টাকা হারানোটাই ছিল জীবনের টার্নিং পয়েন্ট

টাকা হারানোটাই ছিল জীবনের টার্নিং পয়েন্ট

  • লিডারশিপ ডেস্ক

মো. সবুর খান। ড্যাফোডিল গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা। বাংলাদেশের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতের সফল ব্যবসায়ীদের মধ্যে অন্যতম। প্রতিভা, মেধা, ব্যবসায়িক দক্ষতা পরিশ্রম আর দূরদর্শিতা দিয়ে সেই ১৯৯০ সাল থেকে একের পর এক গড়ে তুলে চলেছেন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, স্কুল, কলেজ, একাডেমী, আইটি প্রতিষ্ঠানসহ তিনি এখন ১৬টি প্রতিষ্ঠানের মালিক। ‘উইটসা’ মেরিট এওয়ার্ড, ওয়ার্ল্ড কোয়ালিটি কংগ্রেস এওয়ার্ড, ওয়ার্ল্ড হিউম্যান রাইটস পদক, ফিনান্সিয়াল মিরর বিজনেস পুরস্কারসহ তার রয়েছে অনেক সম্মাননা।


অন্যান্য দেশের সাথে তুলনা করলে নতুন ব্যবসার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটটা কেমন দেখছেন?

আসলে ব্যবসা প্রতিনিয়তই পরিবর্তিত হচ্ছে। একটা সময় কিন্তু আমরা চিন্তাও করতে পারি নাই যে মানুষ পানি কিনে পান করবে। ১৯৯৮ সালে যখন আমি জাপানে যাই তখন টিস্যু পেপার দেখে আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। আমি যদি এখন এ কথা বলি তাহলে অনেকে ভাববে যে কি আজব কথা বলছি। ৯০ বা ৯১ সালে যখন আমি সিঙ্গাপুরে যাই তখন পানির বোতল কিনে নিয়ে আসতাম। আর এখন সেখান থেকে পানি কিনে নিয়ে আসি তাহলে লোকে ভাববে আমার মাথায় সমস্যা আছে। এজন্য বলছি যে প্রতিনিয়তই বিভিন্ন সুযোগ আসছে। সেটা আসতেই থাকবে। আজকে আপনি পরিবর্তন ডটকমে চাকরি করছেন। আজ থেকে ১০ বছর আগে কি কেউ চিন্তা করতে পেরেছিল যে অনলাইনে একটা নিউজ পোর্টাল হতে পারে এবং এই অনলাইন পোর্টালগুলো ভালো ভূমিকা রাখতে পারে? কখনই কেউ চিন্তাও করতে পারেনি।

কীভাবে নতুন উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করবেন?

উদ্যোক্তারা যেহেতু নতুন তাই উদ্যোগটাও নতুন নিতে হবে। নতুন ব্যবসা, যে ব্যবসা আর কেউ চিন্তা করে নাই। হয়তো এখন কেউ বলতে পারে কেউ চিন্তা করে নাই সেটা আমি কিভাবে চিন্তা করব? সেই চিন্তাটাই হল তার সুযোগ। আপনার পিছনে একটা স্ট্যান্ডের ভেতর মোমবাতি দেখা যাচ্ছে, এই যে ফুলের মত করে মোমবাতি তৈরি করেছে এটাওতো একটা আইডিয়া। এই আইডিয়াগুলো কে কোথায় কিভাবে নিয়ে আসবে সেটা আমি আপনি কেউ জানি না। আজকে পৃথিবীটা চলছেই আইডিয়ার উপরে। নতুন নতুন আইডিয়া আসবে। তরুণ বা নতুনদের প্রতি আমার মূল পরামর্শ থাকবে যে নতুন আইডিয়া নিয়ে আসা। নতুন কনসেপ্ট তৈরিতে কাজ করা।

প্রত্যেকটা ব্যবসায় চ্যালেঞ্জ বা প্রতিবন্ধকতা আসে। আপনার ব্যবসার শুরুর দিকে বা মাঝে বা কখনো এরকম চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছেন, যেটা আপনাকে হতাশাগ্রস্ত করেছিল?

আসলে সব সময় আমি যে সমস্যার সম্মুখীন হই সেটা হল ম্যান পাওয়ার, প্রফেশনাল ও যোগ্য লোকের অসম্ভব অভাব। যেটা বলা যায় যে আমাকে এখনো কষ্ট দিচ্ছে। যারা আসলে কথায়, কাজে, মনে-প্রাণে মনোযোগী থাকবে একটা কাজ শেষ করার জন্য। এটার খুব অভাব, আসলে আমি বলব এটা আসলে দুর্ভাগ্য। ছাত্র-ছাত্রীরা সার্টিফিকেটের উপর আগ্রহ বেশি, তারা কর্মের প্রতি বেশি আগ্রহী নয়।

আপনার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট কোনটা ছিল?

টার্নিং পয়েন্ট অনেকগুলোই বলা যায়। তবে প্রথমটা যদি বলি, ১৯৯৩ সালে একটা দুর্ঘটনায় আমার সব ক্যাশ টাকা ছিনতাই হয়ে যায়। ওই টাকা ছিনতাই হওয়াটাই জীবনের টার্নিং পয়েন্ট ছিল।

কি পরিমাণ টাকা ছিল?

১০ লাখ টাকা। এলসি করার জন্য আমি ব্যাংক থেকে টাকাগুলো তুলেছিলাম। আমার মাথায় এমনভাবে পিস্তল ঠেকানো হল যে টাকাটা দেওয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। টাকাটা চলে যাওয়ার পরে আমি ধরেই নিয়েছিলাম জীবনে আর দাঁড়াতে পারবো না, সম্ভবত আমি নিঃস্ব হয়ে গেলাম! ক্যাশ টাকা বলতে ওইটাই ছিল। আর ব্যবসাটা ছিল। টাকাটা হারানোর পর আমার উপলব্ধি হল যে টাকা হারিয়েছি, কিন্তু সম্মানতো হারায়নি, শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ হারায়নি, আমার সুনাম হারায়নি, আমার নেটওয়ার্ক হারাইনি। আমারতো সবকিছুই আছে, শুধু কিছু কাগজ আমার কাছ থেকে চলে গেল। তখন ভাবলাম আবার চেষ্টা করি, আবার ঘুরে দাড়াই, হয়তো আবার এটা অর্জন করতে পারব। আসলে ওই দাঁড়ানোটাই ছিল আমার টার্নিং পয়েন্ট। নতুন করে আবার টাকা সংগ্রহ করতে গিয়ে বিভিন্ন জনের কাছ থেকে টাকা ধার নেই। তখন কিন্তু আমার কাছের মানুষগুলো সবাই আমাকে সহযোগিতা করে। বলা যায় যে, আমি হারালাম ১০ লাখ টাকা কিন্তু ১৫ দিনের মাথায় আমি ২১ লাখ টাকা নেট প্রফিট করি। তার মানে ওই টাকাটা যদি না হারাতো, আঘাতটা যদি না পেতাম তাহলে আত্মবিশ্বাসের সাথে ঘুরে দাঁড়াতে পারতাম না। এই টাকাটা প্রফিট করার পর থেকেই মনে করেছিলাম যে জীবনে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হবে না। রিস্ক আমি নেবো সেই রিস্কে কখনো আমি হারবো কখনো জিতবো।

এত বড় একটা ক্ষতির পর আবার ঘুরে দাঁড়াতে অনুপ্রেরণা কার কাছে থেকে পেয়েছিলেন?

অনুপ্রেরণার ক্ষেত্রে ওইভাবে আমার কোনো মডেল ছিল না। আমার বাবা ব্যবসায়ী ছিলেন, কিন্তু তিনি তার ব্যবসা ভালোভাবে করতে পারেন নাই। তিনি ব্যবসা পরিবর্তন করতেন। আমরা অনেক সময় বলতাম, বাবা আপনি যেকোনো একটা ব্যবসা করেন। কারণ আপনি এটাকে ব্রান্ডিং করতে পারবেন। এতে তিনি রাগ করতেন। তিনি তখন বলতেন তোমরা যখন ব্যবসা করবা তখন বুঝবা। যে পেইন কি! তোমাদের পড়াশোনার খরচ চালাতে গিয়ে কি কষ্টটা করতে হয়! তো ওইটা আমাকে খুব হিট করতো। বলা যায় এটা আমার অনুপ্রেরণা ছিল যে আমি ব্যবসা করি এবং প্রমাণ করব বাবাকে বা আমার পরিবারকে যে আমি সঠিক ছিলাম।

বিল গেটস ঢাকায় যখন এসেছিলেন তখন তার সঙ্গে আপনার সাক্ষাত হয়েছিল, তো তার কাছে থেকে শিক্ষণীয় কিছু পেয়েছিলেন যেটা ব্যবসার ক্ষেত্রে কাজে লেগেছিল?

সেখানে আমার ভালো লেগেছিল যে সিকিউরিটি বললো তার সঙ্গে ছবি তোলা যাবে না, তাকে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না! কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছে ঠিক তা না, আমি যখন বললাম যে বিল তোমার সাথে সবাই ছবি তুলতে চাই। তখন সে বলল যে ইয়েস, অবশ্যই আসো। আবার যখন বললাম তোমার সাথে অনেকে কথা বলতে চাই, তখন সে বলল বলো না, বলো। আসলে এটা একটা ইন্ডিকেশন। যে এত বড় মাপের একজন লোক হওয়ার পরও তার সিকিউরিটি, প্রটোকল যা বুঝাতে চেয়েছিল আসলে তিনি তা না। এখান থেকে আমার কাছে মনে হয়েছে যে একজন মানুষের এই গুণটা থাকা উচিৎ। কারণ তার ব্যবসার সফলতার ক্ষেত্রে এটাও একটা কারণ, তার মানে সবাই তার সঙ্গে কথা বলতে পারে। এটাও আমার কাছে ছোট খাটো একটা শিক্ষা ছিল। আমার সঙ্গে কেউ কথা বলতে চাইলে চেষ্টা করি তার সঙ্গে কথা বলতে। সেটা যত খারাপই হোক না কেন, অনেকে সময় বিব্রত অবস্থায় ফেলে দেয়, তারপরও আমি কথা বলি। আমি মনে করি তার কাছে থেকে ছোট-খাটো একটা বার্তা আমি পেয়েছিলাম।

আপনি কি এখনো কোনো স্বপ্ন লালন করেন, যেটা পূরণ করতে পারেন নাই বা চিন্তা-ভাবনায় রয়েছে যে ভবিষ্যতে এই কাজটা করবেন যা এখনো করা সম্ভব হয় নাই?

অবশ্যই আছে। সেগুলো নিয়ে আমি কাজ করছি। আমার কিছু সোশ্যাল কমিটমেন্ট আছে, যেমন আমি চাই যারা নিপীড়িত লোক, বাবা-মা হারা পথ শিশুর মত। পথ শিশু বলতে দুই রকমের পথ শিশু রয়েছে। এক রকম পথ শিশু হল তারা পরিবর্তন চায়, একটা আশ্রয় চায়, আরেক রকমের পথ শিশু তারা আশ্রয় চাইলেও নিবে না, তাদের ওইটা অভ্যাস হয়ে গেছে। যারা আশ্রয় চায় তাদেরকে যদি একটু সুযোগ দেওয়া যায় তাহলে, ওরা অনেক বড় মাপের সমাজ পরিবর্তনে কাজ করতে পারে। এটা নিয়ে আমরা কাজ করছি। সম্ভবত এই বছরের মধ্যেই এই কাজ শুরু করতে পারবো। বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে খুঁজে নিয়ে আসবো, নিয়ে এসে তাদের থাকা, খাওয়া, পড়াশোনাসহ সব কিছুর ব্যবস্থা আমরা করব। তারা যেন সঠিক মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। তারা যেন মনে না করতে পারে তাদের বাবা-মা কেউ নেই। ওই প্রতিষ্ঠানটা তাদের মাতৃত্ব বা পিতৃত্বের পরিচয় দিবে। এটা আমার অনেক দিনের পরিকল্পনা ছিল, এখন আমি তা বাস্তবায়নের দিকে যাচ্ছি।

আপনার বিশ্ববিদ্যালয় সবার থেকে আলাদা কিভাবে ভাবেন?

আমার মনে হয় একটা বিশ্ববিদ্যালয় তখনি আলাদা হয় যখন একজন অভিভাবক তার ছেলে বা মেয়েকে পাঠানোর পর নিশ্চিন্তে থাকবেন যে, আমার ছেলে ড্রাগ নিবে না, হতাশাগ্রস্ত হবে না। কেউ না কেউ মাতৃত্ব মা পিতৃত্বের দাবি নিয়ে তার পাশে এসে দাঁড়াবে, তাদের গাইড করবেন, কাউন্সিলিং করবেন এবং সে এমন কিছু শিখবে যে চাকরির জন্য তাকে যেন চিন্তা না করতে হয়। এই জায়গায় আমরা সবার থেকে আলাদা করতে চাই। সর্বোপরি আমরা করেও ফেলেছি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ড্যাফোডিল দেওয়ার পেছনে কোনো কারণ আছে কি?

ড্যাফোডিল নাম দেওয়ার পেছনে ছোট্ট একটা কারণ আছে। উইলিয়াম ওয়ার্ডসউয়াথের একটা কবিতায় ‘ড্যাফোডিল’ নামটা ছিল। আমি যখন দশম শ্রেণিতে পড়ি তখন এই কবিতাটা মুখস্থ করেছিলাম। তো যখন আমি আমার কোম্পানির নাম খুঁজছিলাম তখন হঠাৎ করে এই নামটা মাথায় চলে আসে।

ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল বা কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন?

ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই তারা যেন শিখতে চায়, শেখার জন্যে যেন আসে। আমরা মনে-প্রাণে চাই তারা থিসিস করবে, রিপোর্ট, ইন্টার্নশিপ করবে জেনুইনলি করবে, শেখার জন্য করবে। কারণ তারা যদি প্র্যাকটিকাল কাজগুলি ভালোভাবে করে তাহলে তাদের পেছনে তাকাতে হবে না। তাদের উদ্দেশ্যে আমার পরামর্শ হবে পুঁথিগত বিদ্যা না, তাদের ভাবতে হবে সে কি শিখতে পারছে। বাস্তবতার সাথে সে কি ফাইট করতে পারছে এটা ভাবতে হবে। বিবেক, আচার-ব্যবহার, কথা বলার ভঙ্গিমা, ভদ্রতা এগুলোই আসলে সামাজিকভাবে একটা মানুষকে চিহ্নিত করে। একটা সার্টিফিকেট কিন্তু মানুষকে আইডেন্টিফাই করে না। কারণ আমি আমার সময় দেখেছি যে যারা ভালো রেজাল্ট করেছে তারা কিন্তু ভালো অবস্থানে নাই, বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা জান-প্রাণ দিয়ে পড়াশোনা করেছে, তাদের প্রতি সম্মান রেখেই বলছি, তারা ভালো অবস্থানে নাই। অপর দিকে যারা শিখতে চেষ্টা করেছে, পড়াশোনার বাইরে যারা বিভিন্ন ধরনের কাজে জড়িত ছিল তারা কিন্তু সবাই ভালো অবস্থানে আছে।

সূত্র: পরিবর্তন ডটকমfavicon59-4

Sharing is caring!

Leave a Comment