নাজমুলের অ-আ-ক-খ স্কুল
- লিডারশিপ ডেস্ক
নাজমুল হোসাইন হতাশা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য একটি স্কুল গড়েছিলেন। এখন সেখানে আছে ৬৫ জন ছাত্র-ছাত্রী। পাশাপাশি আরো নানা কিছু করছেন তিনি সাভারের নিরিবিলি বস্তিতে।
তখন মনটি তাঁর খুব খারাপ ছিল। সার্জারিতে ফেল করেছেন। আবার পরীক্ষা দিতে হবে, তা-ও বেশ দেরিতে হবে। কী করবেন ভাবছিলেন। একদিন ইউটিউবে দেখলেন ফাদার লুসিও নামে ইতালির এক নাগরিক বাংলাদেশের পথশিশুদের লেখাপড়া শেখান। সেটিই বদলে দিল তাঁকে। মনে পড়ল, কয়েক বছর আগে তাঁদের গণস্বাস্থ্য মেডিক্যাল কলেজের পাশের বস্তিতে বস্তিবাসীদের শীতবস্ত্র দিতে গিয়েছিলেন। বস্তির নাম ‘নিরিবিলি’। এক বিকেলে সেখানে চলে গেলেন। বললেন, ‘আপনাদের ছেলেমেয়েদের আমি লেখাপড়া শেখাব। ওদের মানুষের মতো মানুষ করব। ’ শুনে খুব খুশি শিশুদের মা-বাবা। তাঁর স্কুলের নামটি দিলেন বুয়েটের ছাত্র জাকির হোসেন—‘অ, আ, ক, খ স্কুল। ’
স্কুলের জন্ম গত বছরের ১৯ মে। গণস্বাস্থ্য মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের হাসান, রথি, ফারিয়া, রুবেল ও ইরফান নানাভাবে উৎসাহ দিলেন, সাহায্য করলেন। এভাবেই ৬০ জন শিশুকে নিয়ে শুরু হয়ে গেল ক্লাস। তাদের শিক্ষক আটজন স্বেচ্ছাসেবী ছাত্র-ছাত্রী। ঢাকা-আরিচা সড়কের পাশের এই বস্তিতে একটি রুমে স্কুলটির যাত্রা শুরু হলো। বৃষ্টি হলে টিনের চালের ফুটো দিয়ে পানি পড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে ক্লাস করতে হয়। তবে সেখানেও থাকা গেল না। একদিন বাড়ির মালিক এসে বললেন, কেয়ারটেকার আমার অনুমতি না নিয়েই রুম ভাড়া দিয়েছে। এখানে আর থাকতে পারবেন না। বাধ্য হয়ে খোলা মাঠে ক্লাস শুরু হলো। প্রচণ্ড রোদে ছাত্র-ছাত্রীরা হাঁসফাঁস করে, বৃষ্টি হলে ক্লাসে আসতে চায় না। মেডিক্যালের ছাত্র-ছাত্রীদের দানের টাকায় কেনা খাবার দিয়েও ছাত্রছাত্রী পাওয়া যায় না। মা-বাবারা ওদের ময়লা কুড়ানোর কাজে লাগান। বস্তি ঘুরে ঘুরে তখন ছাত্র-ছাত্রী জোগাড় করতে হয়েছে নাজমুলদের।
এসবের মধ্যে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন এক স্থানীয় সমাজসেবক। নাম তাঁর বেলাল। তিনি রাস্তার পাশের এক দোকানে ক্লাসের ব্যবস্থা করে দিলেন। তবে ছেলে-মেয়েরা সেখানে পড়ার চেয়ে পথ-রাজপথের দৃশ্য দেখতেই বেশি মনোযোগী হয়ে পড়ল। ফলে নতুন একটি জায়গা হন্যে হয়ে খুঁজতে লাগলেন নাজমুল। পেয়েও গেলেন একদিন। এক ভদ্রলোক শিক্ষা অধিদপ্তরের মিরপুর শাখায় চাকরি করেন। তাঁর প্রায় ১৫ কাঠা জমিতে পাঁচটি ঘর ভাড়া দিয়ে স্কুল চালানোর অনুমতি দিলেন। এ বছরের ১ মে থেকে সেখানেই ‘অ, আ, ক, খ’ চলছে। স্কুলকে ছাত্র-ছাত্রীদের উপযোগী করে গড়ে তোলার জন্য ফুলের বাগান লাগানো হয়েছে, দেওয়ালগুলোতে মীনা কার্টুনের নানা দৃশ্য আঁকা হয়েছে, টিনগুলোও রঙে রঙিন হয়েছে। হঠাৎ করে আর্থিক সাহায্যও পেতে শুরু করেছেন তিনি।
সাজেদুর রহমান নামে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র স্কুলের কার্যক্রমের বিবরণ ও ছবি দিয়ে তাঁর ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছিলেন। সেটি ‘টেক্সপ্রেগো’ নামের একটি বিদেশি গার্মেন্ট কম্পানির ডিজিএম এইচআর, অ্যাডমিন ও সিএসআর খন্দকার সালেকের চোখে পড়ল। তিনি যোগাযোগ করলেন। সাত দিন পর প্রতিষ্ঠানের জেনারেল ম্যানেজার ফোরকান উদ্দিনকে নিয়ে চলেও এলেন। এরপর তাঁরা তাঁদের স্কুলঘর তোলার টাকা দিলেন। ছাত্র-ছাত্রীদের স্কুল ব্যাগ-খাতা-কলম, পোশাকের জন্য ৯০ হাজার টাকা দেওয়া হলো। তবে কোনো টাকাই কিন্তু হাতে দেওয়া হয়নি। কত খরচ হতে পারে—হিসাব দিয়েছেন নাজমুল। তাঁরা সেসব কিনে দিয়েছেন। সেবার ঈদের সামগ্রীও দিয়েছেন। এবারের ঈদেও বস্তিতে বিলানোর জন্য ৫০টি প্যাকেট কিনে দিয়েছেন। প্রতিটিতে এক কেজি দুধ, দুই কেজি চিনি, এক প্যাকেট লাচ্ছি সেমাই, কিশমিশ, বাদাম আছে। এ জন্য তাঁদের খরচ হয়েছে প্রায় ৪৫ হাজার টাকা। সাকলাইন রাসেল নামের এক সংবাদ উপস্থাপক ও চিকিৎসক এবার শিশুদের ঈদ সামগ্রী কেনার জন্য ১৫ হাজার টাকা দিয়েছেন। নিরিবিলিতে সে টাকা লাগবে না বলে আরিচাঘাট বা যমুনার কোনো চরের শিশুদের ঈদ সামগ্রী কিনে দেবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন নাজমুল।
টেক্সপ্রেগ্রো শিশুদের খেলার জন্য ব্যাট, বল, র্যাকেট কিনে দিয়েছে। ওদের লেখাপড়ার সব উপকরণও তারা দেয়। এসব শিশু খেলাধুলায়ও বেশ পাকা। গেল বছরের শেষের দিকে তাদের স্কুলে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হয়েছে। এবারের ফেব্রুয়ারিতে ছোট, বড়, মাঝারি—এই তিন বিভাগে ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হয়েছে। শিমুলি নামের প্লে গ্রুপের এক ছোট্ট ছাত্রী সেখানে কোলবালিশ, সুই-সুতা, দড়িখেলা তিনটি বিভাগেই পুরস্কার পেয়েছে। প্রতি মাসে তাদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও হয়। তাতে অনেকে সাফল্য দেখিয়েছে, তারা অনেক কিছু পারে। সুরাইয়াকে একবার দেখিয়ে দিলেই হলো, যেকোনো গানের সঙ্গে নাচতে পারে। এমন আরেকজন ভালো নৃত্যশিল্পী হলো অনিকা। সুরাইয়া পড়ে টুতে, অনিকা প্লে গ্রুপের ছাত্রী। এসব ছেলে-মেয়ে একুশে ফেব্রুয়ারিতে রচনা ও চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায়ও অংশ নিয়েছে। ক্লাস থ্রির ছাত্র-ছাত্রী শফিক ও মঞ্জিলার আঁকা সবার চেয়ে ভালো হয়েছে।
প্লে গ্রুপ থেকে পঞ্চম শ্রেণির এই স্কুল চলছে মানুষের সাহায্য, মেডিক্যালের ছাত্র-ছাত্রীদের চাঁদায়। স্কুলের জন্য অনেক সাহায্য করেছে টেক্সপ্রেগ্রো। তারা বেঞ্চ তৈরির খরচ দিয়েছে, ছাত্র-ছাত্রীদের লেখাপড়ার খরচ দিয়ে যাচ্ছে। নাজমুল বললেন, ‘তারা শুরু থেকে এ পর্যন্ত আমাদের তিন লাখ ৬১ হাজার টাকার সহযোগিতা করেছে। ’ টেক্সপ্রেগো বস্তির নারীদের সেলাই প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য ১০টি সেলাই মেশিন কিনে দিয়েছে। সেগুলোর মাধ্যমে নারীদের স্বাবলম্বী করা হবে।
আয়ারল্যান্ড থেকে ইউসুফ আবদুল্লাহ নামের এক প্রবাসী বাংলাদেশি সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার আট হাজার ৫৬১ টাকা দিয়েছেন। সেই টাকায় স্কুলের ছাত্র জুবায়েরের মাকে সিআরপি থেকে একটি হুইল চেয়ার কিনে দেওয়া হবে। তিনি হাঁটাচলা করতে পারেন না। তাঁর দুটি হাত, দুটি পা-ই অবশ হয়ে গেছে। বস্তির প্রতিটি পরিবারকে গণস্বাস্থ্য বীমার অধীনে নিয়ে আসার পরিকল্পনা আছে নাজমুলের। পরিবারপ্রতি স্বাস্থ্যবীমার এই ৪০ হাজার টাকা জোগাড় করার চেষ্টায় আছেন তিনি। তিনি ও তাঁর ভবিষ্যতের চিকিৎসক বন্ধুরা আবদুল মামুন ও হোসেন নামের দুই ছাত্রের মাদের প্রাথমিক চিকিৎসা ও ধাত্রীবিদ্যার প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। তাঁদের মাধ্যমে তাঁরা বস্তিতে তিনটি স্বাস্থ্য ক্যাম্পও করেছেন। সেখানে ডাক্তার ফি ১০ টাকা ও ওষুধের ফি ২০ টাকা দিয়ে বস্তিবাসীরা স্বাস্থ্যসেবা নিয়েছে। মেয়েদের জন্য ছিলেন কোহিনূর আজাদ নামের নারী চিকিৎসক, পুরুষদের চিকিৎসা নাজমুল নিজেই দিয়েছেন। ক্যাম্পগুলোতে তাঁরা সাধারণ রোগগুলো কেন হয় ও রোগের চিকিৎসা কোথায় পাওয়া যাবে বস্তিবাসীদের জানিয়েছেন। এ ছাড়া ছাত্র-ছাত্রীদের কেউ অসুস্থ হলে, কুকুরে কামড়ালে তাকে বিনা মূল্যে সেবা দেন তাঁরা।
‘অ, আ, ক, খ’ স্কুলে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের আদলে একটি লাইব্রেরি করার পরিকল্পনা আছে নাজমুলের। সে জন্য ইভানা শামস নামের এক অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী বাঙালি এবারের বইমেলায় তার কবিতার বই বিক্রির ৩০ হাজার টাকা দিয়েছেন। আরো টাকা জোগাড় হলে সেখানে লাইব্রেরি গড়ে তোলা হবে। ছাত্র-ছাত্রীরা তাতে বিশ্ব সাহিত্যের বিভিন্ন বিখ্যাত বই পড়তে পারবে। তিনি ও তাঁর বন্ধুরা এবারের ১৯ মে তাঁদের স্কুলের প্রথম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করেছেন। তাতে আবদুন নূর তুষার, গণবিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ও মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক ডা. লায়লা পারভীন বানু, ডা. সাকলায়েন রাসেল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমানসহ কয়েকজন গণ্যমান্য চিকিৎসক উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের সামনে ছেলে-মেয়েরা নাচ, গান, ছড়া আবৃত্তি করেছে। এই আয়োজন তাঁদের এত ভালো লেগেছে যে ডা. লায়লা পারভীন বানু প্রতি মাসে পাঁচ হাজার টাকার আর্থিক সাহায্য করছেন। এই ছোট্ট শিশুদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আগ্রহী করে তোলার জন্য তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র উৎসবও করেছেন।
কোনো দিন যারা লেখাপড়ার সুযোগ পাবে ভাবেনি, এই স্কুলে তাদের ‘শাপলা’, ‘গোলাপ’, ‘জবা’, ‘বেলি’, ‘জুঁই’—পাঁচটি বিভাগে ক্লাস হয়। ২০ জন ভালো ফলাফল করা ছাত্র-ছাত্রীকে সরকারি প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করা হয়েছে। অন্যান্য আধুনিক স্কুলের মতো তারাও ছাত্র-ছাত্রীদের প্রগ্রেস রিপোর্ট তৈরির কাজ করছেন। এখন এই স্কুলে প্লে গ্রুপ থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে মোট ৬৫ জন ছাত্র-ছাত্রী আছে। স্কুল নিয়ে তারা বেশ খুশি। ক্লাস টুর ছাত্রী সেলিনা বললো, ‘কোনো দিন স্কুলে যাব, ভাবতেই পারিনি। বস্তিতে থাকি বলে আমাদের সবাই ঘৃণা করে। এখন আমরা অন্য সব শিশুর মতো লেখাপড়া করতে পারছি। ’ তার পরও এই স্কুল নিয়ে ভাবনা কমেনি প্রতিষ্ঠাতা নাজমুল হোসাইনের। তিনি বললেন, ‘ছাত্র-ছাত্রীদের লেখাপড়া, দুপুরের খাবার ও পাঁচ শিক্ষকের বেতন হিসেবে মাসে ২৫ হাজার টাকা লাগে। তার অর্ধেক টেক্সপ্রেগ্রো দেয়। বাকিটা জোগাড় করতে হয়। স্কুলের পাঁচটি রুমের ভাড়া সাড়ে পাঁচ হাজার ও মাসের বিদ্যুৎ বিল ৬০০ টাকা লাগে। এই টাকাও মেডিক্যালের ছাত্র-ছাত্রী ও আমাদের চাঁদায় ওঠে। টাকাগুলো কোনো আগ্রহী, দানশীল মানুষের কাছে পেলে টেনশন কমত। ’ নাজমুল বললেন, ‘ছাত্র-ছাত্রীদের বিভিন্ন বিষয় বোঝানোর জন্য একটি প্রজেক্টর খুব জরুরি। তারা মীনা কার্টুনসহ নানা শিক্ষণীয় বিষয় অডিও-ভিজ্যুয়ালে দেখলে ভালোভাবে শিখতে পারবে। কিন্তু সেই ৩৫ হাজার টাকা কোথায় পাব?’ আগ্রহীরা চাইলে যোগাযোগ করতে পারেন ডা. নাজমুল হোসাইন : ০১৭৩৭ ৭৯৯১০০। অ, আ, ক, খ-এর ফেসবুক অ্যাকাউন্ট—facebook.com/oakokho.school