ব্যবসার ঝোঁক তার টিনএজ বয়স থেকে। ১৭ বছর বয়সে তিনি দ্য ড্রিম ইনস্টিটিউট নামে সামার স্কুলিং চালু করেন। চতুর্থ , পঞ্চম ও ষষ্ঠ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে তিনি মাথাপিছু ১৫০ ডলার আদায় করতেন। জোনাথন সুইফটের গালিভারস ট্র্যাভেলস থেকে আরম্ভ করে ব্ল্যাক হোল –বিষয়ক নানা নিবন্ধ ছিল ড্রিম ইনস্টিটিউটের সিলেবাসে।
ডি .ই .শ ’র ভাইস প্রেসিডেন্ট জেফ বেজোস সিদ্ধান্ত নেন , তিনি অনলাইনে একটি দোকান খুলবেন। যেই ভাবা সেই কাজ। ১৯৯৪ সালে তিনি চাকরি ছাড়েন। অনলাইনে দোকান হবে কিন্তু সেখানে কী বিক্রি হবে , তিনি তা স্থির করতে পারছিলেন না। নানা ভাবনা –চিন্তার পর তিনি ভার্চুয়াল দোকানে বিক্রির জন্য বইকেই বেছে নেন। এ সিদ্ধান্তের পেছনে বইয়ের প্রতি আসক্তির কোনো বিষয় ছিল না। জেফ বুঝেছিলেন , অনলাইনে বই বিক্রি করে কেউ না কেউ প্রচুর অর্থ কামাতে পারেন। কাজেই তিনি এ সুযোগ নিলে সমস্যা কি ? তাছাড়া বই সবার চেনা পণ্য। বই ক্যাটালগিং সহজ। হালকা পণ্য হওয়ায় বই সংরক্ষণ ও জাহাজীকরণের কাজটিও কম আয়াসে করা সম্ভব ।
কয়েকজন কর্মীকে নিয়ে জেফ তার বাড়ির গ্যারেজে নতুন কোম্পানির সফটওয়্যার ডেভেলপের কাজ শুরু করেন। বাড়ির গ্যারেজে তার নানা কাণ্ডকীর্তির বিষয়ও নতুন ছিল না। হামাগুড়ি দেয়ার বয়স পেরোতেই তিনি প্রায়ই নিজের খেলনাগুলো স্ক্রু ড্রাইভার দিয়ে খুলে ফেলতেন। জেফের নানা লরেন্স প্রেস্টন কাজ করতেন ডিফেন্স অ্যাডভান্সড রিসার্চ প্রজেক্টস এজেন্সিতে (আরপা )। টেক্সাসে নানার র্যাঞ্চে বেড়াতে গেলে জেফ সেখানকার যন্ত্রপাতি মেরামত করতেন। মিয়ামির বাড়ির বিভিন্ন রুমে টেপ ও তার সংযুক্ত করেও তিনি বিভিন্ন কারিগরি কসরত চালাতেন।
সান মাইক্রোসিস্টেমসের তিনটি কম্পিউটার নিয়ে জেফ ও তার কর্মীরা সফটওয়্যার ডেভেলপের কাজ করতেন। কিছুদিন পর তিনি দুই বেডরুমের একটি বাড়িতে কার্যক্রম স্থানান্তর করেন। একপর্যায়ে টেস্ট সাইট ডেভেলপ হলে ১৯৯৫ সালের ১৬ জুলাই ৩০০ বন্ধুকে বেটা টেস্টের ইনভাইটেশন পাঠান জেফ।
তিনি তার সাইটের নামকরণ করেন অ্যামাজন। পৃথিবীর দীর্ঘতম নদীর নাম বেছে নেয়ার কারণ হলো নিজের উচ্চাভিলাষের জানান দেয়া । তাছাড়া অ্যামাজন নামটি যেহেতু অ্যালফাবেটিক্যাল অর্ডারে আগে থাকে , তাই অনলাইন রিটেইলার তালিকায় এটি উপরেই থাকার কথা ।
নিজের কোম্পানির ঠিকানা হিসেবে জেফ বেজোস সিয়াটলকে বেছে নেন। কারণ ওই শহরে মাইক্রোসফটের অফিস এবং সেখানেই সবচেয়ে দক্ষ কর্মী পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। গোড়ার দিকে মুষ্টিমেয় সংখ্যক ক্রেতা জেফের অফিসে ফোন করে নিজেদের কার্ড –সংক্রান্ত তথ্য দিতেন এবং সেভাবেই বইয়ের মূল্য পরিশোধ হতো ।
অ্যামাজনকে প্রথম ব্রেক দেন ইয়াহুর জেরি ইয়াং। তিনি জেফের সাইটটিকে ইয়াহুর ‘হোয়াট ’স কুল ?’ লিস্টিংয়ে অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব দেন। ইয়াহুতে লিস্টিংয়ের পরের সপ্তাহ থেকে অ্যামাজনের উত্থান হয় রকেট গতির। জেফ ও তার কর্মীদের রাত জেগে বই মোড়কীকরণ করতে হয়। প্রথম মাসে অ্যামাজন ক্রেতাদের অর্ডার অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও ৪৫টি দেশে বই পাঠায়। দ্বিতীয় মাসেই অ্যামাজনের বিক্রি প্রতি সপ্তাহে ২০ হাজার ডলার ছাড়িয়ে যায় ।
জেফ তার কোম্পানির ১ কোটি ২ লাখ শেয়ার কেনেন। প্রতিটি শেয়ারের দাম ছিল এক সেন্টের এক –দশমাংশ। ১৯৯৭ সালে অ্যামাজন পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হলে প্রতিটি শেয়ারের দাম ওঠে ১৮ ডলার। ৩৩ বছর বয়সী জেফ এক সপ্তাহেই ১৮ কোটি ৪০ লাখ ডলারের মালিক হন। অ্যামাজনের একেকটি শেয়ারের দাম এখন ৮০০ ডলার ছাড়িয়ে গেছে। কাজেই জেফ বেজোসের সম্পদের কতগুণ প্রসার ঘটেছে , তা সহজেই অনুমেয়।
বিল গেটসের মতোই একচেটিয়াত্ব ও আধিপত্যের পূজারি জেফ বেজোস। তিনি চাইতেন বাজারে অনতিক্রম্য অবস্থান। এজন্য বাজার –অংশ দখলের কাজটি গুরুত্বপূর্ণ। বাজার দখল হলে মুনাফা আপনা আপনিই বাড়বে। কোম্পানির প্রসারের স্বার্থে নিজের ঢোল নিজে পেটানোর কাজটিও জরুরি। গোড়ার দিকে জেফ বেজোস তার হাতে ১০ লাখ বই মজুদের দাবি করতেন। আদতে ওসব বই ছিল বিভিন্ন ডিস্ট্রিবিউটরের গুদামে ।
প্রথানুগত দোকানের তুলনায় অ্যামাজনে কেনাকাটার সুবিধা তুলে ধরতে জেফ চেষ্টার কমতি রাখেননি। এক সময় তিনি বার্নস অ্যান্ড নোবল স্টোরের সামনে মোবাইল বিলবোর্ডও রান করিয়েছেন। এসব বিলবোর্ডে স্লোগান থাকত , ‘কাঙ্ক্ষিত বইটি কি খুঁজে পাচ্ছেন না ?’। বার্নস অ্যান্ড নোবলের মতো স্টোরকে হারাতে ক্রেতাদের দ্রুত বই কেনার সুযোগ দেয়া জরুরি ছিল। জেফ বেজোস এজন্য অ্যামাজনের ওয়েবসাইটে ওয়ান ক্লিক ব্যবস্থা সংযোজন করেন। তিনি এ ব্যবস্থাটি পেটেন্ট করিয়ে নেন। ১৯৯৯ সালে বার্নস অ্যান্ড নোবলের ওয়েবসাইটে ওয়ান ক্লিক ‘এক্সপ্রেস লেন ’ সংযোজন করা হলে জেফ প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে কপিরাইট লঙ্ঘনের অভিযোগে মামলা ঠুকে দেন। আদালতের বাইরে ওই মামলা নিষ্পত্তি হয় ।
অ্যামাজনের উত্তরোত্তর প্রসারের সুবাদে জেফ বেজোস ১৯৯৯ সালে টাইম ম্যাগাজিনের বর্ষসেরা ব্যক্তিত্ব নির্বাচিত হন। কিন্তু ডটকম বুদবুদ বিস্ফোরণ হওয়ায় পরের বছরই অ্যামাজনের লোকসান হয় ৭২ কোটি ডলার। টাইম ম্যাগাজিন সেবার তার প্রোফাইলে পরিচয় লেখে ‘বস অব অ্যামাজন ডটকন ’। জেফ ওই উপহাস ভোলেননি। অ্যামাজনের ব্যবসাকে তিনি চারদিকে বিস্তারের উদ্যোগ নেন। ক্রমে ক্রমে বিভিন্ন রিটেইলারের সঙ্গে তিনি পার্টনারশিপে জড়ান। এভাবে সিডি –ভিডিও , জামাকাপড় , ইলেকট্রনিকস , খেলনাসহ বিভিন্ন সামগ্রী তিনি অ্যামাজনে বিক্রি করতে থাকেন। এভাবে বাজারে অংশ বৃদ্ধির মাধ্যমে অ্যামাজন দিন দিন শক্তিশালী ও বড় হতে থাকে। ১৯৯৫ সালে অ্যামাজনের বিক্রি ছিল বার্ষিক ৫ লাখ ১০ হাজার ডলার। ২০১১ সালে কোম্পানিটির বিক্রি দাঁড়ায় ১ হাজার ৭০০ কোটি ডলারে ।
রিটেইলিংয়ে জেফ বেজোসের সাফল্য ঈর্ষণীয়। কিন্তু নিজের ক্যারিয়ারে গ্ল্যামার যোগ করতে তার দরকার ডে জবের বাইরে নতুন কিছু। তার স্বপ্ন ছিল বিজ্ঞানী হওয়া। কিন্তু প্রিন্সটনে ভর্তির পর তাকে হতাশ হতে হয়। তিনি বুঝতে পারেন , বিজ্ঞানী হয়ে খুব বেশি সফলতা পাওয়া তার বরাতে নেই। এজন্য তিনি ফিজিক্স ছেড়ে কম্পিউটার প্রোগ্রামিংকে মেজর হিসেবে বেছে নেন। ১৯৮৬ সালে তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে কম্পিউটার সায়েন্স ও ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি অর্জন করেন ।
স্টারট্রেকের পাঁড় ভক্ত জেফ কৈশোরেই মহাকাশ ভ্রমণের মোহে আচ্ছন্ন হয়েছিলেন। ব্যবসায়িক ক্যারিয়ারে প্রতিষ্ঠার পর জেফ বেজোস তার কৈশোরক স্বপ্ন ছোঁয়ার উদ্যোগ নেন। ২০০০ সালেই তিনি বিলিয়নেয়ার ও মহাকাশ উদ্যোক্তা রিচার্ড ব্র্যানসনের সঙ্গে কথা বলেন। জেফ এ সময় পৃথিবীর কক্ষপথে ২০ –৩০ লাখ মানুষের জন্য হোটেল ও বসতি প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন তুলে ধরেন। রিচার্ড ব্র্যানসনের সঙ্গে তিনি যৌথ উদ্যোগে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে মহাকাশ ভ্রমণ শুরুর কথাও আলোচনা করেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৭ সালে জেফ বেজোস সিয়াটলভিত্তিক অ্যারোস্পেস কোম্পানি ব্লু অরিজিনে বিনিয়োগের ঘোষণা দেন। বইয়ের ব্যবসায় অ্যামাজনের অগ্রবর্তী অবস্থান ধরে রাখতে ২০১১ সালে কিন্ডল ফায়ার বাজারে আনেন। ২০১৩ সালে ২৫ কোটি ডলারে ওয়াশিংটন পোস্ট কেনার খবর জানিয়ে জেফ বেজোস মিডিয়া বিশ্বকে চমকে দেন ।
সূত্র: জন ক্যাম্পফনার রচিত দ্য রিচ বই থেকে সংগৃহীত।
Sharing is caring!