ফেসবুক থেকে মানুষের পাশে
- লিডারশিপ ডেস্ক
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের ভিন্নমাত্রার ব্যবহার করে দেশজুড়ে মানবসেবায় অনেকের কাছে এখন দৃষ্টান্তের নাম মামুন বিশ্বাস। জটিল রোগে আক্রান্ত রোগীর পাশে দাঁড়ান তিনি, যাদের কি-না ঠিকমতো দু’বেলা অন্নের জোগান দিতেই কষ্ট হয়। ফেসবুকে রোগীর ছবিসহ বিস্তারিত লিখে পোস্ট দেন আর ফেসবুক বন্ধুদের পাঠানো আর্থিক সহায়তায় চলে তাদের চিকিৎসা।
মানবসেবা আর অপরের উপকার করতে চাইলে দরকার একটু মনের ইচ্ছা আর একটি মাধ্যম। তেমনি এক পরোপকারী ব্যক্তির নাম মামুন বিশ্বাস। অনেকের কাছে যিনি এখন ফেসবুক বন্ধু হিসেবে পরিচিত। ফেসবুককে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে নিজেকে যুক্ত করেছেন মানবসেবায়। সারাদেশের বিভিন্ন জেলার অসহায় মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। দেখিয়েছেন নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন। দেখিয়েছেন আশার আলো।
সারাদেশে জটিল সব রোগে আক্রান্ত দরিদ্র মানুষের খোঁজ নিতে মামুন গণমাধ্যমের সাহায্য অথবা নিজেই এসব অসহায় মানুষের তথ্য সংগ্রহ করেন। এরপর তিনি ফেসবুকে সাহায্যের আবেদন করেন। অবাক ব্যাপার হলো, মামুন বিশ্বাসের এসব আহ্বানে দেশ ও দেশের বাইরে থেকে অনেকেই সাড়া দিয়ে অর্থ পাঠান তার কাছে। কারণ সেই বিশ্বাস তিনি অর্জন করেছেন ভিন্ন পদ্ধতিতে। যারাই সহযোগিতা পাঠাতেন তাৎক্ষণিকভাবে তিনি সেটি ফেসবুকের মাধ্যমে জানিয়ে দিতেন সবাইকে। এভাবে পর্যায়ক্রমে সবার সহযোগিতার টাকার পরিমাণ প্রকাশ করেন তিনি। তার এসব কর্মকাণ্ড ইতিমধ্যে প্রচার পেয়েছে দেশের সেরা ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদিতে। এরপর থেকেই সাধারণ মানুষের আস্থা ও ভালোবাসা বাড়তে থাকে।
শুরুর গল্পটা মামুন বিশ্বাসের ব্যক্তি জীবনকে ঘিরেই। প্রতিবন্ধীদের যে কী কষ্ট, মামুন তার প্রতিবন্ধী বোনকে দেখে বুঝতে পারেন। সেই সঙ্গে এক মর্মাহত ঘটনা অনুপ্রাণিত করে মামুন বিশ্বাসকে।
জন্মের মাত্র ৩৮ ঘণ্টার মাথায় মারা যায় মামুন বিশ্বাসের ছেলে। এক পিতার সামনে সন্তানের এই মৃত্যুই তাকে গভীরভাবে নাড়া দেয়। সন্তানকে বাঁচাতে তিনি দৌড়ে বেড়ান চারটি হাসপাতালে। কিন্তু তার সব প্রচেষ্টাই বিফলে যায়। মামুন জানান, সেই অর্থে তার টাকার অভাব ছিল না, কিন্তু তিনি তার ছেলেকে বাঁচাতে পারেননি। তিনি আরও বলেন, যাদের টাকা নেই বিষয়টি তাদের জন্য আরও কষ্টের। সেই ভাবনা থেকেই অসহায় মানুষের জন্য কিছু করার কথা তখনই মাথায় আসে।
২০১৫ সালের প্রথম দিকে মামুন একদিন খুকনী গ্রামে চা খাওয়ার জন্য তার বাইক থামান। পাশ দিয়ে ফেরদৌস নামের একটি বাচ্চা ছেলে মাটিতে হামাগুড়ি দিয়ে যাচ্ছে আর অন্য শিশুরা পা দিয়ে তাকে লাথি মারছে। ওই দৃশ্য মামুনের ভেতরটাকে নাড়া দেয়। সেদিন থেকে মাথায় কাজ করে ফেসবুকের মাধ্যমে প্রতিবন্ধীদের জন্য কিছু করার। এরপর ওই দোকানে গিয়ে সেই প্রতিবন্ধী শিশুটির তথ্য জোগাড় করেন। সেদিন রাতেই নিজের ফেসবুকে ওই শিশুকে নিয়ে পোস্ট দেন এবং সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। এরপর থেকেই মামুন একের পর এক কাজ করে যেতে থাকেন।
আস্তে আস্তে অসহায় ও প্রতিবন্ধীদের ঘিরে ফেসবুকে মামুনের একটা জগৎ গড়ে ওঠে।
এক সময় ফেসবুকে মামুনের এসব কর্মকাণ্ডকে অনেকেই ‘পাগল’ বলে সম্বোধন করেছেন। অনেকে অনেক উপহাস করেছেন। কিন্তু কেউ দমাতে পারেননি তাকে। এই কাজে মামুনের বাবা ডা. মাহবুবুল হোসেন ও বড় ভাই মুক্তা বিশ্বাসের অবদান এবং অনুপ্রেরণা সবচেয়ে বেশি বলে জানালেন মামুন।
অসহায় আনোয়ারার আকুতি
অজানা রোগে মুখ বিকৃতি হয়ে খাওয়া প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে, স্বামী ডিভোর্স দিয়েছে, আনোয়ারার জীবনে কোনো জয়ের আনন্দ নেই, আছে শুধুই পরাজয়ের গল্প। বাবার অভাবের সংসারে দু’বেলা দুমুঠো ভাতের জন্য সারাদিন চড়কায় সুতো তোলা থেকে শুরু করে সবই করতে হয় অসুস্থ শরীর নিয়ে আনোয়ারাকে। স্বামীকে নিয়ে সুখের সংসার ছিল। হঠাৎ মুখের ভেতরে একটা ছোট ফোঁড়া দেখা দেয়। আস্তে আস্তে সেটা বড় হতে থাকে। প্রথমে সিরাজগঞ্জ শহরে এসে অপারেশন করেন আনোয়ারা। কিছুদিন যেতেই আবার বাড়তে থাকে। পরে রাজশাহীতে অপারেশন করে কিন্তু কোনোভাবে তা কমে না। এদিকে এই অবস্থা দেখে স্বামী ডিভোর্স দেয় আনোয়ারাকে। অসহায় বাবার টাকা না থাকায় ভালো চিকিৎসা করাতে পারে না আনোয়ারা। সারাদিন বাড়িতে পড়ে থাকেন। লোকলজ্জার ভয়ে বাইরে যান না। সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর উপজেলার পুঠিয়া পশ্চিমপাড়া গ্রামের আনোয়ার হোসেনের মেয়ে আনোয়ারা।
আনোয়ার হোসেন অন্যের জমিতে কাজ করেন। মেয়ের চিকিৎসার ব্যয়ভার তার কাছে পাহাড় সমান। চিকিৎসকরা জানান, এক লাখ টাকা দরকার তার চিকিৎসার জন্য। আনোয়ারার খোঁজ পেয়ে ছুটে যান মামুন। ফেসবুকে আকুতি জানান সাহায্যের। অবশেষে মামুন বিশ্বাসের ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ার পর বিষয়টি নজরে আসে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব সিরাজুল ইসলামের এবং তার চিকিৎসার দায়িত্ব নেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। খুব দ্রুতই তার চিকিৎসা কার্যক্রম শুরু হবে বলে জানিয়েছেন মামুন বিশ্বাস। ইতিমধ্যে শাহজাদপুুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আলীমুন রাজীবের উপস্থিতিতে আনোয়ারার পরিবারের হাতে ৫৪ হাজার টাকা তুলে দেন মামুন বিশ্বাস।
স্বপ্ন দেখা ফজলুর গল্প
জন্মগতভাবে শারীরিক প্রতিবন্ধী ফজলুর রহমান। দুটি হাত ও একটি পা নেই তার। এক পা দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে চলাফেরা করে সে। দিনমজুর পিতা সাহেব আলী। বাড়ি সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলার ধুকুরিয়াবেড়া ইউনিয়নের গোপালপুর গ্রামে। প্রবল ইচ্ছাশক্তি দিয়ে শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে হার মানিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চায় সে। লেখাপড়া শেষ করে প্রতিবন্ধীদের উন্নয়নে কাজ করার প্রবল ইচ্ছা এই কিশোরের। কিন্তু অর্থাভাবে সেই পড়াশোনাই ছিল বন্ধের পথে। ফজলুর দু’হাত ও এক পা না থাকলেও এক পা দিয়েই ভাত খাওয়া, টিউবওয়েলের পানি উত্তোলনসহ কিছু কিছু কাজ সে নিজেই করতে পারে।
মামুন বিশ্বাস ফেসবুকের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে হুইল চেয়ার ও নগদ ৭৬ হাজার টাকা তুলে দেন সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসক কামরুন নাহার সিদ্দিকীর ম্যাধমে ফজলুকে তার লেখাপড়া করার জন্য। বর্তমানে ফজলুর নবম শ্রেণিতে লেখাপড়া করছে। কেবল ফজলুর বা আনোয়ারাই নন, আরও অনেকের পাশে দাঁড়িয়েছেন মামুন।
পশুপাখি আর প্রকৃতির জন্যও মন কাঁদে মামুনের। ২০১৩ সাল থেকে নিজের গ্রামে মাটির কলস গাছে গাছে বেঁধে পাখির অভয়াশ্রম গড়ে তোলার কাজে লেগে পড়েন। এখন পর্যন্ত প্রায় এক হাজার মাটির কলস ও ৬০টি বাঁশের চুঙ্গা স্থাপন করেছেন। যার স্বীকৃতিস্বরূপ পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের বন অধিদপ্তর থেকে পেয়েছেন পাখি রক্ষা সম্মাননা ২০১৬।
কথা হয় সিরাজগঞ্জ জেলার জেলা প্রশাসক কামরুন নাহার সিদ্দিকীর সঙ্গে। তিনি বলেন, মামুন বিশ্বাসের কার্যক্রম নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। তিনি সিরাজগঞ্জ জেলাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের অসহায় মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসন সব সময় তার পাশে আছে। তিনি আরও বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে তার কাজে সহায়তা করে আসছি এবং আমাদের এই সাহায্য-সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে।
মামুন বিশ্বাস জানান, আমি ফেসবুককে কেবল সময় কাটানোর মাধ্যম নয়, একটু অন্যভাবে নিয়েছি। আমরা যারা ফেসবুক ব্যবহার করি এই সময়টা যদি ভালো কাজে লাগাই তাহলে অনেক অসহায় মানুষ বাঁচার স্বপ্ন দেখবে। আমি যদি ৬৪ জেলায় ৬৪ জন দক্ষ লোক গড়ে তুলতে পারি তবে এই ফেসবুক দিয়ে অসহায় ও প্রতিবন্ধীদের জন্য অনেক কিছু করা সম্ভব।
মামুন আরও জানান, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবের পিএস শামীম আহমেদ ও সিরাজগঞ্জের জেলা প্রশাসক কামরুন নাহার সিদ্দিকা তার সব কাজে সার্বিক সহযোগিতা ও পরামর্শ প্রদান করেন। ইতিমধ্যে ৩৫ জন জটিল রোগে আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসার ব্যবস্থাসহ ২৯ লাখ টাকা বিতরণ, সেই সঙ্গে সাতজনকে ঘর তৈরি করে দেওয়া, প্রতিবন্ধীদের মাঝে ২৩টি হুইল চেয়ার ও হারিয়ে যাওয়া সাতজনকে ফেসবুকের মাধ্যমে উদ্ধার করেছেন মামুন। এ ছাড়া একাধিক বাল্যবিয়ে বন্ধ, অসহায় বীরাঙ্গনাদের মাঝে শাড়ি বিতরণ, ভূমিহীনকে জমি বরাদ্দসহ সমাজের সব অসঙ্গতির বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন মামুন বিশ্বাস।
মামুন স্বপ্ন দেখেন এমন এক দেশের, যেখানে কেউ অর্থের অভাবে বিনা চিকিৎসায় কষ্ট পাবে না। তিনি বিশ্বাস করেন, তার মতো আরও অনেকই এগিয়ে আসবেন নিজেদের ক্ষুদ্র প্রচেষ্টায়। জয় হবে মানবতার।