রেল দুর্ঘটনা রোধে ছয় তরুণের উদ্ভাবন

রেল দুর্ঘটনা রোধে ছয় তরুণের উদ্ভাবন

  • লিডারশিপ ডেস্ক

ছয় তরুণ—এম.এ হাসান খান, রেফায়েত চৌধুরী, নাজিবুর রহমান, হুমায়ুন কবির, শাহ সুফিয়ান মাহমুদ চৌধুরী ও সারোয়ার রশীদ। সবাই পড়াশোনা শেষ করে চাকরি বা ব্যবসা করছিলেন। কিন্তু সবারই নিজে থেকে কিছু করার তাগিদ ছিল। তাই অন্যের প্রতিষ্ঠান ছেড়ে ২০১৫ সালে নিজেরা গড়লেন, ‘উইভার ইনোভেশনস’।


‘সাবধান! ট্রেন আসছে, সাবধান! ট্রেন আসছে। আপনারা সবাই নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করুন। মনে রাখবেন সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশি। সাবধান! সাবধান! সাবধান! -জনস্বার্থে বাংলাদেশ রেলওয়ে’- লাউড স্পিকারে উঁচু গলায় ঘোষণা। সঙ্গে এলইডি পর্দায় ভাসবে এই বার্তা। লালবাতি সতর্ক সংকেত দিতে থাকবে। নামিয়ে দেওয়া হবে লেভেল ক্রসিং গেট।

রেললাইনের ওপর বা ক্রসিং এর কাছাকাছি থাকা মানুষদের সতর্ক করতে ছয় তরুণ তৈরি করেছে এই ডিজিটাল ভয়েস এলার্ট সিস্টেম। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের কর্তাদের এই উদ্যোগের কথা জানালে তারাও সায় দেয়। এরপর উত্তরার একটি রেলক্রসিংয়ে ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পরীক্ষামূলকভাবে চালু হয়।

ছয় তরুণ—এম.এ হাসান খান, রেফায়েত চৌধুরী, নাজিবুর রহমান, হুমায়ুন কবির, শাহ সুফিয়ান মাহমুদ চৌধুরী ও সারোয়ার রশীদ। সবাই পড়াশোনা শেষ করে চাকরি বা ব্যবসা করছিলেন। কিন্তু সবারই নিজে থেকে কিছু করার তাগিদ ছিল। তাই অন্যের প্রতিষ্ঠান ছেড়ে ২০১৫ সালে নিজেরা গড়লেন, ‘উইভার ইনোভেশনস’।
তরুণদের একজন সুফিয়ান বলেন, তখন ঢাকায় খুব রেল দুর্ঘটনা হচ্ছিল এই বিষয়ে কী করা যায় তা নিয়ে ভাবতে শুরু করেন তাঁরা। এই দলের দুইজন, সুফিয়ান আর সারোয়ার ছিলেন তড়িৎ এবং ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী। তাঁরা মিলে এমন একটি ব্যবস্থার নকশা করলেন যা দিয়ে রেল দুর্ঘটনার হার কমিয়ে আনা সম্ভব। আর অন্য চারজন লেগে পড়লেন নকশা বাস্তবায়নের ব্যবস্থায়।

শুরুতে ছয়জন ঢাকার বিভিন্ন রেলগেট ঘুরে দেখেন। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এম এ হাসান বলেন, ‘কোথাও গিয়ে শুনি ৩০ (এটা ঠিক না) মিনিট আগে, কোথাও পাঁচ মিনিট আগে সিগন্যালের গেট ফেলা হয়। ট্রেন আসার কতক্ষণ আগে গেট বন্ধ হবে এর কোনো বাঁধাধরা নিয়ম নেই। তাই লোকজন অধৈর্য হয়ে যায়। সিগন্যাল মানতে চায় না।’ সিদ্ধান্ত হলো, যদি সময়টা নির্দিষ্ট করে দেওয়া যায় যে, ঠিক কখন ট্রেন আসছে আর সে বিষয়ে যদি আশপাশে সবাইকে সতর্ক করা যায় তবে হয়তো কাজ হবে।

প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে একটি ধারণাপত্র (কনসেপ্ট পেপার) তৈরি করে তাঁরা দেখা করলেন রেলপথ মন্ত্রীর সঙ্গে। মন্ত্রনালয়ের পক্ষ থেকে ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে উত্তরা ৪ নম্বর সেক্টরের জালাল উদ্দিন আহমেদ স্মরণী সংলগ্ন রেলক্রসিং-এ ‘ডিজিটাল ভয়েস এলার্ট সিস্টেম ফর লেভেল ক্রসিং’ প্রকল্প পরীক্ষামূলকভাবে বাস্তবায়নের সুযোগ পেয়ে যান তারা। প্রায় এক বছরের চেষ্টায় দাঁড়িয়ে যায় প্রকল্পটি। ট্রেন দুই কিলোমিটার দূরে থাকতেই সেখানে স্থাপিত সেন্সর থেকে বেতার সংকেত পৌঁছে যাবে ক্রসিং এর গেটে। তারপর সচল হয়ে যাবে পুরো এলার্ট সিস্টেম। ক্রসিং এ ট্রেন ঢোকার পর সেটা নিজে থেকেই বন্ধ হয়ে যাবে। নকশা থেকে শুরু করে বিশেষ সফটওয়ার, যন্ত্রাংশগুলো জুড়ে সিস্টেমটিকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেওয়া সবই হয়েছে বাংলাদেশে।

গতকাল সোমবার সেই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, রেলক্রসিং এর ওপর ‘ডিজিটাল ভয়েস এলার্ট সিস্টেম ফর লেভেল ক্রসিং’ লেখা বোর্ড ঝুলছে। সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে এলইডি স্ক্রলবার, স্পিকার আর লালবাতি। পরীক্ষামূলকভাবে কিছুদিন চালু থাকার পর এখন সেটি বন্ধ আছে।

গেটম্যান মোখলেছুর রহমান বলেন, এই ব্যবস্থা পুরাপুরি চালু হলে খু্ব সুবিধা হবে। তিনি বলেন, ‘অখন বাতি দেইখা বুঝন লাগে ঢাকায় ট্রেন ঢুকবো না বাইর হইবো। মধ্যে অনেকদিন সিগন্যাল বাতি নষ্ট আছিল। তখন আন্দাজে কাজ করছি। এই মেশিনে তো গাড়ি দুই কিলোমিটার দূরে থাকলেই সিগন্যাল দেয়। আমার বাঁশির আওয়াজ তো বেশি দূরে যায় না। এইডার আওয়াজ অনেক দূর থেইকাও শোনা যায়। ’

এলাকার বাসিন্দারাও স্বাগত জানিয়েছেন এই ব্যবস্থাকে। এখানকার অধিবাসী মো. ইউসূফ বলেন, ট্রেন আসার আগে আগে এই যন্ত্র সেটা বলে দিচ্ছে। ব্যবস্থাটা খুবই সুবিধাজনক ও নিরাপদ।’

রেল কর্তৃপক্ষ এসে এই ডেমো প্রজেক্ট ইতিমধ্যে দেখে গেছেন। এই প্রকল্প নিয়ে এ বছর ডিজিটাল উদ্ভাবনী ও জেলা ব্র্যান্ডিং মেলায় শ্রেষ্ঠ তরুণ উদ্ভাবকের পুরষ্কারেরও পেয়েছে এই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রেফায়েত চৌধুরী। সুফিয়ান বলেন, ‘আমরা রেল মন্ত্রণালয় থেকে প্রকল্প প্রস্তাব জমা দিতে বলা হয়েছে। এই প্রকল্পের পুরো নকশা বাস্তবায়নের জন্য আরো কিছু সেন্সর লাগবে যা খুব ব্যয়বহুল। সরকারি সাহায্য ছাড়া সম্ভব হবে না।’

সূত্র: প্রথম আলোfavicon59-4

Sharing is caring!

Leave a Comment