ড. ইংলিশ সাজ্জাদের কথা
- লিডারশিপ ডেস্ক
সাজ্জাদ হোসেন। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত সিঙ্গাপুরের নাগরিক। সবে বিশ্ববিদ্যালয়ের দোরগোড়ায় পৌঁছেছেন। তবে স্কুলজীবন থেকেই তিনি বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিকদের ইংরেজি ভাষা শেখান। এ কাজের জন্য তিনি গড়ে তুলেছেন এসডিআই একাডেমি নামের একটি প্রতিষ্ঠান। সিঙ্গাপুরের জাতীয় দিবসে পেয়েছিলেন সে দেশের প্রেসিডেন্টের আমন্ত্রণ। সেখানে সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী প্রশংসা করেছেন তাঁর। সাজ্জাদের উদ্যোগ নিয়ে খবর প্রকাশ করেছে সিঙ্গাপুরের সংবাদমাধ্যম দ্য স্ট্রেইটস টাইমস ও চ্যানেল নিউজ এশিয়া। সাজ্জাদ হোসেনের উদ্যোগ ও স্বপ্নের কথা নিয়ে এই প্রতিবেদন।
সাজ্জাদ হোসেনের সঙ্গে মেসেঞ্জারে কথা হচ্ছিল। ‘বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত’ এই তরুণ সিঙ্গাপুরে দারুণ কিছু করেছেন এই তথ্যটুকুই তখন জানা ছিল। পরিচয়পর্ব সেরে তাই লিখলাম, ‘আপনি কি বাংলা জানেন?’ প্রশ্ন দেখে তিনি হাস্যোজ্জ্বল একটা ‘ইমো’ পাঠালেন। ইমোতে কি আর উত্তর মেলে! তাঁর উত্তরের অপেক্ষায় থাকি। খানিকটা সময় নিয়ে তিনি আবার লিখলেন, ‘জি, অবশ্যই জানি। ছোটবেলায় যখন সিঙ্গাপুরে আসি, তখন ইংরেজিতে ভালো ছিলাম না বলে আমি স্কুলে ভর্তির সুযোগ পাইনি!’
মনে মনে ভাবি, কারও সম্পর্কে আধাআধি জেনে কথা বলার বিপত্তি এমনই হয়! এরপরই তিনি একটা ওয়েবসাইটের লিংক পাঠালেন। জানালেন এতে তাঁর সম্পর্কে বিস্তর জানা যাবে। লিংকটি ছিল চ্যানেল নিউজ এশিয়ার একটি সংবাদের। সেই সংবাদ পড়ে তো চক্ষু চড়কগাছ। তারা বলছে, সাজ্জাদ এরই মধ্যে পাঁচ হাজার অভিবাসী শ্রমিককে ইংরেজি শিখিয়েছেন। অথচ ইংরেজিতে দক্ষ না হওয়ায় তিনি নিজেই প্রাথমিকে দুই বছর হারিয়ে ফেলেছেন।
সে খবর পড়ে তাঁর সম্পর্কে জানার আগ্রহ বাড়ল। ইন্টারনেট ঘেঁটে কিছু তথ্য পেলাম। এবার আর লিখে লিখে কথা নয়, ফোন করা হলো মেসেঞ্জারে। ৩ জুন সেই আলাপনে সাজ্জাদ শোনালেন তাঁর পথচলার গল্প।
যেখানে শেখানো হয় ইংরেজিঢাকা টু সিঙ্গাপুর
২০০৫ সালের কথা। সাজ্জাদ হোসেন ঢাকার মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পা রেখেছেন। ক্লাস শুরুর আগেই সিঙ্গাপুরের বিমানে উঠতে হলো। তাঁর প্রকৌশলী বাবা মো. শহীদুল্লাহ আগে থেকেই সিঙ্গাপুরপ্রবাসী। তিনি সেখানে একটি জাহাজ তৈরির কারখানায় তড়িৎ প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করেন। মা ফেরদৌস জাহানের সঙ্গে সে বছর গেলেন সাজ্জাদ ও তাঁর ছোট বোন নাজমুন নাহার।
সিঙ্গাপুরে গিয়ে সাজ্জাদকে স্কুলে ভর্তির চেষ্টা করা হলো। কিন্তু কোনো স্কুলেই ভর্তির সুযোগ পেলেন না। ভর্তি পরীক্ষায় ইংরেজি না পারার কারণে অকৃতকার্য হলেন। তাঁর বাবা ভাবলেন, পড়াশোনা তো চালিয়ে নিতে হবে। তাই স্কুলপ্রধানকে অনুরোধ করে সাজ্জাদকে ইউহুয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি করানো হলো।.দুই শ্রেণি নিচে ভর্তি হওয়া মানে দুটি বছর হারানো। এ নিয়ে মনঃকষ্ট ছিল সাজ্জাদের ভেতরে। তবে দমে যাননি। সাজ্জাদ বলেন, ‘বন্ধু আর শিক্ষকদের সহযোগিতায় আমি কয়েক মাসের মধ্যেই ইংরেজিতে ভালো করতে থাকি।’ আর বছর ঘুরতেই তিনি উতরে গেলেন ইংরেজি বৈতরণি।
দাগ কাটে ভাষার বাধা
গণমাধ্যমে সাজ্জাদের উদ্যোগ নিয়ে খবরচলতি পথে কিংবা বিপণিবিতানে হরহামেশাই বাংলাদেশি মানুষের দেখা পেতেন সাজ্জাদ। তাঁদের অনেকেই ছিলেন সে দেশে অভিবাসী শ্রমিক। বাবার কাজের সুবাদেও সাজ্জাদের পরিচয় হতো দেশের অনেক শ্রমিকের সঙ্গে। অনেকের সঙ্গে ভালো খাতিরও হয় তাঁর। তাই মাঝেমধ্যে যেতেন ডরমিটরিতে। এই ডরমিটরিতে একসঙ্গে কয়েক হাজার মানুষের বসবাস। সেখানে ধীরে ধীরে পরিচয়ের ব্যাপ্তি বাড়ে। সাজ্জাদ বলেন, ‘আমি দেখতাম তারা ভালো ইংরেজি জানে না। নিজেদের মনের কথা, চাওয়া বুঝিয়ে বলতে পারত না। অসুস্থ হয়ে চিকিৎসকের কাছে গেছে, কিন্তু নিজের অসুস্থতার কথা বুঝিয়ে বলতে পারছে না।’ এমন চিত্র প্রতিনিয়ত দেখতেন সাজ্জাদ। তাঁর মনে ভীষণ দাগ কাটে ব্যাপারটা। ভাষা দুর্বলতার জন্য নিজের ভেতর চাপা কষ্ট তো ছিলই। তাই এই অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য কিছু করার চিন্তা ঢুকে যায় তাঁর মাথায়।
পার্ক থেকে শুরু
তত দিনে স্কুলের গণ্ডি পেরিয়েছেন সাজ্জাদ। মনের মধ্যে সব সময় যে চিন্তা তোলপাড় করত এবার সেটা দিনের আলোয় আনতে চাইলেন। ছয়জন শ্রমিককে ইংরেজি শেখানো শুরু করলেন। বসার মতো তেমন জায়গা নেই। তাতে কি! বাসার কাছেই তামান জারং গ্রিন পার্ক আছে, সেটাই হলো উন্মুক্ত শ্রেণিকক্ষ। কয়েকজন মিলে বৈঠকি ঢঙে বসে ইংরেজি শেখার ক্লাস নেওয়া হতো। সাজ্জাদ বলেন, ‘আমি জানতাম আমাদের দেশের মানুষের ইংরেজির ঘাটতি কোথায়। শুরুতে তাই পড়ানো সহজ ছিল।’
কয়েক দিন যেতেই তাঁর ক্লাসে উপস্থিতি বাড়তে থাকে। জনাদশেক ছাত্র নিয়ে এভাবেই চলে কিছুদিন। সাজ্জাদ ভাবলেন তাঁর শেখানোর ধরনে নতুনত্ব আনা যায় কি না। একটি সহজ পদ্ধতিতে সিলেবাস তৈরি করা যায় কি না। সাজ্জাদ তাঁর নিজের বই ঘেঁটে ঘেঁটে একটা পদ্ধতি দাঁড় করালেন। সেটাও ঠিক মনের মতো হলো না। এরপর কী করলেন? সাজ্জাদ বলেন, ‘ইন্টারনেট ঘেঁটে ভাষা শিক্ষার বিভিন্ন বই সম্পর্কে জানালাম। সেগুলো সংগ্রহ করলাম।’
এসব বই ঘেঁটে তিনি নিজে একটি সিলেবাস দাঁড় করালেন। সেটা কেমন? সাজ্জাদ বলছিলেন, ‘শিশুরা তো ব্যাকরণ মেনে ভাষা শেখে না। তার প্রয়োজন অনুযায়ী ছোট ছোট শব্দ শেখে। তারপর ধীরে ধীরে পূর্ণাঙ্গ বাক্য তৈরির চেষ্টা করে। আমি সেটা মাথায় রেখেই সিলেবাস কাঠামো সাজিয়েছি।’
প্রথমে একজন মানুষ রোজকার জীবনে যে ভাষা ব্যবহার করেন সেটা শেখানো হয়। তারপর ব্যাকরণ সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়। এ জন্য তিনি বাংলাদেশি শ্রমিকদের সঙ্গে নিবিড়ভাবে মিশলেন। তাঁরা দৈনন্দিন কাজে কী ধরনের শব্দ ব্যবহার করেন তা জানলেন।
এবার একটা কাঠামো দাঁড়াল। তাঁর ক্লাসে আসা মানুষের সংখ্যা বাড়ল। তত দিনে সিঙ্গাপুর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষ ব্যবহারের অনুমতি পেয়েছেন সাজ্জাদ। কয়েকজন সহযোগী পেয়ে গেলেন। তাঁদের অনেকেই বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত। এই দলটি নিয়েই ২০১৩ সালে সাজ্জাদ গড়ে তুললেন ‘সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ (এসডিআই) একাডেমি’ নামে একটি সামাজিক উদ্যোগ। অভিবাসী শ্রমিকদের নিয়েই যার প্রধান কাজ।
তত দিনে পরিসর বেড়েছে সাজ্জাদের ইংরেজি শিক্ষার আসরে। ২০১৪ সালে সাজ্জাদ তাঁর ইংরেজি ভাষা শেখানোর পদ্ধতি নিয়ে প্রকাশ করলেন বই—ড. ইংলিশ। বেশ জনপ্রিয় হলো বইটি। সাজ্জাদ বলেন, ‘শ্রমিক ভাইয়েরা সপ্তাহে এক দিন ছুটি পান। সে দিনটিতেই শুধু ক্লাস নিতে হতো। সপ্তাহ শেষে দেখা যেত তাঁরা সবকিছু ভুলে গেছেন। তাই চাইছিলাম একটি বই প্রকাশ করতে। যেন ক্লাসের পড়াটুকু বাসায় গিয়েও চর্চা করতে পারেন।’
ড. ইংলিশ এখন চার মাসের কোর্স। সাজ্জাদরা আনুষঙ্গিক খরচ চালানোর জন্য এই কোর্স করাতে ১৮০ ডলার ফি নেন।
ড. ইংলিশ বই হাতে ইংরেজি ভাষা শিক্ষার্থী ও অন্যরাপ্রেসিডেন্টের আমন্ত্রণে…
সিঙ্গাপুরের জাতীয় দিবস ৯ আগস্ট। প্রতিবছর দেশটির প্রেসিডেন্ট সে দেশের বিশিষ্ট নাগরিকদের আমন্ত্রণ জানান রাষ্ট্রীয় অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানে। গতবছর এটি হয়েছিল ১৭ আগস্ট। সেখানে আমন্ত্রিত ছিলেন সাজ্জাদ হোসেন। অনুষ্ঠানেই সাক্ষাৎ হয় সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী লি সিয়েন লুংয়ের সঙ্গে। লি সিয়েন লুং সে অনুষ্ঠানের কিছু ছবি তাঁর ফেসবুক পেজে প্রকাশ করেন। যে ছবিগুলোর একটিতে ছিলেন সাজ্জাদসহ কয়েকজন তরুণ সামাজিক উদ্যোক্তা। প্রধানমন্ত্রী সাজ্জাদসহ বাকিদের নাম উল্লেখ করে ছবির ক্যাপশনও লিখেছিলেন।
সাজ্জাদের স্বপ্ন
এ বছর সিঙ্গাপুরের স্বনামধন্য দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক পড়ার সুযোগ পেয়েছেন সাজ্জাদ। ৬ জুন জানালেন তিনি ভর্তির সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছেন। নানইয়াং টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটিতে তিনি ভর্তি হচ্ছেন তড়িৎ প্রকৌশলে।
তবে পড়াশোনার সঙ্গে থেমে থাকবে না তাঁর এসডিআই একাডেমির কাজ। এরই মধ্যে ড. ইংলিশ বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণ তৈরি করেছেন। এবার বাংলা ছাড়াও অভিবাসী অন্য দেশের শ্রমিকদের জন্যও বইটা ছয়টি ভাষায় উপযোগী করিয়েছেন। এখন অর্থ সংস্থানের কাজ করছে তাঁর দল। সাজ্জাদ ও তাঁর দলের সদস্যরা স্বপ্ন দেখছেন অর্থের সংস্থান হলে বইটি এক লাখ অভিবাসী শ্রমিকের হাতে তুলে দিতে পারবেন।