একজন অচ্ছুত সামন্তের গল্প
- লিডারশিপ ডেস্ক
ভারতের উড়িষ্যার আদিবাসী অঞ্চলের প্রায় ২৫ হাজার মানুষের জীবন বদলে দিয়েছেন ড. অচ্ছুত সামন্ত। তিনি আদিবাসী ছিন্নমূল শিশুদের জন্য ভারতের ভুবনেশ্বরে গড়ে তুলেছেন দুটি বিশ্বমানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান—কলিঙ্গ ইন্সিটিটিউট অব ইন্ডাস্ট্রিয়াল টেকনোলজি (কিট) ও কলিঙ্গ ইন্সটিটিউট অব সোস্যাল সায়েন্স (কিস)। অচ্ছুত সামন্তকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে মূলত কলিঙ্গ ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল সায়েন্স এবং এর ১৫ হাজার আদিবাসী ছাত্রছাত্রী। এখানে পড়ার সুযোগ রয়েছে প্রথম শ্রেণি থেকে একদম স্নাতকোত্তর পর্যায় পর্যন্ত এবং প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য রয়েছে বিনামূল্যে থাকা, খাওয়া, বিনোদন, খেলাধুলা, স্বাস্থ্যসেবা, কম্পিউটার ল্যাব, কনফারেন্স ল্যাব ও ওয়াই-ফাই সিস্টেমের ব্যবস্থা। এছাড়া এখানে প্রত্যেক শিক্ষার্থী পড়ালেখার সঙ্গে সঙ্গে পায় কারিগরি প্রশিক্ষণ।
অচ্ছুত সামন্ত ১৯৬৫ সালে ভারতের উড়িষ্যার এক ছোট্টগ্রাম কটাক্কার কালাব্রাঙ্কায় জন্ম গ্রহণ করেন। তার বাবার নাম অনাদীচরণ এবং মায়ের নাম নীলিমা রানি। যখন ৪ বছর বয়স অচ্ছুত সামন্তের তখন তার পিতা পরলোক গমন করেন। বাবাকে হারিয়ে নিদারুণ দুর্দশা নেমে আসে সামন্তের পরিবারে। কারণ বাবাই ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী। এ অবস্থায় সংসারের হাল ধরতে মায়ের সঙ্গে অন্যের বাসায় কাজ শুরু করেন ছোট্ট সামন্ত। এর মধ্য দিয়েই কালাবাঙ্কের সরকারি স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে অদম্য অচ্ছুত এবং পরবর্তীতে তিনি মাস্টার্স সম্পন্ন করেন রসায়ন শাস্ত্রে, উৎকল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। মাস্টার্স শেষ করেই চাকরিতে ঢুকে যান মহেশ্বরী কলেজে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে। এই কলেজে প্রায় ১০ বছর শিক্ষকতা করেন অচ্ছুত সামন্ত। কিন্তু তার স্বপ্ন ছিল অন্যরকম। তাই সুখের জীবনের হাতছানি উপেক্ষা করে পা বাড়ালেন সমাজ সেবায়। সিদ্ধান্ত নিলেন দুস্থ আদিবাসীদের জীবন পরিবর্তনের জন্য একটি দক্ষ উন্নয়ন কেন্দ্র গড়ে তুলবেন। কিন্তু ততোটা আর্থিক সামর্থ ছিল না তার। তাতে কি? নিজের জমানো ৫ হাজার টাকা সম্বল নিয়েই মাঠে নামলেন। এভাবেই ১৯৯২ সালে যাত্রা শুরু হলো কেআইআইটি ও কেআইএসএস নামের দুটি বিশ্বমানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের।
কিট এর শিক্ষার্থীদের ফি দিয়ে তিনি কিস পরিচালনা শুরু করেন। কিন্তু কিট থেকে কিস এর যাত্রা এত সহজ ছিল না। অনেক লড়াই সংগ্রাম করতে হয়েছে তাকে। প্রথম দিকে শিক্ষার্থী ছিল মাত্র ২৫ জন। কারণ আদিবাসীরা তার সন্তানদের ঘর থেকে অন্য কোথাও যেতে দিতে চাইতেন না। ফলে শিশুদের স্কুলে আনতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে অচ্ছুত সামন্তকে। এরপর ধীরে ধীরে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। এক সময় কিট একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়। এখানে প্রথম শ্রেণি থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ রয়েছ। বর্তমানে দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মিলিয়ে প্রায় ২৭ হাজার শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। বলে রাখা ভালো, কিট এর শিক্ষার্থীদের প্রদেয় ফিসের ১০ শতাংশ ব্যয় হয় কিস এর শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা পরিচালনার জন্য। আর কিট এর সকল শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনের ৩০ ভাগ প্রদান করা হয় কিস পরিচালনা ফান্ডে। কারণ কিসের দুস্থ শিক্ষার্থীদের থাকার জন্য হোস্টেল, চিকিৎসার জন্য মেডিকেল সার্ভিস, তিন বেলা খাবার, তার মধ্যে সকালের নাস্তা, দুপুরের খাবার ও রাতের খাবার প্রদান করা হয়। খাবারগুলো ভরপুর পুষ্টি উপাদান সমৃদ্ধ।
ড. সামন্ত নিজের সাথে সাথে মায়ের স্বপ্ন ও পূরণ করছেন। তার মায়ের স্বপ্ন ছিল, তার গ্রাম কালাব্রাঙ্কাকে একটি স্মার্ট বিদেশি শহরে পরিণত করতে হবে। মায়ের সেই স্বপ্ন পূরণ করতে লাগাতার কাজ করে যাচ্ছেন ড. অচ্ছুত। কালাব্রাঙ্কা এখন ভারতের প্রথম গ্রাম, যেখানে প্রত্যেক নাগরিকের স্বাস্থ্য বিমা রয়েছে। এটি গ্রাম হয়েও শহরের মত সকল সুযোগ রয়েছ। যেমন হাইস্কুল থেকে কলেজে পড়ার সুবিধা, পোষ্ট অফিস , ব্যাংক , ইন্টারনেট আরো কত কি!!
কিস-এর সাফল্যের জন্য ড. সামন্ত বলেন, কিস-এর উন্নতি ও সাফল্যের জন্য অনেক মানুষ তাকে অনেকভাবে সাহায্য করেছেন। তিনি কেবলি তা ফেরত দেবার প্রতিদান চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বললেন, আমি আমার জীবনের ২৫ বছর ক্ষুধার জন্য কষ্ট করেছি। এখন আমি হাজার শিশুর ক্ষুধামুক্তির জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছি।
অচ্ছুত সামন্ত এ পর্যন্ত ২৫টি উপাসনালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি ২০০০ সাল থেকে ‘খুদে মিস ইন্ডিয়া’ প্রতিযোগিতার আয়োজন করে আসছেন। এছাড়া মহাত্মা গান্ধীর স্মরণে একটি আদিবাসী জাদুঘর নির্মাণ করছেন যার নাম ‘গান্ধী গ্রাম’। তিনি তাঁর কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ দক্ষিণ কোরিয়ার হানসিওসহ ভারতের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশের ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি পেয়েছেন। এছাড়া দক্ষিণ আফ্রিকা, কম্বোডিয়া, শ্রীলঙ্কা, সিঙ্গাপুর প্রভৃতি দেশ থেকে পেয়েছেন নানা পুরস্কার।