একজন কিংবদন্তী নারী ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী
- মিথিলা
“বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যানকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।” কবি কাজী নজরুল ইসলামের এই “নারী” কবিতার চরণগুলোতে তুলে ধরা হয়েছে বিশ্বে নারী পুরুষের সমান অবদানের কথা, যার প্রতিচ্ছবি আজ আমরা আমাদের আশে পাশে খুঁজলেই পাই, তবে এই স্বীকারোক্তি একদিনে আসে নি।
আজকের সমাজে নারীদের কাছে সবকিছু যেমন সহজলভ্য, আগে তা ছিল না। বিংশ শতাব্দীর আগে পুরুষদের শিক্ষার সুযোগ থাকলেও নারীদের শিক্ষার কোন সুযোগ ছিল না। ঠিক সে সময় নারীর শিক্ষার অগ্রগতির নেতৃত্ব দেওয়ার দুঃসাহস করেছিল এক কিংবদন্তী নারী; যার নাম ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী।
১৮৩৪ সালে কুমিল্লায় লাকসাম উপজেলায় হোমনাবাদ পরগণায় জন্মগ্রহণ করেন মহীয়সী নারী ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী। তাঁর বাবা ছিলেন জমিদার আহমদ আলী চৌধুরী এবং মা আরফান্নেসা চৌধুরাণী। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরাণী ছিলেন তৃতীয় এবং তিনিই একমাত্র জমিদারি পরিচালনার প্রশিক্ষণ পান। ছোটবেলা হতেই পড়াশোনার প্রতি খুব আগ্রহ ছিলো তাঁর। কিন্তু সেই সময় মেয়েদের পড়াশোনার ব্যবস্থা ছিল না বলে তার বাবা তার জন্য গৃহশিক্ষকের যোগদান করিয়েছিলেন। তার পারিবারিক ভাষা উর্দু থাকা স্বত্ত্বেও সে বাংলা, ফারসি, সংস্কৃতি ও আরবি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন।
ছোট বেলায় বাবা মারা যাওয়ার পরেই সে জমিদারির দায়িত্ব নেয়, তবে পারিবারিক সমস্যার কারনে তার বিয়ে হয়ে যায়। তার স্বামী তাঁর বাবার ভাগিনা ভাউকসারের গাজী চৌধুরী। এই বিয়ের আগেও তার স্বামীর বিয়ে হয়েছিলো। সব জেনেই সে বিয়ে করেছিলেন ভাউকসারের গাজী চৌধুরীকে। বিয়ের পরেও সে বাপের বাড়িতেই ছিলেন অধিকাংশ সময়। তার দুইটি কন্যা সন্তান ছিল। বড় মেয়ের নাম আরশাদুন্নেসা এবং ছোট মেয়ের নাম বরদুন্নেসা। একসময়ে সংসার জীবনে ঝামেলার কারনে তার স্বামীর সাথে বিচ্ছেদ হয়ে যায়। বিচ্ছেদের পরে সে তার বড় মেয়েকে স্বামীর কাছে রেখেই ছোট মেয়েকে নিয়ে চলে যান।
নওয়াব ফয়জুন্নেসা তার পরিচালিত ১৪ টি মৌজায় প্রতিটিতেই স্কুল, মাদ্রাসা তৈরি করেন এবং পুকুর খনন করেন। ১৮৭৩ সালে তিনি কুমিল্লায় ইংরেজি উচ্চ বিদ্যালয় উপস্থাপন করেন। এই সালে সে আরো একটি উচ্চ বিদ্যালয় উপস্থাপন করেন কুমিল্লা শহরেই। এই দেশের মুসলিম মেয়েদের জন্য ইংরেজী খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই মেয়েদের ইংরেজি শিক্ষায় আগ্রহী করার জন্য সে বৃত্তির ব্যবস্থাও করেছিলেন। সে চাইতেন এদেশের পিছিয়ে পড়া মুসলিম নারীরা যেন এগিয়ে যেতে পারে। সে এইসমস্থ কাজ করার সাথে সাথে ধর্মও পালন করতেন।
সে সময়ে একজন নারী হয়ে জমিদারি করা ছিলো অনেক বড় ব্যাপার। সে একজন নারী হয়েও দক্ষতার সাথে তার জমিদারী সম্পন্ন করেছেন এবং কাজে কর্মে তাঁর বুদ্ধিমত্তার ছাপ রেখে যান। এছাড়াও ত্রিপুরার ম্যাজিস্ট্রেট মি. ডগলাসেলের জনকল্যাণমুখী কাজে অর্থনিয়োগ করেন। পরবর্তীকালে তাকে টাকা ফেরত দিতে আসলে তিনি সেই টাকা গ্রহণ করেন না। তার এই কর্মকাণ্ডে অভিভূত হন মি. ডগলাসেল। পরে এ ঘটনা মি. ডগলাসেল মহারানী ভিক্টোরিয়ার কাছে বর্ণনা করেন। তারপর ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী কে বেগম উপাধিতে ভূষিত করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী তা সম্মানের সাথে প্রত্যাখ্যান করেন। কারন সে নিজে একজন জমিদার এবং জমিদার বংশের মেয়ে হওয়ায় তার নামের পুর্বে আগেই উপাধি হিসেবে ‘বেগম’ ছিল বলে জানান।
পরবর্তীতে নতুন বৈঠক বসে এবং “নওয়াব” উপাধিটি ফয়জুন্নেসা চৌধুরানীর জন্য উপযুক্ত বলে মনে করেন। ১৮৮৯ সালে তাঁকে নওয়াব পদবিতে ভূষিত করার জন্য পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা খরচ করে অনুষ্ঠান করা হয়। তাঁকে তারকাখচিত একটি হিরকপদক দেওয়া হয়। আজকের যুগেও তাই নারী জাতির অগ্রগতির একটি বিশেষ উদাহরণ “নওয়াব বেগম ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী”।