গুগলের ভাবনায় ভবিষ্যৎ পৃথিবী

গুগলের ভাবনায় ভবিষ্যৎ পৃথিবী

সম্প্রতি গুগলের সিইও হিসাবে নিয়োগ পেয়েছেন সুন্দর পিচাই। দায়িত্ব পাওয়ার পরপরই ওয়ার্ল্ড নিউজ -এ এক নিবন্ধে লিখেছেন গুগলের ভাবনায় ভবিষ্যৎ  প্রযুক্তিবিশ্ব কেমন হবে। ওয়ার্ল্ড নিউজ থেকে নিবন্ধটি অনুবাদ করেছেন জায়েদ ইবনে আবুল ফজল।


পিচাই সুন্দররাজন: গুগল ডেভেলপারস ডে’র সঙ্গে পরিচিত থাকবেন পাঠকদের অনেকে। তবে এর বাইরেও আমরা সহকর্মীরা বার্ষিকভাবে মিলিত হওয়ার চেষ্টা করি। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত অষ্টম গুগল বার্ষিক সম্মেলন তেমনই এক আয়োজন। সানফ্রান্সিসকোর মসকোন সেন্টারে আয়োজিত ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন আনুমানিক ছয় হাজার সফটওয়্যার ডেভেলপার। তাদের সঙ্গে ভার্চুয়ালি হাজার হাজার ব্যক্তি সংযুক্ত ছিলেন অনলাইন স্ট্রিমিংয়ের মাধ্যমে। সেখানে আমিসহ সবাই মিলে পান করেছি প্রায় দেড় হাজার গ্যালন (বিলের তথ্য অনুযায়ী) কফি। অবশ্য আমি বিশ্বাস করি, সামান্য কফির বিনিময়ে ওই দিন যে আলোচনা হয়েছে গুগল টিমের নিজেদের মধ্যে, তা অতুলনীয়। সেখানে গুগলের ভবিষ্যৎ ভাবনা তথা নতুন গৃহীত প্রকল্পের সম্ভাবনা ও দুর্বলতা নিয়ে কথাবার্তা হয়েছে একেবারে খোলাখুলিভাবে। তা থেকে আগামীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় গুগলের সম্ভাব্য অবস্থান বিষয়ে এসেছে জরুরি ও নতুন সব দিকনির্দেশনা। এ নিবন্ধে সেগুলোর কয়েকটি নিয়ে কিছু বলতে চাই।

প্রয়োজনীয় ও অপ্রয়োজনীয় তথ্য কতভাবে খোঁজা যেতে পারে, কীভাবে বন্ধুবান্ধব বা আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা যায় কিংবা গান শুনে, ছবি দেখে, গেম খেলে বা বই পড়ে একজন ব্যবহারকারীর পক্ষে কী কী উপায়ে আমোদিত হওয়া সম্ভব, তা অনুমান করা যায়নি সেলফোন প্রযুক্তি বিকাশের আগে। এক্ষেত্রে যুগান্তকারী পরিবর্তন আসে স্মার্টফোনের হাত ধরে এবং মাত্র কয়েক বছরে। কয়েক দশক আগে হাজার বর্গফুটের স্পেস ছাড়া বসানো যেত না চলনসই কম্পিউটার। কর্মক্ষমতার দিক থেকে সে তুলনায় মানুষ পকেটে সুপার কম্পিউটার রেখে ঘুরছে এখন। একটা পর্যায়ে কম্পিউটার ছিল অনেক মানুষের জীবনযাত্রার জন্য অপরিহার্য। স্মার্টফোন কারো কারো জীবনেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠছে ইদানীং। ডেক্সটপ থেকে ল্যাপটপ, ল্যাপটপ থেকে ট্যাবলেট-স্মার্টফোন ব্যবহারের এ রূপান্তরের চমত্কার চিত্র মেলে গুগলের নানা তথ্য-উপাত্তে। সেখান থেকে বলতে পারি, আজকাল ডেক্সটপ বা ল্যাপটপের চেয়ে বেশি ওয়েব কনটেন্ট সার্চ হচ্ছে সেলফোন থেকে। আরো কৌতূহলোদ্দীপক, এক জরিপমতে বৈশ্বিক জনসংখ্যার অধিক এখন সেলফোনের সংখ্যা। আরো জটিল পরিসংখ্যান আছে। কিন্তু সেসবের সূক্ষ্ম বিশ্লেষণে না গিয়েও বাস্তবতাটি আমি উপলব্ধি করি এক সহজ হিসাব দিয়ে; তা হলো, অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহারকারীর প্রবৃদ্ধি। বিশ্বে এক বিলিয়নেরও বেশি অ্যান্ড্রয়েড ব্যবহারকারী বর্তমানে। বাজারে ৪ হাজার স্বতন্ত্র অ্যান্ড্রয়েড ডিভাইস রয়েছে এখন; এদিকে চারশর বেশি কোম্পানি নিয়োজিত সাপোর্টিং সেট উত্পাদনে; এটি আস্থার সঙ্গে ব্যবহার করছে পাঁচ শতাধিক সেলফোন অপারেটর। এ অবস্থান ২০০৮ সালে যখন প্রথমবারের মতো অপারেটিং সিস্টেমটি বাজারে ছাড়া হয়, তার তুলনায় অত্যন্ত কষ্টকর কল্পনা।

নতুন নতুন অ্যান্ড্রয়েড সংস্করণ প্রতিবারই পাল্টে দিয়েছে ডিভাইস টেকনোলজি। এক্ষেত্রে অ্যান্ড্রয়েড একমাত্র ফ্যাক্টর নয় অবশ্য। তথ্যপ্রযুক্তির মাল্টি-স্ক্রিন যুগে প্রবেশও এখানে বড় নিয়ামক। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক, যান্ত্রিক সমন্বয়ের চাহিদা। কার্যত ওর টানেই বাজারে আসে গুগল ওয়্যার ঘড়ি। সেজন্যই সাত ধরনের অ্যান্ড্রয়েড ওয়্যার তৈরি করা হয়েছে গ্রাহক চাহিদার প্রতি লক্ষ রেখে। ব্যান্ড অথবা স্টাইলের কথা এখানে বলছি না কিন্তু। এসব পরিবর্তনের ওপর ক্রেতার অধিকার সর্বাগ্রে স্মরণীয়। এর বাইরে আমাদের ডেভেলপাররা দেড় হাজার রকমের ডিজিটাল আদল বানিয়ে রেখেছেন ব্যবহারকারীর রুচিতে বৈচিত্র্য আনতে। আমাদের প্রত্যাশা, চলতি বছরের শেষ দিকে কমপক্ষে ৩৫টি মডেলের গাড়ি বাজারে ছাড়তে সক্ষম হবে অ্যান্ড্রয়েড অটো। নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি ম্যাপ দেখা, কনটেন্ট সার্চ, গান শোনা প্রভৃতি সেবা দেবে গাড়িটি। এরই মধ্যে অ্যান্ড্রয়েড টিভি বাজারে ছেড়েছে একাধিক বৃহৎ ইলেকট্রনিকস কোম্পানি। আসলে আমরা মানুষের স্থান ও প্রয়োজন অনুসারে সেবার প্রকারভেদ ও সম্প্রসারণে বিশ্বাসী। অনেকে মনে করেন, গুগলের কর্মক্ষেত্র বিশাল। আমাদের দৃষ্টিতে অ্যান্ড্রয়েডকে ব্যবহারকারীর অভিজ্ঞতা প্লাটফর্ম হিসেবে আরো শক্তিশালী করে তোলা, বিশেষত শিক্ষা ও বিনোদন খাত উন্নয়নের বিরাট সুযোগ অপেক্ষারত ডেভেলপারদের সামনে।

গুগলের তৈরি অ্যান্ড্রয়েডের নতুন অপারেটিং সিস্টেম মার্শম্যালো বাজারে আসবে চলতি সেপ্টেম্বরে। ললিপপের মতো পূর্ববর্তী প্লাটফর্মগুলোর কয়েকশ দুর্বলতা দূর করা হয়েছে এতে। উপরন্তু সেখানে সক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে বিদ্যমান ফিচারের। সেখান থেকে এক-দুটি উদাহরণ দিই। অ্যান্ড্রয়েড ফোনের একটা বৈশিষ্ট্য হলো, চার্জ ফুরায় দ্রুত। তার প্রধান কারণ, ব্যাকগ্রাউন্ডে চালু কিছু অ্যাপস। মার্শম্যালোর প্রোগ্রাম ডিজাইনে অন্যতম বিবেচনা ছিল ব্যাটারি সাশ্রয়। ফলে ওতে ব্যবস্থা রাখা হয়েছে যেন আগের মতো ব্যাকগ্রাউন্ডে অ্যাপস চললেও চার্জ খরচ হয় লক্ষণীয়ভাবে কম। ইউএসবি টাইপ সি-ও মার্শম্যালোর নতুন বৈশিষ্ট্য। গুগল টিমের দ্বিতীয় মনোযোগ নিবন্ধ ছিল ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তা সুরক্ষার প্রতি। বেশির ভাগ অ্যাপস ইনস্টলেশনের সময় কনট্যাক্ট লিস্ট, ক্যামেরা, নেটওয়ার্ক প্রভৃতি ফিচার ব্যবহারের অনুমতি চায়। সমস্যা হলো, ওই অ্যাপস কখন বিজ্ঞাপন দেয়ার জন্য সাধারণ নেটওয়ার্ক ব্যবহার করছে আর কখন (আদৌ যদি করে) কনট্যাক্ট লিস্ট থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদি সরাচ্ছে, তা ব্যবহারকারীর পক্ষে চিহ্নিত করা মুশকিল। এক্ষেত্রে অগ্রসর সুরক্ষা দেবে মার্শম্যালো। গেম খেলার সময় কোনো অ্যাপস ক্যামেরা খোলার প্রচেষ্টা নিলে নোটিস করবে গ্রাহককে।

‘অ্যান্ড্রয়েড পে’কে নতুন উচ্চতায় তোলার এখনই সুযোগ। পাশাপাশি অ্যাপলের সিরি ও মাইক্রোসফটের কর্টানার সঙ্গে পাল্লা দিতে গুগল নাউও কম শক্তিশালী নয় এখন। ভালো যে, এর নতুন সংস্করণ আসছে মার্শম্যালোর সঙ্গে। দুয়ের সমন্বিত কার্যকারিতা নিঃসন্দেহে অতুলনীয় অভিজ্ঞতা হবে গ্রাহকের জন্য। একটা সেলফোনে তথ্য কম থাকে না। ঝামেলা হলো, দরকারের সময় প্রয়োজনীয় তথ্যটা খুঁজে বের করা। হয়তো বন্ধুবান্ধবীকে নিয়ে নতুন কোথাও খেতে যেতে চান। একটা ভালো রেস্টুরেন্টের ওপর পড়েছিলেন, লেখাটি সেভও করেছিলেন কিন্তু মনে পড়ছে না এখন। সৌভাগ্যবশত তথ্য খুঁজে বের করাই হলো গুগলের মিশন। ফলে যখনই কাঙ্ক্ষিত রেস্টুরেন্টের কথা মাথায় আসবে, গুগল নাউকে জানানোই যথেষ্ট। দায়িত্ব পালনে অ্যাপসটি কোনো গাফিলতি দেখাবে না, সে আস্থা আছে আমার। আরেকটি কাজ করা হয়েছে মার্শম্যালোতে। ব্যবহারকারী ও ডেভেলপার উভয়ের জন্যই সহজ করে তৈরি করা হয়েছে কাজে লাগতে পারে এমন সম্ভাব্য নতুন অ্যাপস কিংবা ইন-অ্যাপ কনটেন্ট সার্চ।

গুগলের সিইও সুন্দর পিচাই
গুগলের সিইও সুন্দর পিচাই

আগেই বলেছি, স্মার্টফোন ব্যবহারকারীর অভিজ্ঞতা আজকাল ক্ষেত্রভেদে ভিন্ন। গত বছরের বার্ষিক সম্মেলনে উত্থাপিত আমাদের নতুন প্রযুক্তি ছিল গুগল কার্ডবোর্ড। যদিও এক্ষেত্রে প্রাযুক্তিক বিকাশের কেবল সূচনালগ্নে উপস্থিত আমরা, তবু বিষয়টির সঙ্গে পাঠককে পরিচিত করতে দোষ কী? প্রকৃতপক্ষে কার্ডবোর্ড হলো এমন প্রযুক্তি, যার সহায়তায় ৪-৬ ইঞ্চি স্ক্রিনসংবলিত প্রায় সব স্মার্টফোনেই ভার্চুয়াল রিয়েলিটির অভিজ্ঞতা দেয়া সম্ভব গ্রাহককে এবং তা একেবারে সস্তায়। এর মাধ্যমে সিনেমা, গেমস, ভ্রমণ অথবা বিভিন্ন ভিডিও উপভোগ করা যায় থ্রিডিতে। আলোচ্য প্রকারের কনটেন্টকে থ্রিডি স্ট্রিমে রূপান্তরের জন্য এরই মধ্যে আনুমানিক ৫০০ অ্যাপস আছে বাজারে। তাছাড়া গুগলের আরেকটি প্রকল্প হলো, সাধারণ ক্যামেরার সাহায্যে ব্যবহারকারীকে থ্রিডি ভিডিও রেকর্ডের সুযোগ দেয়া। পাশাপাশি আইওএস সাপোর্টের ব্যবস্থা করা হয়েছে অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপস ডেভেলপারদের জন্য।

ইন্টারনেটের মাধ্যমে গুগলের সংস্পর্শে প্রথম এক বিলিয়ন ব্যবহারকারীর সহায় ছিল ডেক্সটপ কম্পিউটার। এর পরবর্তী বিলিয়ন ব্যবহারকারীরা ধরেছেন ভিন্ন পথ তথা ল্যাপটপ, সেলফোন ও স্মার্টফোন। এখানে পরিবর্তনের গতি খুবই দ্রুত। ফলে তা গুগলের জন্য একই সঙ্গে নতুন ধরনের সুযোগ ও স্বতন্ত্র চ্যালেঞ্জ। এ অবস্থায় আমরা গুগলের সহকর্মীরা পরিশ্রম করে যাচ্ছি গ্রাহকের সন্তুষ্টি কামনায়। আমরা জানি, অনেক দেশেই এখনো সুলভে ভালো ইন্টারনেট সংযোগ প্রাপ্তি একটা সমস্যা। সে প্রেক্ষাপটে ওয়েব কনটেন্টের মুহুর্মুহু উন্নয়ন ব্যবহারকারীর জন্য কিছু উপকারী সাইটকে বানিয়ে ফেলেছে বোঝা। তা থেকে উত্তরণে এখন পর্যন্ত ডজনখানেকের বেশি দেশে ছাড়া হয়েছে বিশেষ গুগল ক্রোম। তাতে সার্চ রেজাল্ট থেকে শুরু করে ব্রাউজিংয়ের অন্যান্য ফিচারে অংশগ্রহণে মিলবে ন্যূনতম ব্যয়ে সর্বোত্তম ডাটাসেবা প্রাপ্তির নিশ্চয়তা। আরেকটি বিষয়, কয়েকজন মিলে গুগল অফলাইন ম্যাপ নিরীক্ষা করছিলাম ক’দিন আগেই। বাঁক থেকে বাঁক নির্দেশনা বজায় রেখে অফলাইন ম্যাপ সংরক্ষণ করা যাবে এতে। আমি এটা দ্রুতই বাজারে ছাড়তে আগ্রহী।

তথ্য অনুসন্ধানী গুগলের যাত্রা ৪ সেপ্টেম্বর ১৯৯৮ সালে। পরবর্তীতে নিছক সার্চ ইঞ্জিন থেকে বহু রূপান্তর ঘটেছে এর। তবু সর্বদা গুগলের অনুপ্রেরণা ছিল, সব মানুষের ব্যবহার উপযোগী উপকারী পণ্য ও সেবা সৃষ্টি। আমরা সবসময় চেষ্টা করেছি স্বতন্ত্র অথচ সীমাবদ্ধ প্রাযুক্তিক সহায়তায় ব্যবহারকারীর বৃহৎ সমস্যার সমাধান দিতে। আজো সে পথ থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত নয় গুগল। এ যুগটাই সেলফোনকেন্দ্রিক। ফলে কর্মদর্শন অক্ষুণ্ন রেখে কর্মপরিধি বাড়াতে হয়েছে স্বভাবতই। কিন্তু এ পারফরম্যান্স গুগলের প্রতিশ্রুতির তুলনায় নগণ্য। নতুন বিলিয়ন ব্যবহারকারী যুক্ত হচ্ছে অনলাইনে। যেখানেই থাকুন, যে যন্ত্রই ব্যবহার করুন, ইন্টারনেটের নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে তুলে দিতে নিবেদিত থাকতে হবে গুগলকে।

লেখক: সিইও, গুগল
ওয়ার্ল্ড নিউজ থেকে সংক্ষেপে ভাষান্তর
জায়েদ ইবনে আবুল ফজল, বণিক বার্তা

Sharing is caring!

Leave a Comment