কষ্ট করে বড় হয়েছেন সুন্দর পিচাই
- লিডারশিপ ডেস্ক
সুন্দর পিচাইসুন্দর পিচাই নামটির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। তিনি গুগলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। ১২ জুলাই ৪৫ বছর পূর্ণ করেছেন ভারতে জন্ম নেওয়া সুন্দর পিচাই। সামান্য এক মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা সুন্দর পিচাই জীবনের অনেক কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে সফলতার শীর্ষে পৌঁছেছেন। চলুন জেনে আসি তাঁর জীবনের ইতিহাস।
ভারতের চেন্নাইয়ে শৈশব কেটেছে গুগলের বর্তমান প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার। সুন্দর পিচাইয়ের জন্ম ভারতের তামিলনাড়ুতে। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (আইআইটি) খড়গপুর থেকে প্রযুক্তিতে স্নাতক সম্পন্ন করেন তিনি। পরে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতকোত্তর শেষ করেন। বিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশোনা করার পর তিনি পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়ার্টন স্কুল থেকে এমবিএ করেন।
খুব সাধারণ একটি পরিবারে জন্ম সুন্দর পিচাইয়ের। জন্মের আগে তাঁর মা স্ট্যানোগ্রাফার হিসেবে কাজ করতেন। বাবা রঘুনাথ পিচাই ছিলেন একটি কারখানার বিদ্যুৎ মিস্ত্রি। দুই কামরার ছোট্ট একটি বাসায় থাকতেন। একটিতে ছোট ভাইকে নিয়ে সুন্দর ঘুমাতেন। ছোটবেলায় তাঁদের বাড়িতে কোনো টিভি ছিল না। ছিল না গাড়ি। যাতায়াতের জন্য তাঁকে সব সময় বেছে নিতে হয়েছে বাস বা বাবার স্কুটার। কোথাও যেতে হলে এক স্কুটারে চারজনকে যেতে হতো।
সুন্দর পিচাইয়ের সবচেয়ে বড় গুণ হচ্ছে স্মৃতিশক্তি বা মুখস্থ রাখার ক্ষমতা। সুন্দরের বয়স যখন ১২ বছর, তখন তাঁর পরিবারে প্রথম টেলিফোন সেট আসে। এই টেলিফোন প্রযুক্তির প্রতি তাঁর আকর্ষণ আরও বাড়িয়ে দেয়। যে নম্বরে সুন্দর ডায়াল করতেন, তাই মনে রাখতে পারতেন।
ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনায় ভালো ছিলেন সুন্দর। আইআইটি খড়গপুরে স্নাতকে ভালো ফলাফল করেন। স্ট্যানফোর্ডে ম্যাটেরিয়াল সায়েন্স অ্যান্ড সেমি কন্ডাক্টর ফিজিকস নিয়ে পড়ার জন্য বৃত্তি পান। স্কুলে বরাবর ভালো ফল করা সুন্দর ছিলেন ক্রিকেট ক্যাপ্টেন। ফুটবলের দারুণ ভক্ত। এরপর আইআইটি খড়গপুর। যেখানে প্রায়ই তাঁকে দেখা গেছে ক্ষয়ে আসা হাওয়াই চপ্পল পায়ে। এ নিয়ে ভাবেননি। পড়াশোনা করেছেন মন দিয়ে। তাঁর স্কুলের এক শিক্ষক বলেন, ‘প্রতিটি নম্বরের জন্য যুদ্ধ করেছে সুন্দর। বিশেষ করে গণিত ও পদার্থবিদ্যায়। কখনো ভুল করলে তা শুধরে বারবার করার চেষ্টা করেছে।’
বিদেশে পড়তে গেলে যে খরচ, তা নিয়েই সমস্যায় পড়তে হয় সুন্দরের বাবাকে। বিমানের টিকিট, থাকা-খাওয়ার খরচ—সব মিলিয়ে অনেক টাকার দরকার। কিন্তু ঋণ জোগাড় করতে পারেননি বাবা। তবু হাল ছাড়েননি। নিজের অ্যাকাউন্ট প্রায় খালি করে তুলে দিয়েছেন জমানো টাকা। যা তখন তাঁর এক বছরের বেতনের থেকেও বেশি। পিচাই বলেন, ‘এ অবস্থায় আর দশজন মা-বাবা যেটা করেন আমার মা-বাবাও তাই করলেন। আমার পড়াশোনার খরচ চালানোর জন্য তাঁদের জীবনের অনেক স্বপ্নই আমার জন্য বিসর্জন দিলেন।’
১৯৯৩ সালে স্ট্যানফোর্ডে পৌঁছানোর পর একটা ব্যাকপ্যাক কেনার দরকার পড়ল সুন্দরের। যখন জানতে পারলেন এর দাম ৬০ মার্কিন ডলার, তখন তিনি একেবারেই দমে গেলেন। পরে পুরোনো একটি ব্যাকপ্যাক জোগাড় করে কাজ চালিয়েছেন তিনি। স্ট্যানফোর্ডে যাওয়ার পর প্রথম বছর একজনের বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করেছেন।
২০১৩ সালে তিনি অ্যান্ড্রয়েড প্রতিষ্ঠাতা অ্যান্ডি রুবিনের কাছ থেকে অ্যান্ড্রয়েড বিভাগের দায়িত্ব নেন। ২০১৪ সালে অ্যান্ড্রয়েড ওয়ান নামের একটি প্রকল্প ভারতে চালু করেন পিচাই। এ প্রকল্পটির উদ্দেশ্য ছিল সাশ্রয়ী দামের স্মার্টফোন তৈরি করা। ২০১৪ সালে গুগলের প্রতিষ্ঠাতা ল্যারি পেজের সেকেন্ড ইন কমান্ড হন তিনি।
স্ট্যানফোর্ডে পিএইচডি সম্পন্ন করে একাডেমিক ক্যারিয়ার গড়ার চিন্তা করেছিলেন সুন্দর পিচাই। তবে পরে সে চিন্তা থেকে সরে গিয়ে সিলিকন ভ্যালির সেমিকন্ডাক্টর নির্মাতা অ্যাপ্লাইড ম্যাটেরিয়ালসে চাকরি নেন। এরপর ২০০২ সালে পেনসিলভানিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে এমবিএ করার পরিকল্পনা করেন। ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল গুগলে চাকরির জন্য সাক্ষাৎকার দিতে আসেন। ওই দিন গুগল বিনা মূল্যের মেইল সেবা জিমেইল চালু করে। পিচাই বলেন, তিনি গুগলের এই জিমেইলকে ভেবেছিলেন ‘এপ্রিল ফুল’ বানাতে, গুগল যে ধরনের মজা করে জিমেইল সে রকমই একটা কিছু হবে।
গুগলে চাকরি হয়ে যায় সুন্দরের। এরপর ধীরে ধীরে পরিচিত হন গুগলের করপোরেট সংস্কৃতির সঙ্গে। নতুন নতুন ধারণা দিয়ে গুগলের প্রতিষ্ঠাতা ল্যারি পেজের আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন। মারিসা মেয়ার, অ্যান্ডি রুবিন, কামাঙ্গার, হুগো বাররা, ভিক গানডোটরার মতো সহকর্মীদের পেছনে ফেলে তরতর করে উঠতে থাকেন ওপরের পদে। ২০১৫ সালের আগস্টে এসে গুগলের সিইও তিনি।
২০০৪ সালে গুগলে যোগ দেওয়ার আগে পিচাই ম্যাকেনসি অ্যান্ড কোম্পানিতে চাকরি করেছেন। ২০০৪ সালের এপ্রিলে জিমেইল চালুর দিনে সাক্ষাৎকার দেন তিনি। তিনি শুরুতে ভেবেছিলেন জিমেইল হয়তো মজা করার জন্য তৈরি করেছে গুগল। গুগল ক্রোম ও ওস বিভাগের পণ্য ব্যবস্থাপনা দলের নেতৃত্ব দিতে যোগ দেন তিনি। এ ছাড়া গুগল ড্রাইভ, জিমেইল ও ম্যাপস সেবা তাঁর দায়িত্বে ছিল।
পিচাই দুর্দান্ত একজন ব্যবস্থাপক। মৃদুভাষী ও দীর্ঘদিন ল্যারি পেজের বিশ্বস্ত হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। মারিসা মেয়ারের অধীনে কাজ করার সময় দলের প্রতি দারুণ আনুগত্য দেখান তিনি। তখন গুগলে তিনি নির্বাহী হিসেবে কাজ করতেন। দ্য ইনফরমেশনের তথ্য অনুযায়ী, নিজের দলের কর্মীরা যাতে ভালো নম্বর পায়, সে জন্য মারিসা মেয়ারের অফিসের সামনে ঘণ্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করেছেন সুন্দর পিচাই। দল ব্যবস্থাপনার দক্ষতা ছাড়াও প্রয়োজনে নিজের দৃড়তা দেখিয়েছেন তিনি। একবার লাস ভেগাসে গুগল ও স্যামসাংয়ের কথাবার্তার মধ্যে স্যামসাং কর্তৃপক্ষকে চুক্তি বাতিল করার হুমকি দিয়েছিলেন তিনি।
সুন্দর পিচাইকে নিয়োগ দিতে টুইটার ও মাইক্রোসফটের মতো প্রতিষ্ঠান চেষ্টা করেছে। ২০১১ সালে জ্যাসন গোল্ডম্যানের পরিবর্তে সুন্দর পিচাইকে টুইটারের দায়িত্ব নেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হলে তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। একসময় মাইক্রোসফট তাঁকে গুগল থেকে সরে আসতে বলে। তবে গুগল কর্তৃপক্ষ তাঁকে ছাড়েনি। ২০১৬ সালে গুগল তাঁকে ২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বেতন দিয়েছে। যা বাংলাদেশি টাকায় ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকার বেশি।
এক নজরে সুন্দর পিচাই
নাম: পিচাই সুন্দারারাজন (সুন্দর পিচাই)
জন্ম: ১২ জুলাই ১৯৭২, তামিলনাড়ু, মাদ্রাজ, ভারত
শিক্ষা: বিটেক (ভারত), এমএস (ইউএসএ), এমবিএ (ইউএসএ)
পদ: গুগলের সিইও
স্ত্রী: অঞ্জলি পিচাই