দেড়শ’ টাকায় ক্যান্সার নির্ণয় !
- লিডারশিপ ডেস্ক
গত কয়েকবছর ধরে ক্যান্সার নিয়ে গবেষণা করছেন অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী বাংলাদেশি বিজ্ঞানী ড. মুহাম্মদ জহিরুল আলম সিদ্দিকী। পেয়েছেন সাফল্যও। অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেনের গ্রিফিথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষকের গড়া গবেষণাগারে কাজ করছেন বিভিন্ন দেশের ১৩ জন গবেষক। জহিরুলের নেতৃত্বে তারা উদ্ভাবন করেছেন প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যান্সার শনাক্ত করার উপায়। উদ্দেশ্য ছিল, স্বল্প খরচে ক্যান্সারের মতো রোগকে প্রাথমিক অবস্থায় শনাক্ত করা, যাতে নিম্নআয়ের দেশের মানুষেরা যেন এই রোগের সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে সর্বসান্ত না হয়। জহিরুল তার এই গবেষণায় সাফল্য অর্জন করে গৌরব বয়ে এনেছেন পুরো বাংলাদেশের জন্য।
সুনামগঞ্জের ছোট্ট এক গ্রাম জয়শ্রীর হাওড়পাড়ে বেড়ে ওঠা জহিরুল আলম সিদ্দিকী অনেকের কাছে পরিচিত ‘শামীম’ নামে। ছোটবেলা থেকেই কবিতার পোকা ছিলেন তিনি। তবে তার বেড়ে ওঠা কবিতার মতো ছন্দময় ছিল না। অভাব ছিল নিত্যসঙ্গী। মাত্র ক্লাস সিক্সে পড়ার সময়ই পড়ালেখা বন্ধের উপক্রম হয়। ওইটুকু বয়সেই বিভিন্ন বাড়িতে লজিং থাকা শুরু করেন। শুরু হয় তার অন্য এক যুদ্ধ। লজিং থেকেও সিলেট শহরতলীর রেবতি রমণ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে রেকর্ড নম্বর নিয়ে এসএসসি পাস করেন। সিলেটের এমসি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করার পর পড়াশোনা করেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে। সেখানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের পর দক্ষিণ কোরিয়ার পুসান জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পাড়ি জমান বিশ্লেষণী রসায়নে পিএইচডি করার জন্য। তার পিএইচডি গবেষণাপত্র পৃথিবীর নামকরা সব জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। গ্রিফিথ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ার আগে তিনি কাজ করেছেন অস্ট্রেলিয়ার মনাশ ও কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে।
সম্প্রতি আরেক বাংলাদেশি বিজ্ঞানী অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব উলংগংয়ের শিক্ষক ড. শাহরিয়ার হোসেনের নেতৃত্বে আরও একদল গবেষক জহিরুলের সঙ্গে একজোট হয়ে কাজ করেন। স্বল্প খরচে প্রাথমিক অবস্থায় ক্যান্সার শনাক্তের লক্ষ্যে তারা আরও এগিয়েছেন। সম্পূর্ণ নতুন পদ্ধতিতে আয়রন অক্সাইডের সঙ্গে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোল্ড পার্টিকেলের সংযুক্তিতে একটি বিশেষ পার্টিকেল তৈরি করেছেন তারা, যেটি প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যান্সারের উপস্থিতি জানান দেবে।
ড. সিদ্দিকী বলেন, আমাদের গবেষণার প্রথম ও প্রধানতম উদ্দেশ্য হলো, প্রযুক্তিটা যেন নিম্নআয়ের মানুষের কাজে লাগে, যাদের প্রচলিত ব্যয়বহুল ক্যান্সার ব্যবস্থাপনার ভিতর দিয়ে যাওয়ার সাধ্য নেই। এটির জন্য দক্ষ টেকনিশিয়ান বা কোটি টাকার যন্ত্রপাতি—কোনোটিরই দরকার নেই। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর ব্লাড সুগার টেস্ট বা কোনো নারীর প্রেগন্যান্সি টেস্টের উপায় এখন হাতের নাগালে। ওষুধের দোকান থেকে কম দামে কেনা সাধারণ যন্ত্রেই এসব তথ্য জানা যায়। একইভাবে যে কেউ ঘরে বসে শুধু কয়েক ফোঁটা রক্ত থেকেই খুব সাধারণ কিছু যন্ত্রপাতির ব্যবহারে, খালি চোখে রং পরিবর্তন দেখে, প্রাথমিক অবস্থায় ক্যান্সার আছে কি নেই—সেটি জানতে পারবে। ক্যান্সার শনাক্ত করার জন্য প্লাস্টিকের অ্যাপেন ড্রপে কয়েক ফোঁটা রক্ত, লালা বা প্রস্রাবের নমুনা নিয়ে এতে বায়োমার্কারযুক্ত ক্ষুদ্র ধাতব কণা যোগ করা হয়। শরীরে ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়ার মাত্রা অনুযায়ী রক্তসহ অন্যান্য নমুনার রং বদলাবে।
এই গবেষণা ও উদ্ভাবনের কথা এরমধ্যেই বিভিন্ন দেশের নামকরা জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। প্রযুক্তিটি উন্মুক্ত করা হয়েছে, বাংলাদেশে যা বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করলে খরচ হবে মাত্র দেড়শ টাকা।
কৈশোর থেকে জীবনযুদ্ধে নামা জহিরুল স্ত্রী সিরাত সিদ্দিকী, ছেলে ইওয়ান আর মেয়ে রিদাকে নিয়ে অস্ট্রেলিয়াতে থিতু হলেও এখনো তার ভাটি অঞ্চলে ফেলে আসা অতীতকে খুঁজে বেড়ান। গবেষণায় একের পর এক সাফল্য পেলেও বাংলাদেশ তাকে বারবার টানে। আর সুযোগ পেলেই বাংলাদেশি ছাত্রছাত্রীদের তিনি তার গবেষণাগারে বৃত্তিসহ পিএইচডি ও মাস্টার্সে সুযোগ করে দেন। তার দলে পাঁচজন বাংলাদেশি শিক্ষার্থী কাজ করছেন। এদের মধ্যে রয়েছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক মোস্তফা কামাল ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন থেকে স্নাতকোত্তর করা নাজমুল ইসলাম শিপলু।
২০১৫ সালে অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল হেলথ অ্যান্ড মেডিক্যাল রিসার্চ কাউন্সিল জহিরুলের গবেষণায় সহায়তার জন্য দুই কোটি আশি লাখ টাকার অনুদান দেয়। বাংলাদেশে সরকারি বা বেসরকারিভাবে সহযোগিতা পেলে জহিরুল দেশেও গড়ে তুলতে চান আধুনিক গবেষণাগার। উদ্ভাবন করতে চান নতুন নতুন প্রযুক্তি, যা সাহায্য করবে পৃথিবীর অগণিত নিম্নআয়ের মানুষদের। তিনি চান না, ক্যান্সার বা অন্যকোনো কঠিন রোগের চিকিৎসা করতে গিয়ে কোনো পরিবার ভেঙে পড়ুক, অর্থের অভাবে তাদের স্বপ্নভঙ্গ হোক।