শখ থেকে মাইক্রোসফটে
- লিডারশিপ ডেস্ক
‘ভিডিও গেম খেলা আমার শখ। অবসর সময়ে তো বটেই, এমনিতে সুযোগ পেলেই খেলি। কেউ জিজ্ঞেস করলে অজুহাত খাড়া করি—এটা আমার কাজেরই অংশ।’ কাজী নাঈম আল রশীদ ‘অজুহাত’ বললেও আসলে গেম নিয়েই তাঁর কাজ। নিজে যতটা না খেলেন, তার চেয়ে বেশিই খেলান দুনিয়াজুড়ে থাকা অসংখ্য গেমপ্রেমীকে।
শীর্ষ সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান মাইক্রোসফট করপোরেশনের নাম কারোরই প্রায় অজানা নয়। তেমনি গেমভক্তদের কাছে এক্সবক্স নামটাও অপরিচিত নয়। বরং জনপ্রিয়। মাইক্রোসফটের গেম খেলার যন্ত্র (কনসোল) এক্সবক্সের দাপট ভিডিও গেমের দুনিয়ায় কম নয়। এক্সবক্সের গেমগুলো কম্পিউটারে খেলা যায়, আর এখন অনলাইনেও খেলা যায়—কয়েকজন কিংবা আরও অনেক বেশি খেলোয়াড়ের সঙ্গে। দুনিয়ার তাবৎ এক্সবক্স গেমারের (গেম খেলোয়াড়) একটি মিলনমেলা এক্সবক্স লাইভ। ‘এককথায় বলতে পারেন অনলাইনে এক্সবক্স গেমভক্তদের একধরনের সামাজিক যোগোযোগমাধ্যম এক্সবক্স লাইভ।’ বললেন কাজী নাঈম আল রশীদ।
বাংলাদেশের এই তরুণ সফটওয়্যার প্রকৌশলীর পেশাগত অবস্থানটা এবার বলা যাক। এতক্ষণে তো বোঝা যাচ্ছে কাজী নাঈম আল রশীদ মাইক্রোসফটে কাজ করেন। তিনি এক্সবক্স লাইভের গ্রুপ ইঞ্জিনিয়ারিং ম্যানেজার। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন অঙ্গরাজ্যের রেডমন্ডে মাইক্রোসফটের সদর দপ্তরই তাঁর কর্মস্থল। এক্সবক্স লাইভের দুটি গ্রুপের একটি হলো ডেভেলপারদের নিয়ে, যাঁরা গেমগুলো তৈরি করেন কম্পিউটার প্রোগ্রামিং করে। নাঈম যে প্রকৌশল গ্রুপের নেতৃত্ব দেন, তাঁদের কাজ নেপথ্যে থেকে ১০ কোটির বেশি সদস্যের (প্রতিদিন এক কোটি ব্যবহারকারী অনলাইনে থাকেন) এক্সবক্স লাইভকে সচল রাখা, ব্যবহারকারী বাড়ানো। তাঁর সঙ্গে দুটি দলে কাজ করেন ৪২ জন। একটি দল মোবাইল ফোন ও ওয়েবে এক্সবক্স লাইভ নিয়ে কাজ করে, আরেকটি দলের কাজ হলো যোগাযোগ। এই যোগাযোগ হলো এক্সবক্স লাইভের গতিবিধি, ব্যবহারকারীদের নানা বিষয় বুঝে সেগুলো ডেভেলপার ও বিপণনকর্মীদের জানানো।
এই দুটি দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন কাজী নাঈম আল রশীদ। তাই তো তিনি বলতে পারেন, ‘গেম খেলাও আমার কাজের অংশ।’ মুঠোফোনে তিনি বললেন, ‘মাইক্রোসফটের কর্মীদের ডেস্কে কম্পিউটার মনিটর থাকে। আর সেসব কম্পিউটারে গেম খেলা নিষিদ্ধ। এদিকে এক্সবক্স বিভাগের কর্মীদের দেয়ালে থাকে টেলিভিশন আর একটা করে এক্সবক্স, যাতে তাঁরা গেম খেলতে পারেন।’
কম্পিউটার, ভিডিও বা গেম খেলাকে সময়ের অপচয়ই মনে করেন অনেকে। কিন্তু কিশোর–তরুণ থেকে বয়স্ক—অনেকেরই দুর্বার আকর্ষণ এই গেমের প্রতি। তাই তো গড়ে উঠেছে বিশাল আকারের গেমশিল্প। কাজী নাঈম আল রশীদ জানালেন, ব্যবসার দিক থেকে মাইক্রোসফটের মূল ভাগ বা পণ্য চারটি। এগুলো হলো ক্লাউড ও এন্টারপ্রাইজ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ও গবেষণা, এক্সপেরিয়েন্সেস ও যন্ত্র এবং মাইক্রোসফট গেমিং (এক্সবক্স)। একটা সময় অপারেটিং সিস্টেম উইন্ডোজ ছিল মূল ব্যবসার একটা। প্রযুক্তি পাল্টেছে, তাই মূলধারার ব্যবসাতেও পরিবর্তন এনেছে মাইক্রোসফট। প্রতিষ্ঠানটির এক লাখ কর্মীর চার হাজার জন কাজ করেন এক্সবক্স নিয়ে। গত বছর এক্সবক্সের রাজস্ব আয় ছিল এক হাজার কোটি ডলারের বেশি।
মাইক্রোসফটে কাজী নাঈম আল রশীদ যোগ দেন ২০০৬ সালে। কম্পিউটারের সঙ্গে পরিচয় ১৯৯৯ সালে। ই–মেইল যোগাযোগে তিনি বলেন, ‘১৯৯৯ সালে আমার বাবা তখনকার একেবারে নতুন পেন্টিয়াম টু প্রসেসরের কম্পিউটার কিনে দেন। প্রথম প্রথম অন্যদের মতো আমিও কম্পিউটার গেম খেলতাম। পাশাপাশি প্রোগ্রামিং ভাষা সি শিখতে শুরু করি। কোনো কিছু নিয়ে বিশ্লেষণ করা, সমস্যার সমাধান করা আর সৃজনশীলতা আমাকে প্রোগ্রামিংয়ের প্রতি আগ্রহী করে তোলে।’
দাদার বাড়ি মাদারীপুর হলেও ১৯৮২ সালের ৯ নভেম্বর কাজী নাঈমের জন্ম পুরান ঢাকায়। কয়েক বছর পর অবশ্য তাঁরা মোহাম্মদপুরে থাকতে শুরু করেন। বাবা কাজী হারুন অর রশীদ ব্যবসায়ী, মা ফেরদৌসী বেগম গৃহিণী। নাঈমের দুই বোন—সামিরা অনন্যা পেশায় চিকিৎসক এবং সামিয়া ফেরদৌসী অস্ট্রেলিয়ার মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর করছেন। গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুল থেকে ১৯৯৭ সালে এসএসসি পরীক্ষায় সম্মিলিত মেধাতালিকায় ১১তম স্থান অর্জন করেন নাঈম। এরপর ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৯৯ সালে এইচএসসি পাস করে চলে যান অস্ট্রেলিয়ায়। যদিও তখন যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছিলেন, কিন্তু ছাত্র–ভিসা না পাওয়ায় সেখানে যাওয়া হয়নি। সফটওয়্যার প্রকৌশলে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নের আরএমআইটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ২০০৪ সালে সেখান থেকে স্নাতক হন কাজী নাঈম।
যখন স্নাতক তৃতীয় বর্ষে পড়ছিলেন নাঈম, তখন অস্ট্রেলিয়ার এজিলেন্ট টেকনোলজিসে শিক্ষানবিশি করেছেন। পাস করার পরই চাকরি পান সেখানে। এরপরের কর্মস্থল মাইক্রোসফট। স্নাতক হওয়ার পরই অস্ট্রেলিয়ান কম্পিউটার সোসাইটির (এসিএস) বর্ষসেরা শিক্ষার্থীর পুরস্কার পান তিনি। বললেন, ‘স্নাতক শেষ বর্ষে থাকতেই মাইক্রোসফটে আবেদন পাঠিয়েছিলাম। স্নাতক হওয়ার পর মাইক্রোসফটের নিয়োগপ্রক্রিয়ায় যুক্ত একজন আমাকে ফোন করলেন। তিনি বর্ষসেরা শিক্ষার্থী পুরস্কারের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলেন। এরপর সিডনিতে সরাসরি সাক্ষাৎকার নেওয়া হলো।’ এটা ছিল প্রাথমিক পর্যায়। এরপর পাঁচটা সাক্ষাৎকারেরে মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে নাঈমকে। সবকিছুর শেষে তিনি নিয়োগ পেলেন মাইক্রোসফটে। যোগ দিলেন সে সময়ের জনপ্রিয় বার্তা আদান–প্রদানের সফটওয়্যার এমএসএনে।
এরপর মাইক্রোসফটে দ্রুতই এগিয়ে যেতে থাকেন। মাইক্রোসফট লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড অর অ্যাবাভ অ্যান্ড বিওয়াইন্ড পান ২০১১ সালে, তার আগে ২০০৮–এ পেয়েছেন মাইক্রোসফট গোল্ডস্টার অ্যাওয়ার্ড। ‘শুরুর দিকে মাইক্রোসফটে পুরস্কার পাওয়া যায়। সিনিয়র হতে থাকলে চাকরিতে পদোন্নতি ঘটে।’ বললেন কাজী নাঈম। এর আগে পেয়েছেন এজিলেন্ট লিডারস অ্যাওয়ার্ড (২০০৫), অস্ট্রেলিয়ান কম্পিউটার সোসাইটি অ্যাওয়ার্ড (২০০৪) ও ডাইমেনশন ডেটা ইন্ডাস্ট্রি অ্যাওয়ার্ড (২০০৩)। ২০০৮ সালে ফেসবুকের জন্য এমএসএনের একটা অ্যাপ বানিয়েছিলেন কাজী নাঈম। সেটা বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। এটিসহ আরও কিছু সফটওয়্যারের পেটেন্ট রয়েছে তাঁর নামে।
কোডিং মানে প্রোগ্রামিং সংকেত লেখার কাজটা খুব ভালোবাসেন কাজী নাঈম। ‘কিন্তু এখন নিজে কোডিং করার সময় পাই না। পণ্য, মানুষ আর প্রযুক্তি নিয়ে এখন আমার কাজ। এক্সবক্স লাইভের ব্যবহারকারী বা গ্রাহক বাড়ানোই লক্ষ্য।’ প্রকৌশল গ্রুপের করা নানা অ্যালগরিদম, হিসাবনিকাশ, বিশ্লেষণ নাঈম তাঁর মহাব্যবস্থাপকের কাছে তুলে ধরেন, তারপর তৈরি হয় ব্যবসায় কৌশল।
মাইক্রোসফটে ১০ হাজারের বেশি কর্মী ভারতের, পাকিস্তানের ৫০০–এর বেশি। সেখানে বাংলাদেশের কর্মীর সংখ্যা ১৫০ জনের মতো। এ সংখ্যা ভাবায় কাজী নাঈমকে। তিনি বললেন, ‘মেধার দিক থেকে কিন্তু আমরা পিছিয়ে এমন নয়। তবে বাংলাদেশ থেকে সরাসরি নিয়োগ পেয়েছেন চার–পাঁচজন। আমি যেমন অস্ট্রেলিয়া থেকে পেয়েছি। তাই আমার মনে হয়, স্নাতক হওয়ার পর সাহস করে আবেদনটা করতে হবে। আর উচ্চশিক্ষার জন্য বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর উচিত ঋণ দেওয়া। ঋণ নিয়ে বাইরে উচ্চশিক্ষার পর সেই ছাত্র বা ছাত্রী যে চাকরি পাবেন, খুব স্বল্প সময়ের মধ্যেই ঋণের টাকা শোধ করে দিতে পারবেন। স্নাতক, স্নাতকোত্তর বা পিএইচডি যে ডিগ্রিই হোক, মাইক্রোসফটে সবাইকে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার লেভেল-১ পদে ঢুকতে হয়।’
নাঈমের বাবা মাদারীপুরে উদ্যম (uddam.net) নামে একটি সংস্থা চালান। নিয়মিত সেখানে সহায়তা করেন কাজী নাঈম। জানালেন, এই সংস্থার মাধ্যমে অদম্য মেধাবীদের উচ্চশিক্ষার জন্য নিয়মিত বৃত্তি দেওয়া হয়। এ ছাড়া তিনি কাউন্সিল অব আমেরিকান ইসলামিক রিলেশনস নামে যুক্তরাষ্ট্রের একটি নাগরিক অধিকার সংস্থায় স্বেচ্ছাসেবী হিসেবেও কাজ করেন। অবসরের বেশির ভাগ সময় দেন স্ত্রী লিজা শের–ই–আলম এবং তাঁদের দেড় বছরের মেয়ে লিয়ানকে।
প্রযুক্তির মানুষ, তাই প্রযুক্তি নিয়েই ভবিষ্যতের কথা ভাবেন কাজী নাঈম। প্রযুক্তিকে কীভাবে পরবর্তী যুগের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া যায়, তা নিয়ে কাজ করতে চান তিনি। বললেন, ‘আমরা সেই বিশ্বে থাকতে চাই, যেখানে প্রযুক্তি থাকবে এবং মানুষ অনেক মানবিক হবে।’