একজন মা ও তিন অটিস্টিক মেয়ের গল্প
- দি প্রমিনেন্ট প্রতিবেদক
সন্তানকে ঘিরে একজন মায়ের কত স্বপ্নই না থাকে! সন্তান যখন গর্ভে আসে তখন থেকে শুরু হয় একজন মায়ের স্বপ্নযাত্রা। সন্তান তাকে কীভাবে মা বলে ডাকবে, কীভাবে কোলে ঝাঁপিয়ে পড়বে, কীভাবে এটা ওটা আবদার করবে, কীভাবে হাসবে, কাঁদবে, খেলবে, গাইবে—এসব নিয়ে প্রতিনিয়ত স্বপ্ন বুনে যান একজন মা। ফারজানা নাজনীন ঝর্ণাও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। বিয়ের পাঁচ বছর পর প্রথম সন্তান গর্ভে আসে তাঁর। তখন গর্ভস্থ সন্তানকে ঘিরে নানান স্বপ্ন সাজাতে শুরু করেন ঝর্ণা। দীর্ঘ দশ মাসের স্বপ্ন বোনা শেষে একদিন কাঙ্ক্ষিত সন্তানের জন্ম হয় তাঁর। ফুঁটফুটে এক কন্যা সন্তান। আদর করে নাম রাখেন হৃদি। তারপর হৃদি একটু একটু করে বড় হতে থাকে আর স্বপ্নভঙ্গ হতে থাকে মা ঝর্ণার। তিনি যেভাবে স্বপ্ন সাজিয়েছিলেন সেই স্বপ্নের আচরণের সঙ্গে কোনোই মিল খুঁজে পান না মেয়ে হৃদির। মেয়েটা কেমন অস্বাভাবিক আচরণ করে! একদিন টেলিভিশনে ডা. রওনক হাফিজের একটি অনুষ্ঠিান দেখছিলেন ঝর্ণা। অনুষ্ঠান দেখতে দেখতে শরীরের রক্ত হিম হয়ে আসে তার। তবে কী তার আদরের মেয়ে হৃদিও….?
ফারজানা নাজনীন ঝর্ণা আর ভাবতে পারেন না। মেয়েকে নিয়ে ছুটে যান এক বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার সবকিছু দেখে শুনে বলেন, ‘হ্যাঁ, আপনার মেয়ে অটিজম রোগে আক্রান্ত!’ বুকের ভেতর থেকে হৃদপিণ্ড যেন ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে চায় ঝর্ণার। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নেন। সান্ত্বনা দেন এই বলে যে ‘ভাগ্যের লিখন না যায় খণ্ডন’!
এর ঠিক আট বছর পর আবারও গর্ভধারণ করেন ফারজানা নাজনীন ঝর্ণা। এবার তার কোলজুড়ে আসে ফুটফুটে দুটি জমজ সন্তান। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! এ দুটি সন্তানও অটিজম রোগে আক্রান্ত!
ফারজানা নাজনীন এখন তিনটি অটিস্টিক সন্তানের মা। হৃদি, রীতি, রতি—তিন মেয়েকে ঘিরেই এখন তার দিনযাপন। এই ‘দিনযাপন’ শব্দটিকে ঘিরেই রয়েছে ফারজানার দুঃখ, কষ্ট, সংগ্রাম আর গর্বের গল্প। বড় মেয়ের বয়স এখন চৌদ্দ, মেঝো ও ছোটটির ছয়। ওরা তিনজনই পড়াশোনা করছে মিরপুরের বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশন কল্যাণী ইনক্লুসিভ স্কুলে।
মেয়ে তিনটিকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া নিয়ে আসা থেকে শুরু করে তাদের খাওয়া, ঘুম, গোসল, খেলাধুলা, পড়ালেখা সবকিছু নিজ হাতে সামলান ফারজানা নাজনীন ঝর্ণা। মেয়ে তিনটি আর দশটি সাধারণ মেয়ের মতো নয়, তারা সবার থেকে আলাদা, তিনি একেবারেই ব্যতিক্রমী তিন সন্তানের মা—এই বোধ ফারজানাকে গর্বিত করে। আবার একইসঙ্গে আশপাশের মানুষজনের আচরণ ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি তাকে প্রতিনিয়ত কষ্ট দেয়। একদিনের ঘটনা শোনাতে গিয়ে বারবার চোখ মোছেন ফারজানা—‘সেদিন ব্যাংকে গিয়েছিলাম জরুরি কাজে। আমার সঙ্গে ছিল হৃদি, রীতি, রতি। তারা একটু অন্যরকম আচরণ করছিল দেখে ব্যাংকের এক মহিলা কর্মকর্তা রেগে গিয়ে বলেন, ‘বাচ্চাগুলোকে বাসায় রেখে আসতে পারেন না?’
ফারজানা দুঃখ করে বলেন, অনেক উচ্চশিক্ষিত মানুষও অটিস্টিক শিশুদেরকে স্বাভাবিক চোখে দেখে না। শিক্ষিতরাই যখন এসব শিশুদের সঙ্গে সহানুভূতিশীল আচরণ করে না তখন সমাজের অন্যস্তরের মানুষের আচরণ কেমন হবে, ভাবুন! আমার মেয়েগুলোর সঙ্গে অন্য শিশুরা খেলতে চায় না, মিশতে চায় না। ওদের মা বাবাও মিশতে দিতে চায় না। আমাদেরকে কেউ বাসা ভাড়া দিতে চায় না। এদেরকে বাসায় পড়ানোর মতো হাউস টিউটর পাওয়া যায় না। মেয়ে তিনটিকে নিয়ে কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে যাওয়া যায় না, নানা ধরনের অপ্রস্তুত অবস্থার মুখোমুখি হতে হয়।…বলতে বলতে গলা ধরে আসে ফারজানার। আবারও অশ্রুসজল হয়ে ওঠে তার চোখ।
তবে ভেঙে পড়ার পাত্রী নন ফারজানা নাজনীন। তিনি লড়াই করতে জানেন। তিন সন্তানকে নিয়ে একাই লড়াই করে যাচ্ছেন অটিজম সচেতনতা বাড়াতে। তিনি মনে করেন, অটিজম সচেতনতা বাড়াতে গণমাধ্যম থেকে শুরু করে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর আরো বেশি বেশি এগিয়ে আসা উচিত।