ড্রপ আউট থেকে নোবেল বিজয়ী!
- আদিবা ইসলাম
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা শুনলেই কার না কানে ভেসে উঠে সেই মধুর জাতীয় সংগীত। কিন্তু আপনি কি জানেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বের প্রথম এশিয়ান ছিলেন যিনি নোবেল পুরস্কার পান? শুধু তাই নয়, রবীন্দ্রনাথ একাধারে একজন কবি, গীতিকার, চিত্রশিল্পী এবং একজন পরিব্রাজকও ছিলেন। তবে ভারতবর্ষ যখন জাতীয়তাবাদ নিয়ে লড়াই করছিল ইংরেজদের সাথে তখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বাস করতেন বিশ্বমানবতায়।
শুরুটা করা যাক এক অন্যরকম তথ্য দিয়ে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কিন্তু আসল নাম ছিল রবীন্দ্রনাথ কুশারি। তার পরিবার এতটাই ধনী ছিল যে তার পরিবারকে ঠাকুর বলা হতো এবং এ থেকেই তার নাম হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কিন্তু এই ‘ঠাকুর’ নামটি সেসময় ব্রিটিশরা উচ্চারণ করতে পারতো না। ভুল নাম উচ্চারণে তার নাম বিশ্বের কাছে হয়ে গেলো রবীন্দ্রনাথ টেগর (Rabindranath Tagore)। রবীন্দ্রনাথ তার বাবার শেষ সন্তান অর্থাৎ ১৪ নম্বর সন্তান ছিলেন। তার মা বেশিরভাগ সময়ে অসুস্থ থাকায় ছোটবেলায় রবীন্দ্রনাথকে বাড়ির চাকরদের কাছেই বড় হতে হয়। তিনি অবশ্য তার জীবনের এই সময়কালকে ‘Servocrasy’ অর্থাৎ চাকরের শাসন বলে সম্বোধন করেছেন। এরমধ্যে তার স্কুলজীবন তেমন একটা মনোরম ছিল না। তিনি পড়াশুনায় তেমন মনযোগী ছিলেন না। পড়াশুনায় মন দিতে না পারায় তার শুধু স্কুল বদলাতে হয়েছে। কলকাতা একাডেমী, ওরিয়েন্টাল সেমিনারিসহ আরও অনেক স্কুল বদলেছেন কিন্তু এভাবে আর স্কুল জীবন শেষ করতে পারলেন না। তখন তার শিক্ষাজীবনের নিয়ন্ত্রণ নেন তার বড় ভাই হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি রবীন্দ্রনাথকে তাত্ত্বিক শিক্ষা ছাড়াও বিভিন্ন শারীরিক শিক্ষাও দিয়ে থাকেন। ১৮৭৩ সালে যখন রবীন্দ্রনাথ ১২ বছরের ছিলেন তখন তার পিতা তাকে আত্ম আবিষ্কারমূলক অর্থাৎ Self Discovery যাত্রায় নিয়ে যান। শান্তিনিকেতনসহ অমৃতসরের গোল্ডেন মন্দিরেও ধ্যান করেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উচ্চশিক্ষা সম্পূর্ণ করার জন্য তার ভাই এবং পরিবারের সাথে লন্ডনে চলে যান। তার বাবা দেবেন্দ্রনাথ দত্ত সবসময়েই চেয়েছেন যেন তার ছেলে একজন সফল উকিল হতে পারে। এ ধারায় তিনি ইউনিভার্সটি কলেজ অফ লন্ডনের আইন বিভাগে উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তি হলেন। তবে এরই মধ্যে তিনি আইন পড়াও ছেড়ে দিলেন। সবচেয়ে মজার ব্যাপার এই যে, আইন ছাড়লে কি হবে, ইউনিভার্সিটি কলেজ অফ লন্ডনে এখনও তাকে নিয়ে টেগর লেকচার সিরিজ পড়ানো হয়। আইন পড়া ছেড়ে ইংরেজি সাহিত্যে ঝুঁকেই তার সাহিত্যের জীবন শুরু হলো। শুধু ইংরেজি সাহিত্যেই নয় বরং তিনি ইংলিশ, স্কটিশ এবং আইরিশ গান নিয়েও ঘাটাঘাটি শুরু করলেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অনেক ছোট থেকেই লেখার চর্চা করা শুরু করেন। তার প্রথম কবিতা লেখা হয় ১৮৭৪ সালে যখন তিনি ১৩ বছরের একজন কিশোর ছিলেন এবং কবিতাটি ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকায় ছাপা হয়। পরবর্তীতে তিনি একটি কবিতার সংগ্রহও লিখেছেন যা হয়তো সবাই ইতিমধ্যে ধারণা করতে পারছেন। হ্যাঁ, গীতাঞ্জলির কথা বলছি। গীতাঞ্জলি এতোটাই বিখ্যাত হয় যে বইটির ইংরেজি অনুবাদ ইউরোপ ও আমেরিকায় তাকে একজন তারকা বানিয়ে ফেলে। শুধু কি তাই, এই গীতাঞ্জলিই ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে প্রথম এশিয়ান বা নন-ইউরোপিয়ান সাহিত্য নোবেল বিজয়ী বানান। ব্রিটিশ সরকারও রবীন্দ্রনাথকে খুবই সম্মান করতেন এবং সেই সম্মান দেখিয়েই ১৯১৫ সালে তাকে ‘নাইট’ উপাধিতেও ভূষিত করেন।
এছাড়াও ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তাকে লেকচার দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হতো। শুধু কবিতা নয়, ছোটগল্পের জন্যও রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সবার প্রিয় এবং এ ধারাতেই তাকে ছোটগল্পের জনক বলা হয়।
তবে ঠাকুর সাহেব শুধু কবিতা, ছোটগল্প এবং উপন্যাসের মধ্যেই আটকে থাকেননি। গান জগতেও রয়েছে তার বিশাল অবদান। ১৯০৫ সালে যখন ব্রিটিশ বাংলাকে বিভাজন করে ফেলে তখনই আমাদের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’ লিখে সবাইকে চমকে দেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি শুধু যে আমাদের জাতীয় সংগীত লেখেন তা নয় বরং আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের জাতীয় সংগীত ‘জনগণমন’ও লেখেন। ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি প্রথম ১৯৭১ সালে ৩ মার্চ আমাদের জাতীয় সংগীত হিসেবে গাওয়া হয়।
এবার আসি তার বিশেষ বন্ধুত্বের গল্প নিয়ে। মহাত্মা গান্ধী এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন সে সময় একে অপরের বিশেষ বন্ধু। গভীর বন্ধুত্ব থাকলেও তাদের নিজেদের চিন্তা-ধারণায় বেশ দ্বিমত ছিল। মহাত্মা গান্ধী সবসময় জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করতেন। তার মতে আমরা যে দেশে জন্মগ্রহণ করেছি সেই দেশকেই আমাদের ভালোবাসা উচিত এবং এই চিন্তা সেই সময়ে ব্রিটিশদের বিপক্ষে মানবসমাজকে একত্র করে রাখতে সাহায্য করবে। কিন্তু অপরদিকে রবীন্দ্রনাথ বিশ্বমানবতায় বিশ্বাস করতেন এবং তিনি মনে করতেন জাতীয়তাবাদ যেকোনো মুহূর্তে এক প্রকার নিরর্থক অহংকারে পরিণত হতে পারে যা বিশ্বব্যাপী বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে পারে। মতের এত বড় অমিল থাকা সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং মহাত্মা গান্ধী সবসময় খুবই ভালো বন্ধু ছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আদর্শ এবং তার চিন্তাধারা নিয়ে কথা বলে হয়তো শেষ করা যাবে না। তাই বাংলার সংস্কৃতিকে ধরে রাখতে আমাদের সকলের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আদর্শ এবং তার সংস্কৃতির সৃষ্টি চর্চা করা উচিত!