বদলে দেওয়ার দৃঢ় প্রত্যয়ে জাগো
- লিডারশিপ ডেস্ক
আমার তো বাবা নেই, তুমি কি আমার বাবা হবা?—এমন একটি প্রশ্নই নাড়া দিয়েছিল করভি রাকশান্দকে। আজ থেকে ১০ বছর আগে সিলেটে জরিপ চালানোর সময় সারাদিন ঘোরাঘুরি শেষে এক পথশিশুর আবদার ছিল এটি। বলা যেতে পারে, সে আবদারই সেদিন জাগো ফাউন্ডেনের বীজ বপণ করে দিয়েছিল। এ আবদারের উত্তর খুঁজে পেতে ঢাকায় ফিরে এসে বন্ধুদের নিয়ে বনানীর কিংস রেস্টুরেন্টে বসলেন। সেখানে উপস্থিত ছিল করভির মোট ৭০ জন বন্ধু। ওদের সবার চোখেমুখেই ছিল মহৎ কিছু করার প্রত্যয়—বাচ্চাদের ইংরেজি শেখানোর, তাদের আচরণ শেখানোর। কিন্তু পরের দিন রায়ের বাজারে স্কুলের জায়গা খুঁজতে গেলে দেখা গেল ৭০ জন থেকে উপস্থিত হয়েছে মাত্র ৭ জন। এরপর রায়ের বাজারের একটি ছোটরুমে একটি সাদা বোর্ড, মার্কার, একটি কার্পেট এবং নিজেদের পকেটের ছয় হাজার টাকা নিয়ে শুরু হলো জাগোর প্রথম স্কুলের পথচলা ১৭ জন শিক্ষার্থীকে নিয়ে। সপ্তাহে ৩ দিন স্কুল হতো আর স্কুলে আসলে বাচ্চাদের আধা কেজি করে চাল দেওয়া হতো।
প্রথমদিকে স্কুলের সব খরচই হতো করভি ও তার সাতজন বন্ধুর পকেট মানি দিয়ে। এভাবেই চলে গেল ৩ মাস। এর ৩ মাস পরে বাচ্চারা এসে জানতে চাইল তারা পরবর্তী ক্লাসে কবে উঠবে, তখন করভি ও তার বন্ধুদের প্রথম মনে হলো নির্দিষ্ট পাঠ্যক্রমে স্কুল চালু করার কথা। যে ভাবনা সেই কাজ। করভি তার মায়ের কাছ থেকে স্কুলের পাঠক্রম নিয়ে আসে।
জাগোর এ পথচলা কখনই সহজ ছিল না। একটু একটু করে এগিয়ে চলা জাগো ফাউন্ডেশন সম্প্রতি পালন করল ১০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে জাগো ফাউন্ডেশন বোর্ডের সদস্যদের উপস্থিতিতে তরুণ-তরুণীদের মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মেতে থাকে পুরোটা সময়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন দৈনিক ইত্তেফাক-এর প্রকাশক ও কার্যনির্বাহী পরিচালক তারিন হোসেন, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের চেয়ারম্যান নাফিসা কামাল। রাজনৈতিক ও আলোচক রাশেক রহমানসহ আরও অনেকে।
জাগো ফাউন্ডেশান প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল অক্ষরজ্ঞানহীন শিশুদের সুশিক্ষার ব্যবস্থা ও অপুষ্ট শিশুদের পুনর্বাসন নিশ্চিত করা। আর তা পূরণের জন্য সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে পাঠদান কার্যক্রম চালু করে জাগো। বিনামূল্যে শিক্ষাদান করার পাশাপাশি প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবকাঠামো ও শিশুদের উন্নয়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছে তারা।
শিশুরা আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। এই লক্ষ্যে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের কাছে শিক্ষা পৌঁছে দিয়ে দেশে দারিদ্র্য দূর করার অঙ্গীকার করেছিলেন করভি রাখশান্দ। তাই পাঠদান কার্যক্রমের জন্য বস্তির একটি ঘর ভাড়া করেছিলেন। প্রতিদিন বস্তিতে বসবাসরত শিশুদের বাবা-মায়ের হাতে আধা কেজি করে চাল তুলে দিতেন যেন তারা তাদের সন্তানদের ওই স্কুলে পাঠায়। সংস্থাটি কাজ পরিচালনা শুরুর কিছু দিনের মধ্যেই শিশুদের পড়ালেখার প্রতি আগ্রহ হারানোর সমস্যা দেখা দিলেও পরে তা ধীরে ধীরে সমাধান হয়। শিশুগুলোর পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণে প্রথমে বুঝাই অসম্ভব ছিল শিক্ষা তাদের কীভাবে কাজে আসবে।
বর্তমানে সারাদেশে জাগোর ১৩টি স্কুল রয়েছে। যে স্কুলগুলো থেকে বিনামূল্যে ২৫০০ শিক্ষার্থীকে জাতীয় পাঠ্যক্রম অনুযায়ী ইংরেজি ভার্সনে প্রতিনিয়ত শিক্ষাদান করা হচ্ছে। পাশাপাশি জাগো’র ২৫,০০০ স্বেচ্ছাসেবী দেশের ৩২টি জেলায় অদম্য শক্তি দিয়ে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে দেশের উন্নয়নের লক্ষ্যে। শিক্ষাক্ষেত্রে জাগোর অনলাইন স্কুলের এই অভিনব শিক্ষাপদ্ধতি প্রকল্প অতি সম্প্রতি জাতিসংঘের শিক্ষাবিষয়ক, বৈজ্ঞানিক ও সাংস্কৃতিক সংস্থার (ইউনেস্কো) কিং হামাদ বিন ইসা আল-খলিফা পুরস্কার অর্জন করেছে সাফল্যের স্বীকৃতি স্বরূপ। প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের কাছে শিশুদের মাঝে ইন্টারঅ্যাক্টিভ ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে শিক্ষা প্রদান করাই জাগোর অনলাইন স্কুলের মূল উদ্দেশ্য। গ্রামীণফোন ও অগ্নি সিস্টেমসের সহায়তায় জাগো তাদের অনলাইন স্কুলের কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। ঢাকা থেকে প্রশিক্ষিত শিক্ষকরা ভিডিও কনফারেন্সিং দ্বারা শিক্ষার্থীদের বাংলা, ইংরেজি, অংক এবং পরিবেশ ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়গুলো পড়িয়ে থাকেন।
চলতি বছর ফেব্রুয়ারিতে শিক্ষা খাতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির (আইসিটি) সফল ব্যবহারের জন্য জাগো ফাউন্ডেশন অর্জন করেছে ইউনেস্কোর ‘আইসিটি ইন এডুকেশন পুরস্কার’। এর আগে ২০১৬ সালের জুলাই মাসে সরকারের আইসিটি বিভাগের অনুদান পায় সংস্থাটি। অনলাইন স্কুলের পরিধি বাড়ানোর ক্ষেত্রে আইসিটি বিভাগের সঙ্গে একটি সমঝোতা চুক্তি সইও হয় জাগোর। এ বছরই জাগো ফাউন্ডেশন দেশের উদ্যম ও শক্তিশালী যুব সমাজকে কমিউনিটির উন্নয়নে উদ্বুদ্ধ ও নিযুক্ত করার লক্ষ্যে শুরু করে ‘ভলান্টিয়ার ফর বাংলাদেশ’ নামের আরও একটি প্রকল্প। এই প্রকল্পটি হয়ে দাঁড়ায় যুব সমাজের চিন্তাচেতনা এবং দেশের উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করার প্রথম এবং বৃহৎ একটি প্ল্যাটফর্ম। সেই থেকে জাগো শুধু এগিয়ে গেছে দৃঢ় লক্ষ্য নিয়ে।