ্ন দেখব অনেক বড়। সেটা সম্ভব না অসম্ভব, আগে ভাবার দরকার নেই। আমি কি হতে চাই সেটা আগে ঠিক করতে হবে। সেই চিন্তার সময় আমি মেয়ে না ছেলে, আমি গরিব না ধনী- এসব ভাবার দরকার নেই। আমি স্বপ্নের কত কাছে যেতে পারি এবং সেটার কাছে যেতে যে পরিমাণ পরিশ্রম প্রয়োজন তা করার মানসিকতা থাকতে হবে। ছেলে বা মেয়ে যেই হোক; আমি বলছি না যে, পরিশ্রম না করলে সে বড় হবে না। কিন্তু স্বপ্ন না দেখলে সে কখনোই বড় হবে না। সবার ক্ষেত্রে স্বপ্নটা হতে হবে অনেক বড়।
: বড় স্বপ্ন দেখার সাহস পেয়েছিলেন কীভাবে?
নাজনীন আহমেদ: ছোটবেলায় আমি খুবই বাউন্ডেলে স্বভাবের ছিলাম। তখন পড়াশোনা খুব একটা করতে চাইতাম না। সব সময় খেলাধুলা করতাম। ক্লাস টু বা থ্রি পর্যন্ত আমার রোল একেবারে শেষের দিকে ছিল। ক্লাস থ্রিতে আমি ঢাকা থেকে খুলনায় ভর্তি হই। তখন আমার সহপাঠীরা ঢাকা থেকে এসেছি ভেবে খুব দাম দিতো। আমারও তখন মনে হলো এখানে রেজাল্ট ভালো করাটা মানসম্মানের বিষয়। সেই থেকেই সিরিয়াসলি পড়াশোনা শুরু করলাম। পরে দেখলাম তা বেশ ভালো কাজে আসছে। সিক্স থেকে শুরু করে মাস্টার্স ছাড়া সব পরীক্ষায় আমি অনেক ভালো করেছি। একপর্যায়ে একটা জেদ কাজ করতো যে, আমাকে ফার্স্ট হতেই হবে। এছাড়া বড় স্বপ্ন দেখার ক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকাও ছিল। আমার বাবা কলেজে অধ্যাপনা করতেন। তিনি ঢাকা কলেজের প্রিন্সিপাল হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। আমাকে তিনি খুব উৎসাহ দিতেন। গৃহিণী মাও খুব উৎসাহ দিতেন।
: বাংলাদেশে নারীদের বর্তমান অবস্থান এবং এ নিয়ে মূল্যায়ন করুন।
নাজনীন আহমেদ : কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে নারীদের অংশগ্রহণ আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। অনেক মেয়ে এখন ব্যবসার সঙ্গেও যুক্ত হচ্ছেন। বিশেষ করে বিভিন্ন অনলাইন ব্যবসায় নারীদের আগ্রহ বেশি দেখা যাচ্ছে। তবে এসব ক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ আরো বাড়াতে হবে। এখনও নারীদের একটা বড় অংশ ক্যারিয়ারকে সেকেন্ডারি ভাবে। এ মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমি বলতে চাই, এক্ষেত্রে সমঝোতার ভিত্তিতে কাজ করা উচিত। ক্যারিয়ারই সব, পরিবার কিছু নয়- এটা যেমন নয়; একইভাবে ক্যারিয়ার গড়তে পরিবারকে ঠিকমতো সময় দিতে পারব না- এমনটিও ঠিক নয়। আমি সব সময় মনে করি, এ দেশের মেয়েরা এখনও বড় স্বপ্ন দেখতে পারে না। আমি সব সময় বলি, আমরা যদি দেশকে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে নিতে চাই তাহলে সব ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান অংশগ্রহণ প্রয়োজন। কর্মক্ষেত্রে বা অর্থনৈতিকক্ষেত্রে এই অংশগ্রহণটা নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমানে বাংলাদেশে যুবশক্তির হার মোট জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ। এই যুবশক্তি ঠিকমতো শিক্ষা অর্জন ও ট্রেনিং পেলে আগামী ২০ বছরে তারা বাংলাদেশকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে। আশার বিষয়, এই যুবশক্তির অর্ধেকই হচ্ছেন নারী।
: নারীদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার পেছনে পরিবারের ভূমিকা অপরিসীম। এ বিষয়ে কিছু বলুন।
নাজনীন আহমেদ: টেকসই উন্নয়নের ক্ষেত্রে শিল্পকারখানায় কমপ্লায়েন্স অপরিহার্য। কমপ্লায়েন্স কারখানায় যারা কাজ করেন, তারা মানসম্পন্ন পরিবেশে কাজ করতে পারেন। শ্রমিকের সব সুযোগ-সুবিধা সেখানে নিশ্চিত করা হয়। ফ্যামিলি কমপ্লায়েন্সের ক্ষেত্রেও তাই। ফ্যামিলি কমপ্লায়েন্স মানে একটি আদর্শ বা অধিকার-সচেতন পরিবার, যেখানে সব সদস্য নারী-পুরুষভেদে কা্রও অধিকার খর্ব না করে জীবনযাপনের সমান সুযোগ অর্জন করবেন। সবক্ষেত্রেই তারা সমান অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা পাবেন, কারও প্রতি পক্ষপাতিত্ব হবে না। পরিবারের মধ্যে কোনো ধরনের প্রভুত্ব থাকবে না। সবার মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ বজায় থাকবে।
: আমাদের দেশে নারীরা কি পারিবারিকভাবে সমঅধিকার ভোগ করেন?
নাজনীন আহমেদ: সংবিধান অনুযায়ী নারী-পুরুষের সমান অধিকার প্রাপ্তির কথা উল্লেখ থাকলেও সামাজিক ও ঐতিহ্যগতভাবে প্রতিটি পরিবারে একজনকে কর্তা হিসেবে দেখা হয়। আর অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেই কর্তা হন একজন পুরুষ। আমাদের দেশে পরিবারে নারী-পুরুষের সমান অধিকারের বিষয়টি চর্চা তো হয়-ই না, এমনকি বিষয়টি অপ্রয়োজনীয় বলেও মনে করা হয়। এজন্য পরিবারে নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্যগুলো স্পষ্ট।
: বৈষম্যগুলো কোথায় ও কীভাবে ঘটে?
নাজনীন আহমেদ: ফ্যামিলি কমপ্লায়েন্স বিষয়টি এখানে চর্চা হয় না বললেই চলে। পরিবারে যিনি গৃহিণী, বিশেষ করে মধ্যবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত পরিবারের, তিনি দিনরাত কায়িক-মানসিক পরিশ্রম করছেন। অথচ গৃহিণীদের কাজের কোনো স্বীকৃতি নেই। কর্মজীবী নারীদের ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটে। দেখা যায়, পুরুষ বাইরে কাজ শেষে ঘরে এসে অবসর সময় কাটান। খুব বেশি হলে সন্তানদের পড়াশোনার খোঁজখবর নেন। কিন্তু নারীকে বাইরের কাজ শেষ করে সন্তান পালনসহ ঘরের সব কাজ করতে হয়। নারীর কোনো অবসর বা ছুটি নেই। এমনকি ছুটির দিনেও ছুটি নেই। খাবারের ক্ষেত্রে দেখা যায়, দিন শেষে নারী সবার পরে খাচ্ছেন। গবেষণায় দেখা গেছে, দরিদ্র পরিবারের অন্য সদস্যদের তুলনায় নারীরা বেশি অপুষ্টিতে ভুগছেন। তার মানে, নারীরা এখানেও উপেক্ষিত। ধনী পরিবারের ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটে। আমরা খেয়াল করি না পরিবারের নারী সদস্যটি পুষ্টিকর খাবার খাচ্ছেন কিনা। তার জন্য যথেষ্ট খাবার আছে কিনা। খাবারের বণ্টন থেকে শুরু করে সব বিষয়ে বৈষম্য আছে। দেখা যায়, একই পরিবারের ছেলেকে ব্যবসার জন্য পুঁজি দেয়া হলেও মেয়েকে দেয়া হয় না। হয়তো মেয়েটির উৎপাদনশীলতা বেশি। সে ব্যবসা করলে বেশি ভালো করতে পারতো। এ বৈষম্য থাকলে তাকে আমরা আদর্শ পরিবার বলতে পারি না। এতে যোগ্যতার সর্বোচ্চ ব্যবহার হয় না।
: পরিবারে সমঅধিকার কীভাবে নিশ্চিত করা যাবে? এজন্য কি আইন করা প্রয়োজন?
নাজনীন আহমেদ: সবকিছু ছকে বেঁধে বা আইন করে করতে হবে- বিষয়টি তেমন নয়। প্রথমত নারী-পুরুষ সবার মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। এজন্য আমরা যখন নারী অধিকার নিয়ে কথা বলব, তখন ফ্যামিলি কমপ্লায়েন্স বিষয়টি তুলে নিয়ে আসতে হবে। এর প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জানাতে হবে। সরকার নারী উন্নয়ননীতি বাস্তবায়নে অনেক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে, সেখানে ফ্যামিলি কমপ্লায়েন্স বিষয়টির উল্লেখ থাকতে হবে। বৃহৎ পরিসরে পরিবারে সমঅধিকারের বিষয়টি আলোচিত হলে এর একটি ইতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করবে। তাছাড়া স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। বিজ্ঞাপন, নাটকের মাধ্যমেও এ বৈষম্য দূর করতে কাজ করা যায়।
: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
নাজনীন আহমেদ: আপনাকেও ধন্যবাদ।