দুই তরুণের মুক্তিযুদ্ধের ডিজিটাল আর্কাইভ
- লিডারশিপ ডেস্ক
তাঁরা মুক্তিযুদ্ধ দেখেননি। বইয়ে পড়েছেন মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসী ঘটনা। বড়দের কাছে শুনেছেন ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাথা। দেশের জন্য মানুষের এই আত্মত্যাগ দুই তরুণকে আগ্রহী করে তুলেছে আরও জানতে। একসময় এই আগ্রহই তাঁদের নিয়ে গেছে দেশ-বিদেশের সংগ্রহশালায়। তাঁরা খুঁজে ফিরেছেন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। এই দুই তরুণ হলেন সাব্বির হোসাইন ও শান্তা আনোয়ার। তাঁরা গড়ে তুলেছেন মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ ট্রাস্ট। সাব্বির এই ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক এবং শান্তা সভাপতি।
এই ট্রাস্টের নানা উদ্যোগের একটি ‘মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ’। ইন্টারনেটভিত্তিক এই সংগ্রহশালায় রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের বই, দলিল, সে সময়ের পত্রপত্রিকা, মুক্তিযোদ্ধাদের গেজেট, তথ্যচিত্র, ভিডিও ফুটেজ, চলচ্চিত্র, অডিও ও আলোকচিত্র। মোটকথা এটি ডিজিটাল গণগ্রন্থাগার ও আর্কাইভ। ইন্টারনেট-সংযোগ থাকলেই জানা যাবে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অসংখ্য তথ্য। বর্তমানে ১২ জন গবেষক-কর্মী কাজ করছেন মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভে। ১৯৭১ থেকে এখন পর্যন্ত নানা তথ্য যুক্ত হচ্ছে এই আর্কাইভে।
মুক্তিযুদ্ধের সব বইপত্র, দলিল কিনতে পাওয়া যায় না। তা ছাড়া সামর্থ্যের বিষয়ও রয়েছে। প্রান্তিক পর্যায়ে কেউ যদি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিস্তারিত পড়াশোনা বা গবেষণা করতে চান, তাঁর পক্ষে তা বেশ কষ্টসাধ্য। আর এই সুযোগ করে দিতে উদ্যোগী হন সাব্বির ও শান্তা। সবার কাছে বিনা মূল্যে ও সহজে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস-পাঠ পৌঁছে দেওয়ার পরিকল্পনা করেন তাঁরা। মুক্তিযুদ্ধের তথ্য এক জায়গায় রাখার চিন্তাও করেন। তাঁরা উদ্যোগী হন একটি ডিজিটাল পাঠাগার গড়ে তোলার। এই পাঠাগারে থাকবে দেশ-বিদেশ থেকে পাওয়া মুক্তিযুদ্ধের তথ্য, দলিল ইত্যাদির ডিজিটাল রূপ। ইন্টারনেট ব্যবহার করে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে পাঠক-গবেষক এসব তথ্য বিনা মূল্যে পড়তে ও দেখতে পারবেন। এসব ভাবনা নিয়েই শুরু হয় সাব্বির ও শান্তার পথচলা। ই-পাঠাগারটির নাম দেওয়া হয় মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ।
যাত্রা হলো শুরু
২০১৬ সালের নভেম্বর মাসে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক ডিজিটাল গণগ্রন্থাগার মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভের। এর আগে ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ পাঠাগার ও গবেষণা কেন্দ্র’ নামে ২০০৭ সাল থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে থাকেন তাঁরা। ২০১৪ সালে পরীক্ষামূলক ওয়েবসাইট চালু করে পাঠক-গবেষক ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতামত নেওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ ট্রাস্টের নিবন্ধন হয় ২০১৬ সালের মার্চ মাসে।
যা আছে আর্কাইভে
ই-আর্কাইভে আছে প্রায় সাড়ে চার হাজার বই। মুক্তিযুদ্ধের দুর্লভ অনেক দলিল, মুক্তিযুদ্ধ ও পরবর্তী সময়ের উল্লেখযোগ্য ঘটনার পত্রিকাও (১৯৪৭ থেকে ২০০০ সাল) রাখা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের গেজেট ও বিভিন্ন তালিকা, শতাধিক প্রামাণ্যচিত্র, এক হাজারের বেশি ভিডিও ফুটেজ, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রায় পাঁচ হাজার আলোকচিত্র পাওয়া যাচ্ছে এই আর্কাইভে। অসংখ্য প্রবন্ধ-নিবন্ধ তো রয়েছেই।
ইংরেজিতে লেখা বই-প্রবন্ধ নিয়ে রয়েছে ইংরেজি বিভাগ। মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভে ১৫ খণ্ডের স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্র রয়েছে। আছে মুক্তিযুদ্ধ-সংক্রান্ত বিভিন্ন দেশের নথি, আন্তর্জাতিক পত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গবেষকদের প্রকাশিত প্রায় সব বইও এই আর্কাইভে পাওয়া যাচ্ছে। আরও রয়েছে মুক্তিযুদ্ধকালীন বিভিন্নজনের লেখা রোজনামচা ও স্মৃতিকথা। মুক্তিযুদ্ধের সময় লেখা উপন্যাস শহীদ বুদ্ধিজীবী আনোয়ার পাশার রাইফেল রোটি আওরাত; রয়েছে তরুণ লেখক মিজানুর রহমান খানের মুক্তিযুদ্ধের গল্প সোনার পরমতলাও। প্রায় ১৫ টেরাবাইটের (১০২৪ গিগাবাইট = ১ টেরাবাইট) তথ্য এই আর্কাইভে স্থান পেয়েছে। এ পর্যন্ত প্রায় ১৫ লাখ পাঠক মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ ব্যবহার করেছেন।
৩০ ভাগে তথ্য
ই-আর্কাইভে ৩০টি ভাগে তথ্যগুলো রাখা হয়েছে। চিরায়িত বাঙলা, ’৪৭-পূর্ব বাঙলা, পাকিস্তান আমল, ভাষা আন্দোলন, ’৫৪-র নির্বাচন, ছয় দফা, আগরতলা মামলা ও ’৬৯-এর অভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচন ও অসহযোগ আন্দোলন, অপারেশন সার্চলাইট, স্বাধীনতার ঘোষণা, বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১, মুক্তিযুদ্ধ-মুক্তিযোদ্ধা ও যুদ্ধের ইতিহাস, গণহত্যা-যুদ্ধাপরাধ এবং যুদ্ধাপরাধী ও তাদের বিচার, যুদ্ধশিশু এবং মুক্তিযুদ্ধে নারী ও শিশু, বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড, উদ্বাস্তু বাঙালি, বিদেশিদের ভূমিকা ও দৃষ্টিভঙ্গি, সময়ক্রম এবং স্মৃতিকথা, শিল্প-সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, ব্যক্তিবিশেষের ভূমিকা, মুক্তিযোদ্ধাদের নামীয় তালিকা, স্বাধীন বাংলা বেতার, ৭১-পরবর্তী বাংলাদেশ, মৌলবাদ ও সংখ্যালঘু নির্যাতন, রাজনীতি, বিতর্ক ও ভিন্নমত, পাকিস্তান ও দোসরদের ভাষ্য, মুক্তিযুদ্ধের ছবি, মুক্তিযুদ্ধের ডকুমেন্টারি-ভিডিও ফুটেজ ইত্যাদি নামে বিভাগগুলো ভাগ করা হয়েছে।
মর্টার আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছেন কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাউদ্যোক্তারা জানালেন, মুক্তিযুদ্ধের দলিলগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে বিভিন্ন সংগ্রাহক, ব্রিটিশ লাইব্রেরি, যুক্তরাষ্ট্রের লাইব্রেরি অব কংগ্রেস, সুইডেন, অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন লাইব্রেরিসহ দেশি-বিদেশি সংগ্রহশালা থেকে। এ ছাড়া ‘মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভে’ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক যেসব কনটেন্ট পাওয়া যাচ্ছে, তা সংগ্রহে ও ডিজিটাইজেশনে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা নেওয়া হয়েছে।
লক্ষ্য মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস সংরক্ষণ
সাব্বির হোসাইন বললেন, ‘ইতিহাসের সঠিক পাঠ ও শিক্ষা বাংলাদেশে যদি যথাযথভাবে চর্চা করা হতো, তবে স্বাধীনতাবিরোধী পক্ষ কখনো নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারত না। ঠিক এই জায়গাতেই কাজ করছে মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ। আমরা মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস ডিজিটাল মাধ্যমে সংরক্ষণ ও সর্বস্তরে পৌঁছে দেওয়ার কাজ করছি।’
শান্তা আনোয়ার প্রবাসে ছিলেন দীর্ঘদিন। বললেন, ‘বাংলাদেশ আমাকে সব সময় টানত। তাই ফিরে আসি দেশে। সাব্বিরের সঙ্গে আমার চিন্তাচেতনার মিলে যায়। এরপর দুজন মিলেই মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিই। আমাদের প্রত্যাশা, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পৌঁছে দেওয়ার পাশাপাশি এটি ইতিহাস বিকৃতির হাত থেকে মুক্তিযুদ্ধকে রক্ষা করবে।’
মিলেছে স্বীকৃতি
মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশে ইতিহাসের ওপর বড় রকমের ডিজিটাল আর্কাইভ হওয়ার কারণ যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব ইক্সেটারের হিউম্যানেটিস কলেজের ‘দ্য ইক্সেটার সাউথ এশিয়া সেন্টার’ তাদের একাডেমিক রিসোর্স ম্যাটেরিয়াল সেকশনে মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ ট্রাস্টকে অন্তর্ভুক্ত করেছে।
আরও উদ্যোগ
মুক্তিযুদ্ধের ডিজিটাল লাইব্রেরি ও আর্কাইভের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের জাদুঘর নির্মাণের লক্ষ্যে বর্তমানে কাজ করছে মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ। প্রাথমিকভাবে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ও নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক জাদুঘর গড়ে তোলার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ ছাড়াও রয়েছে আরও দুটো প্রকল্প—মুক্তিযুদ্ধ পাঠশালা এবং গবেষণা ও প্রকাশনা কেন্দ্র। মুক্তিযুদ্ধ পাঠশালার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার শিক্ষা নিয়ে উন্মুক্ত কর্মশালা করা হয়। আর গবেষণা ও প্রকাশনাকেন্দ্র থেকে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নানা ধরনের প্রকাশনা বের করা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো অফেন্ডিং জিয়া, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি বন্ধে আইন চাই এবং যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর রায়ের পূর্ণ বিবরণ।
মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ ট্রাস্টের যাবতীয় ব্যয় ট্রাস্টিরা নিজেরাই বহন করার চেষ্টা করেন। কিন্তু যখন তা সামর্থ্যের বাইরে চলে যায়, তখন দেশি-বিদেশি অনেকের সহায়তা নেওয়া হয়।
মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভের ওয়েব ঠিকানা: www.liberationwarbangladesh.org