রবির অন্যরকম ভিলেজ
- লিডারশিপ ডেস্ক
রফিকুল ইসলাম রবি স্বপ্ন দেখেন, প্রতিটি জাতি-গোষ্ঠীর মানুষ থাকবে এক ছাতার নিচে। তারা ভাষার চর্চা করবে, উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে তার নিজের ভাষার উৎকর্ষ সাধনে ব্রতী হবে এবং অপরের কাছে নিজের ভাষার পরিচয় তুলে ধরবে। এই পরিকল্পনা থেকে ঘাটাইলের রফিকুল ইসলাম মধুপুরের জঙ্গলে গড়ে তুলেছেন ভাষা ও প্রকৃতির স্বকীয়তা রক্ষায় একটি অন্যরকম ভিলেজ।
বাঁশের তৈরি প্রাচীর পেরিয়ে ভিলেজের প্রবেশমুখে দাঁড়ালেই চোখে পড়বে ডানে বিশ্রামাগার আর বামে রান্নাঘর। রান্নাঘরে চলছে সকালের খাবারের প্রস্তুতি। কিশোরী বয়সের কয়েকজন রান্না করছে। দেখেই বোঝা যায় এরা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী। একটু এগিয়ে গেলেই পার্বত্য এলাকার মতো মাচান করা বাঁশের দুটি ঘর। উঁকি দিয়ে দেখা গেল প্রথম ঘরটি খালি। দ্বিতীয়টিতে কয়েকটি ছেলে বসে পড়ছে। এরাও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী। আর আশপাশে সবুজের বাগান। একটু দূরেই ঘোড়ার আস্তাবল। তার পাশেই পাওয়া গেল এই ভিলেজের কর্ণধারকে। গাছের পরিচর্যা করছেন, নাম রফিকুল ইসলাম রবি।
কথা হলো তার সঙ্গে। একটু পেছনে গিয়ে দেখালেন কীভাবে শুরু হলো এই কর্ম। রবি ইংরেজি পড়াতেন ঘাটাইলের একটা স্কুলে। গারো শিশুদের ইংরেজির পড়াতে গিয়ে তিনি বুঝলেন, বাংলার চেয়ে গারো ভাষায় বোঝালে তারা ইংরেজি সহজে বুঝতে পারে। সেখান থেকে মাথায় এলো আসলে যার যার ভাষায় যদি তাকে শেখানো যায় তাহলে তাদের শেখাটা সহজ ও অর্থবহ হয়। কাউকে শেখাতে গেলে নিজেকে তো জানতে হবে আগে। কাজেই শুরু হলো রবির গারো ভাষা শেখা। ঘাটাইল আর মধুপুর এলাকার জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে ভাষাবৈচিত্র্য আত্মস্থ করা শুরু করলেন। এই কাজ করতে গিয়ে ভাষার প্রেমে পড়ে গেলেন। শেষে শুরু করলেন দেশের বিভিন্ন ভাষা নিয়ে কাজ। পরিকল্পনা করলেন, দেশের বিদ্যমান বিভিন্ন ভাষাভাষীর মানুষের ভাষা আত্মস্থ করবেন। এ লক্ষ্যে শুরু করলেন বিভিন্ন এলাকা ভ্রমণ। কুচ ভাষা শিখতে গেলেন শেরপুর বর্ডারে। চাকমা ভাষা শিখতে হাজির হন রাঙামাটি। মারমা ভাষা শিখতে বান্দরবান। এভাবে সারাদেশ। তিনি আত্মস্থ করতে থাকলেন সেসব অঞ্চলের গাছের নামও।
যেমন একটা ঔষধি গাছকে গারোরা বলে তাকুচি, হাজংরা বলে তকলে, আমরা বলি দাতরং। খেলে দাঁত কালো হয়ে যায়। গারোরা বলে শ্যামসুয়েং, যার নাম মহানিম। প্রতিটা গাছের ২৩টি ভাষায় নাম জানেন। ভাষা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখলেন প্রকৃতি বা গাছের সঙ্গে ভাষার একটা গভীর মিল আছে। এক সময় গাছের প্রেমেও পড়লেন। বাংলাদেশের ২৩টি ভাষা শেখা হয়ে গেছে তার ইতিমধ্যে। এরপর শুরু করলেন এই ২৩টি ভাষায় গাছের নাম সংগ্রহ কার্যক্রম। বিশেষ করে ঔষধি গাছের নাম। আর্য়ুবেদিক, ইউনানী, বোটানিকেল, বাংলা, ইংরেজি নাম এবং কোন গাছ কোন পরিবারের। সঙ্গে গারো, কুচ, হাজং, টিপরা, আত্তং, নিগাম, দোয়াল, চিবক, ব্রাগ, মারমা, ত্রিপুরা, বোম, ক্ষুমি, লোসাই, পাংখুয়া- নানা ভাষায় গাছগুলোর নাম জানতে শুরু করেন।
এর সঙ্গে আরেকটি কাজ প্রথম থেকেই করছিলেন রবি। ঔষধি গাছ সংরক্ষণ। যেখানেই গেছেন সেখানকার ঔষধি গাছ নিয়ে গবেষণা করে সেগুলো সংরক্ষণের ব্যবস্থা ও নাম সংগ্রহ করেন নিয়মিত। তার জানা প্রতিটা উদ্ভিদের নাম বাংলাদেশের ২৩টি ভাষায় লিপিবদ্ধ করেছেন। যার একটা পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করেছেন, যা বই আকারে প্রকাশের ইচ্ছাও আছে রফিকুল ইসলামের।
যেখানেই গেছেন ভাষা শিখেছেন। ঔষধি গাছ নিয়ে এসেছেন। সেই সঙ্গে নিয়ে আসার চেষ্টা করছেন বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর অসহায় শিশুদের। জানা গেল, এখন আছে নয়জন। এদের মধ্যে খুমি পাঁচজন এবং ত্রিপুরা চারজন। তার ইচ্ছা, বাংলাদেশের সব জাতির মানুষ থাকবে এই ভিলেজে। তার জাতিবৈচিত্র্য রক্ষার প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত ভিলেজে ধর্মের স্বাধীনতা থাকবে। শান্তিপূর্ণভাবে যে যার ধর্ম পালন করবে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি তাদের প্রকৃতি প্রেম এবং ন্যায়বোধ শেখানো হয় নিয়মিত। এই শিশুদের মাধ্যমে তাদের ভাষা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার ইচ্ছা রবির। এলাকার পরিবেশ দূষণ বিষয়ে ওদের সজাগ রাখার চেষ্টা করছেন। কোনো রকমের প্লাস্টিকের ব্যবহার করা হয় না তার ভিলেজে।
মধুপুর এক সময় ভেষজ জগতের ভাণ্ডার ছিল। মধুপুর সেই আগের জায়গায় ফিরে যাবে একদিন- এই স্বপ্ন লালন করেন রবি। প্রায় ২৫ মাইল রাস্তার দুই পাশে বাসক গাছ লাগিয়েছেন তিনি। ভেষজ উদ্ভিদে ভরে দিতে চান অরণ্য। জৈবিক ও অর্গানিক চাষের মাধ্যমে বনের বায়োডাইভার্সিটি রক্ষা করা এবং বনের মানুষের কর্মসংস্থান করা সম্ভব বলেও মনে করেন রবি।
রবির ভিলেজে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য বায়োকেমিস্টরা আসেন পরিদর্শনে। তারা রবির সহায়তা নেন ঔষধি গাছ সম্পর্কে জানতে। রবির নৃতাত্তি্বক ভাষা সংরক্ষণ কার্যক্রম সম্পূর্ণ হলে দেশের যে কোনো ভাষাভাষী শিক্ষার্থী তার নিজের ভাষায় গাছ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবে।