মৃদু নয় মৃদুলা
- লিডারশিপ ডেস্ক
পিছিয়ে থাকার দলে থাকতে চান না মৃদুলা আমাতুন নূর। মেয়ে বলে এটা করা যাবে না, সেটা করা যাবে না এসব মানতে নারাজ তিনি। আর এসব উতরে যেতে হলে থাকা চাই প্রচণ্ড মানসিক শক্তি। নিজেকে সাহসীদের দলে দেখতে চান এ তরুণী। আজকের আয়োজনে রয়েছে তার পর্বতারোহণের গল্প—
‘ছোটবেলায় খেলনাগুলো অন্য রকম ছিল। মনে আছে, একবার ছোট চাচুকে বলি শুটিং গান (বন্দুক) কিনব। সে কিনেও দেয়। ফেরার পথে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা দুই-তিনজন ছেলে বলে মেয়েদের হাতে অস্ত্র মানায় না। তখন থেকেই মনে প্রশ্ন জাগে কেন মানায় না, মেয়েরা কি পারে না?’— এভাবে নিজের ছোটবেলার একটা ঘটনার কথা বলছিলেন কন্যা সাহসিকা মৃদুলা আমাতুন নূর। মেয়েরা যে পারে, তার প্রমাণ তিনি দিয়েছেন। ছোটবেলা মনের মধ্যে তৈরি হওয়া প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করেছেন নিজেই।
যারা ভাবছেন কি এমন করেছেন মৃদুলা, যে তার নামের আগে সাহসী তকমা বসেছে। তাদের জন্য বলছি, বাংলাদেশী মৃদুলা পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্টের ২২ হাজার ফুট আরোহণ করেছেন। অন্যদিকে তিনিই সর্বকনিষ্ঠ বাংলাদেশী, যিনি এভারেস্টের এতটা উচ্চতায় পায়ের ছাপ রেখে এসেছেন।
ঢাকা কমিউনিটি মেডিকেল কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী মৃদুলা ছোটবেলা থেকেই চেয়েছেন এমন কিছু করতে, যা গত্বাঁধা বিষয়ের বাইরে। নিজেকে কখনো গোয়েন্দা হিসেবে, কখনোবা নাসার বিজ্ঞানী ভেবে ছোটবেলায় মধুর সময় পার করেছেন। শুধু কি তাই! মৃদুলার কাছে তো ন্যাশনাল জিওগ্রাফি কিংবা অ্যানিমেল প্ল্যানেটের সেসব চরিত্রকে সুপারহিরো বলেই মনে হতো, যারা অনায়াসে সাপ, সিংহ, বাঘের মতো ভয়ঙ্কর প্রাণী নিয়ে এসে খেলা করত। তখন ছোট্ট মৃদুলা ভাবতেন সেখানে যদি তিনি থাকতে পারতেন কতই না ভালো হতো!
রোমাঞ্চকর যেকোনো কাজই টেনেছে তাকে। সার্ফিং, স্কুবা ডাইভিং, প্যারাগ্লাইড, প্যারাসেইল সব ধরনের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন মৃদুলা। অ্যাডভেঞ্চারের প্রেমে পড়া এই তরুণী গত বছর সেপ্টেম্বরে হিমাচল প্রদেশের মানালির অটল বিহারি বাজপেয়ি ইনস্টিটিউট অব মাউন্টেনিয়ারিংয়ে প্রশিক্ষণের জন্য যোগাযোগ করেন। উদ্দেশ্য নতুন অ্যাডভেঞ্চার দিয়ে পূর্ণ করবেন নিজের অভিজ্ঞতার ঝুলি। প্রতিষ্ঠানটি তাকে নির্বাচনও করে। অ্যাডভেঞ্চারের জন্য মুখিয়ে থাকা মৃদুলা নতুন অ্যাডভেঞ্চারের মুখোমুখি হতেই যেন যুক্ত হন তার থেকে বয়সে বড় এমন ৮০ জনের একটি দলে। সেখানে টানা ২৬ দিনের বেসিক মাউন্টেনিয়ারিং কোর্স শেষে ১৫ হাজার ৫০০ ফুট উপরে শীতিধার চূড়ায় ওঠেন। এই শৃঙ্গ জয় করা তিনিই সবচেয়ে কমবয়সী। এই শৃঙ্গ জয়ের পরই মূলত এভারেস্ট জয়ের ইচ্ছাটা ভীষণভাবে চেপে বসে তার মাথায়। যেমন ভাবা, সেভাবেই শুরু করেন। এভারেস্টের চূড়ায় আরোহণ না করতে পারলেও সবচেয়ে কমবয়সী প্রথম বাংলাদেশী তরুণী হিসেবে কিন্তু ২২ হাজার ফুট ঠিকই টপকেছেন।
১৮ মের সকালটা একটু অন্য রকম ছিল। কেননা সেদিনই বাংলাদেশী এই তরুণী এভারেস্টের ২২ হাজার ফুট উচ্চতায় ক্যাম্প টু থেকে একটু উপরে ক্যাম্প থ্রির কাছাকাছি আরোহণ করেন। আর মাত্র ৬ থেকে ৭ হাজার ফুট পেরোতে পারলেই হয়তো মৃদুলার দেখা এভারেস্ট জয়ের স্বপ্নটা পূরণ হয়ে যেতে পারত। কিন্তু অদৃষ্টের লেখনীতে হয়তো এটা ছিল না। তাই তো মাত্র ৬ হাজার ফুট দূরত্বের জন্য ছোঁয়া হয়নি স্বপ্নকে। সেদিন তাদের দলের লক্ষ্য ছিল শেষ চূড়ায় পদার্পণের কিন্তু বাদ সাধে আবহাওয়া। আবার তাদের দলের একমাত্র শেরপা গুরুতর আহত হয়ে পড়েন। অন্যদিকে এভারেস্টের চূড়ায় পদার্পণ করতে পারা তাদের টিমের মৃদুলার বন্ধুগোছের একজনের মৃত্যুতে অনেক বেশি মুষড়ে পড়েন মৃদুলাসহ অন্য সবাই। সবমিলে এভারেস্টের চূড়া দেখার সাধ পূরণ করা সম্ভব হয় না।
মৃদুলার মুখেই শোনা হয় সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গে আরোহণের সময়টায় নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির গল্প। প্রতিদিনই নাকি তাদের শুনতে হতো কারো না কারো মৃত্যু সংবাদ, কারো আহত হওয়ার কথা কিংবা প্রচণ্ড আইস ফল হচ্ছে এসব। এজন্য নিজেকে সবসময়ই প্রস্তুত রাখতে হয়েছে তাদের। ১ মিনিট এদিক সেদিক হলেও মৃত্যু অবধারিত, এমন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হয়েছে।
তবে এতসব পাওয়া, না পাওয়া, প্রতিকূলতা কিংবা হারিয়ে যাওয়া বন্ধুটির কথা সবমিলে অন্য রকম অভিজ্ঞতা ছিল মৃদুলার জন্য। এসবের মাঝে কোন ঘটনা মনে করে ঠোঁটের কোণে হাসি দেখা দেয় এমন প্রশ্নের জবাবে এই তরুণী বলেন, ‘এভারেস্টে ওঠার এই প্রক্রিয়াটি মূলত ৫০-৬০ দিন সময় নিয়েছে। এই দীর্ঘ সময়ে অনেক মজার ঘটনা ঘটেছে। তবে আমি একটা বিষয় বেশ উপভোগ করতাম। আমাদের দলের সদস্যরা যেহেতু বিভিন্ন দেশের ভিন্ন ভাষাভাষীর, তাই মাঝে মধ্যেই ভাষা নিয়ে বিপাকে পড়তে হতো অনেককে। যেমনটা সেখানে একজন ছিলেন ভারতের। তিনি ইংরেজি বুঝতেন না। অন্যদিকে আরেকজন ছিলেন জাপানি, সে বুঝত না হিন্দি। তাদের মধ্যে কথা কাটাকাটি হলে সমঝোতা করতে হতো আমাকে। যেহেতু দুটো ভাষাই আমার আয়ত্তে রয়েছে, তাই আমি থাকতাম রেফারি। এটা মনে হলে এখনো আনন্দ পাই।’
এসবই মৃদুলার এভারেস্ট জার্নির গল্প। এর বাইরেও তার অনেক গল্প আছে। অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা এই তরুণী কিন্তু ভালো ছবিও আঁঁকেন। ছবি আঁকার জন্য পুরস্কারও এসেছে তার কাছে। তার সংগ্রহে নাকি আছে হরেক রকম রঙ ও তুলি। এখনো সময় সুযোগ পেলে বসে যান রঙ-তুলি নিয়ে। অন্যদিকে মেডিকেলের দ্বিতীয় বর্ষের এ ছাত্রীর লক্ষ্য এমবিবিএসটাও শেষ করা। তবে পড়াশোনা শেষ করেও যুক্ত থাকবেন এমন সব রোমাঞ্চকর অভিযানের সঙ্গে, এমনই পরিকল্পনা তার।