একজন নিয়াজ রহিম, একটি রহিমআফরোজ
- আবু তাহের খান
১৯৩৭ সাল—দ্বিতীয় বিশ্ববিযুদ্ধের অব্যবহিতপূর্ব পটভূমিক বছর। গৃহযুদ্ধ কবলিত স্পেন তখন হিটলারপন্থী স্বৈরতান্ত্রিক একনায়ক ফ্রাঙ্কের শাসনাধীনে। ফ্রাঙ্কোর উগ্র জাতীয়তাবাদী প্রতিরক্ষা বাহিনী কর্তৃক স্পেনের বাস্ক প্রদেশের গোয়ের্নিকায় নিক্ষপ্ত বোমায় তাৎক্ষণিকভাবে প্রায় দু হাজার মানুষ মারা গেলে, আহত হলো অরো বহু হাজার। এ হৃদয়বিদারক ঘটনার প্রতিচ্ছবি ও প্রতিবাদ হিসেবে পাবলো পিকাসো আঁকলেন বিশ্ইতিহাসের অন্যতম মহা চিত্রকর্ম গোয়ের্নিকা। সৈন্যরা পিকাসোকে ধরে নিয়ে গিয়ে এক নায়ক ফ্রাঙ্কোর সামনে হাজির করলো। চরমতম কষ্টের বোধ থেকে অঙ্কিত মানবতার জয়গানে ভরা ওই পরমতম সুন্দর চিত্রকর্ম গোয়ের্নিকার দিকে অঙ্গুলি নির্দেম করে ফ্রাঙ্কো পিকাসোকে জিজ্ঞেস করলেন, ইউ ডিড ইট—এটি তুমি করেছ? পিকাসো বললেন, নো, ইউ ডিড ইট—না, তোমরা এটি করেছ। আসলেই তো, ফ্রাঙ্কোরা যা করেছিল, পিকাসো সেটিকেই যত্নসহকারে রঙতুলিতে এঁকেছিলেনমাত্র।
ফ্রাঙ্কোর সঙ্গে রহিমআফরোজ (বাংলাদেশ)লিমিটেডের গ্রুপ ডিরেক্টরের পার্থক্য হচ্ছে, ফ্রাঙ্কো ধ্বংস করেছিলেন, আর নিয়াজ রহিম তার মেধা ও পরিশ্রম দিয়ে এ দেশের ব্যবসা ও শিল্পখাত তথা অর্থনীতিকে তিল তিল করে গড়ে উঠতে সহায়তা করেছেন।
নিয়াজ রহিমের জন্ম ১৯৫৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর। বাবা প্রয়াত আব্দুর রহিম, মা মিসেস আয়েশা রহিম, যিনি আল্লাহর অসীম কৃপায় তিন ভাই আফরোজ রহিম, ফিরোজ রহিম ও নিয়াজ রহিমের মাথার ওপর ছায়া হয়ে এই ৮৭ বছর বয়সেও বেঁচে আছেন।
সেন্ট প্লাসিড স্কুল, বিএএফ শাহীন স্কুল ও নটরডেম কলেজের ছাত্র নিয়াজ রহিম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮০ সালে আইন শাস্ত্রে স্নাতক সম্মান ও ১৯৮২ সালে কানাডার কনকর্ডিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মার্কেটিং ম্যানেজমেন্টে এমবিএ ডিগ্রি অর্জন করেন।
কানাডা অবস্থানকালেই ১৯৮২ সালে তাঁর বাবা মারা যান এবং সৃষ্ট পরিস্থিতিতে দেশে ফিরে এসে সে বছরই তিনি অন্য ভাইদের সাথে মিলে বাবার হাতে ১৯৫৪ সালে শুরু হওয়া ব্যবসায়ের হাল ধরেন। প্রথমেই তিনি দায়িত্ব নেন রিনিউঅ্যাবল সোলার এনার্জি বা নবায়নযোগ্য সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন প্ল্যান্ট স্থাপন সংক্রান্ত কার্যক্রমের। কাজটি ব্যবসায়িক বটে, যেখানে মুনাফা অবশ্যই অন্যতম পূর্বশর্ত। কিন্তু মুনাফার শর্তকে ছাড়িয়ে গিয়ে চোখে মুখে তাঁর স্বপ্ন বিদ্যুৎবিহীন আলোবিহীন গ্রাম বাংলার অযুত অন্ধকার গ্রামকে তিনি সৌর বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত করে তুলবেন। পৃথিবীর আগামী দিনের জ্বালানী চাহিদা মিটাবার জন্য নবায়নযোগ্য সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে বর্তমান বিশ্ব যে প্রাণান্তকর প্রচেষ্টায় লিপ্ত, আজ থেকে প্রায় চার দশক আগেই তিনি সে যাত্রা শুরু করেন, যা তার দূরদর্শীতা ও নেতৃত্বসূলভ গুণাবরীর পরিচয়কেই তুলে ধরে।
বৃটিশ ও পাকিস্তান আমল থেকেই এ দেশে বৃটিশ কোম্পানি লুকাসের ব্যাটারির ছিল একচ্ছত্র ব্যবসা। বাবা আব্দুর রহিম ছিলেন এ দেশে লুকাস ব্যাটারির একমাত্র ডিলার। ১৯৮০ সালে লুকাস এ দেশ থেকে ব্যবসা গুটিয়ে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিলে রহিমআফরোজ তা অধিগ্রহণ করে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, শুধু ব্র্যান্ড ইমেজ কিনে নেবার জন্য পৃথিবীজুড়ে যেখানে কোটি কোটি ডলার ব্যয়ের ব্যবসায়িক সংস্কৃতি চালু রয়েছে সেখানে সে প্রতিষ্ঠিত সংস্কৃতির বিপরীতে দাঁড়িয়ে লুকাসের মতো বিশ্বব্যাপী খ্যাতিমান ব্র্যান্ড ইমেজকে পরিত্যাগ করে তারা এ ব্যাটারির নামকরণ করলেন ‘রহিমআফরোজ’। কতটা আত্মবিশ্বাস, প্রত্যয় ও দেশাত্মবোধ থাকলে এটি সম্ভব তা যে কেউ অনুধাবন করতে পারেন। উল্লেখ্য, ব্যাটারি রফতানির ক্ষেত্রে রহিমআফরোজ রাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শুধু অগ্রণী নয়—বিশ্ব বাজারেও অন্যতম শরীক।
একই কথা ডানলপ টায়ারের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। একই প্রক্রিয়ায়, একই আত্মবিশ্বাসে ব্রিটিশ ব্যাটারি লুকাসের মতো ব্রিটিশ টায়ার ডানলপও এখন ‘রহিমআফরোজ’।
ইংরেজ, পর্তুগীজ বা ফরাসীদের আগমনের সুবাদে এ দেশ থেকে ইউরোপে কমবেশি যাতাযাতের চল সেই ষোড়শ শতক থেকেই রয়েছে। আর সে যাতায়াতের সুবাদেই শীতপ্রধান ইউরোপে এক ঘরের ছায়ায় সব পণ্য বিক্রির ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, মল বা সুপার মার্কেট বহুদিন পর্যন্ত তাজ্জব হয়ে দেখেছি এবং দেশে ফিরে গল্প করেছি। কিন্তু নিজেদের দেশেও তেমনটি দেখার কথা প্রায় কেউই ভাবিনি। রহিমআফরোজ এ দেশে প্রথম চালু করল আধুনিক সুপার স্টোর ‘আগোরা’। গ্রিক শব্দ আগোরার মানে হচ্ছে মার্কেট প্লেস বা বিপণী বিতান বা বিপণী।
ব্যবসা পরিচালনায় অতি উন্নত নৈতিকতা রক্ষা করে চলা এবং ক্রেতা ও ভোক্তার আস্থা ও সন্তুষ্টি অর্জনের ক্ষেত্রে রহিমআফরোজ এক অনন্য প্রতিষ্ঠান। রহিমআফরোজের সকল পণ্য ও সেবার ক্ষেত্রে রাজধানী কিংবা প্রত্যন্ত গ্রাম সর্বত্রই একই মান ও মূল্য প্রযোয্য যা বাংলাদেশের খুব বেশি প্রতিষ্ঠানের পণ্য ও সেবার ক্ষেত্রে ঘটতে দেখা যায় না।
পাঁচটি বৃহৎ খাতের আওতায় বহুসংখ্যক পণ্য ও সেবার সমন্বয়ে গড়া রহিমআফরোজ গ্রুপের কর্মীসংখ্যা এখন প্রায় ১৫ হাজার এবং এই প্রতিষ্ঠান সমূহের বার্ষিক টার্নওভারের পরিমাণ প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা।
ব্যবসায়ের পাশাপাশি সামাজিক দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রেও রহিমআফরোজ পিছিয়ে নেই। দরিদ্র ছেলেমেয়ের জন্য শিক্ষাবৃত্তি, এতিম ও দুস্থদেরকে আর্থিক সহায়তা প্রদান এবং নানা সামাজিক কল্যাণে প্রতিবছরই উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে যাচ্ছেন। আর এসব কাজকে একটি স্থায়ী ভিত্তি ও কাঠামো দানের জন্য গড়ে তুলেছেন অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ‘রুরাল সার্ভিস ফাউন্ডেশন’, ‘সেন্টার ফর যাকাত ফান্ড’ ইত্যাদি।
নিয়াজ রহিম বর্তমানে কানাডা-বাংলাদেশ চেম্বারের সহ-সভাপতি, এফবিসিসিআই, ঢাকা চেম্বার ও মেট্রোপলিটন চেম্বারের পরিচালক, অস্ট্রেলেশিয়া-বাংলাদেশ চেম্বার, বাংলাদেশ-মালয়েশিয়া চেম্বার ও জাতীয় ভোক্তা অধিকার পরিষদের সদস্য। ইতিপূর্বে তিনি রাষ্ট্রায়ত্ত্ব অগ্রণী ব্যাংক ও বিডিবিএল-এর সরকার নিয়োজিত পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন কেরেছেন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ সুপার মার্কেট মালিক সমিতির সভাপতি।
প্রচলিত পারিবারিক সংজ্ঞা অনুযায়ী স্ত্রী মিসেস সাইয়িদা ফারজানা রহিম এবং তিন পুত্র ফারাজ আব্দুর রহিম, নাওয়াজ আব্দুর রহিম ও ফায়েজ আব্দুর রহিমকে নিয়ে তাঁর পরিবার গঠিত হলেও বাস্তবে ভাই, মামা, খালু ও ছোট ভাইদের ছেলেমেয়েদেরকে নিয়ে বৃহত্তর পারিবারিক বন্ধনের মধ্যেই তাঁর বসবাস এবং ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রেও ভবিষ্যতে কে, কীভাবে উত্তরাধিকারী হবেন এবং কে কোন দায়ত্ব পালন করবেন, সে উত্তরাধিকার পরিকল্পনাও বার্ষিক পারিবারিক সম্মেলনে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করা আছে। এবং এটিও ঠিক করা আছে যে সন্তান বলেই পুত্ররা সরাসরি বাবার আসনে বসতে পারবেন না—তাদেরকে পিতা ভিন্ন অন্য নির্বাহীদের অধীনে কাজ করে কাজ শিখে সে পর্যায়ে পৌঁছাতে হবে।
(ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে অনুষ্ঠিত ইন্ড্রাস্ট্রি একাডেমিয়া লেকচার সিরিজ অনুষ্ঠানে পঠিত বক্তব্য)
লেখক: পরিচালক, ক্যারিয়ার ডেভলপমেন্ট সেন্টার (সিডিসি), ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি