প্রতিটি মুহূর্ত একেকটি উপহার : শেরিল স্যান্ডবার্গ
- লিডারশিপ ডেস্ক
ফেসবুকের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা শেরিল স্যান্ডবার্গ। টাইম সাময়িকীর করা বিশ্বের ১০০ প্রভাবশালী মানুষের তালিকায় আছে তাঁর নাম। গত ১২ মে যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট অ্যান্ড স্টেট ইউনিভার্সিটির (ভার্জিনিয়া টেক) সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিয়েছেন তিনি।
দুই বছর এগারো দিন আগে আমি আমার স্বামী ডেভকে হারিয়েছি। আকস্মিক এবং অপ্রত্যাশিতভাবে। ওর কথা বলতে গেলে আমাকে বেশ বেগ পেতে হয়। কারণ, আমি এখনো ব্যাপারটা ঠিক বিশ্বাস করতে পারি না। সকালে ঘুম থেকে ওঠার সময়ও ভেবেছিলাম, দিনটা আর দশটা দিনের মতোই কাটবে। অথচ ওই এক দিনেই আমার জীবনটা বদলে গিয়েছিল।
আমি জানি, আজ তোমাদের জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ দিন। বাইরে সুন্দর বৃষ্টি পড়ছে। আর আমি কি না এখানে দাঁড়িয়ে মৃত্যুর কথা বলছি। এর পেছনে একটা কারণ আছে। কথা দিচ্ছি, আমি তোমাদের মন খারাপ করিয়ে দেব না।
ডেভের মৃত্যুর পর পৃথিবীর প্রতি আমার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গেছে। সে কথাই আজ তোমাদের বলব। কারণ, আমার বিশ্বাস, আমার অভিজ্ঞতা তোমাদের একটা সুস্থ-সুন্দর জীবনের দিকনির্দেশনা দেবে। আজ এখানে পৌঁছানোর পেছনে তোমাদের প্রত্যেকের নিশ্চয়ই বিচিত্র সব গল্প আছে। কেউ কেউ প্রচণ্ড মানসিক চাপের মুখোমুখি হয়েছ। চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার অভিজ্ঞতা তোমাদের হয়েছে। হতাশা, মানসিক যন্ত্রণা, হারানোর ব্যথা, অসুস্থতা—এ সব অনুভূতি খুব ব্যক্তিগত, কিন্তু সর্বজনীন। কিছু কিছু ব্যথা আবার একার নয়। ভার্জিনিয়া টেকের শিক্ষার্থীরা খুব ভালো করে সেটা জানে। আজ সকালে ড্রিলফিল্ডের ‘থার্টি টু হকি স্টোন’-এর সামনে দিয়ে আসার সময় আমি যেমন মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়িয়েছিলাম, তোমরাও নিশ্চয়ই তা-ই করো (২০০৭ সালের ১৬ এপ্রিল আততায়ীর গুলিতে নিহত হয়েছিলেন ভার্জিনিয়া টেকের ৩২ জন শিক্ষার্থী। তাঁদের স্মরণে বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩২টি স্মৃতিস্তম্ভ আছে)। তোমরা জানো, এক মুহূর্তের মধ্যে জীবনটা বদলে যেতে পারে। তোমরা জানো, এই সময়ে সবার একসঙ্গে এগিয়ে আসতে হয়, শোক অনুভব করতে হয়, নিজেদের টেনে তুলতে হয় এবং সবচেয়ে বড় কথা, একসঙ্গে ঘুরে দাঁড়াতে হয়।
আমাদের সবারই একটা দল প্রয়োজন। বিশেষ করে তখন, যখন জীবন আমাদের সামনে বাধার দেয়াল তুলে দেয়। ভার্জিনিয়া টেকের বাইরেও তোমরা একেকটা দলের অন্তর্ভুক্ত হবে। এই দলটাই সাহায্যের প্রয়োজন হলে এগিয়ে আসবে। আমার জন্য অবশ্য একটা দলের অংশ হওয়া খুব কঠিন ছিল। ডেভের মৃত্যুর আগে আমি আসলে মানুষকে বিরক্ত করতে চাইতাম না। হ্যাঁ, আমার কাছে ব্যাপারটা ‘বিরক্ত করা’ই মনে হতো। কিন্তু ডেভ চলে যাওয়ার পর সব বদলে গেল। কখনো ভাবিনি পরিবার, বন্ধু আর সহকর্মীরা আমার জীবনে এতটা প্রয়োজনীয় হয়ে উঠবে।
তোমাদের মধ্যে কেউ কি ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছ? ভাবছ ভাগ্য তোমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? মাঝেমধ্যে আমারও এমন ভয় হয়। এই ভয়ের বিরুদ্ধে তুমি কী নিয়ে লড়বে জানো? আশা—ছোট্ট একটা শব্দে লুকিয়ে আছে অনেক বড় ভাবার্থ।
আমরা ভাবি ‘আশা’ প্রত্যেকের ব্যক্তিগত সম্পদ। কিন্তু ‘ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষমতার’ পাশাপাশি আশাও কিন্তু দলগতভাবে গড়ে উঠতে পারে। দুই দিন আগে আমি চার্লসটনের মাদার ইমানুয়েল চার্চে গিয়েছিলাম। আমরা সবাই জানি দুই বছর আগে সেখানে গোলাগুলিতে একজন যাজক এবং আটজন ধর্মপ্রাণ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন। এরপর যা ঘটেছে তা সত্যিই অনন্য। ঘৃণার বদলে সেখানকার সব মানুষ ভালোবাসা নিয়ে এগিয়ে এসেছেন। তাঁরা একসঙ্গে বর্ণবাদ ও হিংস্রতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। স্থানীয় যাজক জারমেইন ওয়াটকিনস যেমন খুব সুন্দর করে বলেন, ‘ঘৃণাকে বলি—না, আজকের দিনটা তোমার নয়। বিভেদকে বলি—না, আজকের দিনটা তোমার নয়। আশাহীনতাকে বলি—না, আজকের দিনটা তোমার নয়।’
ফেসবুকে আমি অনেকের লেখাই পড়ি। কিন্তু প্যারিসের সাংবাদিক অ্যান্টয়েন লেইরিসের একটা লেখা আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছে। তাঁর স্ত্রী হেলেন ২০১৫ সালে প্যারিস হামলায় নিহত হয়েছিলেন। এর মাত্র দুই দিন পর লেইরিস তাঁর স্ত্রীর হত্যাকারীদের উদ্দেশে একটা খোলা চিঠি লিখেছিলেন। তিনি লিখেছেন, ‘শুক্রবার রাতে তোমরা কেড়ে নিয়েছ একজন অন্য রকম মানুষকে, আমার ভালোবাসাকে, আমার সন্তানের মাকে। কিন্তু আমার ঘৃণা তোমরা পাবে না। আমার ১৭ মাস বয়সী ছোট্ট ছেলেটা একজন সুখী, স্বাধীন মানুষ হয়ে বেড়ে উঠবে, প্রতিদিন সে হাসবে খেলবে আর তোমাদের বুড়ো আঙুল দেখাবে। কারণ, তার ঘৃণাও তোমরা পাবে না।’
এ রকম অসামান্য শক্তি আমাদেরও শক্তি দেয়। এমন আশা আমাদের মনেও আশা জাগায়। এভাবেই আমরা একসঙ্গে ঘুরে দাঁড়াই, একে অপরকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করি।
ক্যাম্পাস ছেড়ে তোমরা বাইরের পৃথিবীতে পা রাখতে যাচ্ছ। আমি তোমাদের বলতে চাই, যেকোনো পরিস্থিতি থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষমতা নিজের মধ্যে গড়ে তোলো। শোক কিংবা হতাশা যখন আঘাত করে, নিশ্চিত থেকো, খুব গভীরে সেটা কাটিয়ে ওঠার ক্ষমতা তোমার আছে।
দুই বছর আগে কেউ যদি আমাকে বলত, ‘ভালোবাসার মানুষটিকে হারিয়েও তুমি জীবনের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে’—আমি কখনোই বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু এখন সত্যিই তাই হয়েছে। আমি কৃতজ্ঞ আমার সন্তানদের জন্য, আমার পরিবারের জন্য, আমার বন্ধু, কাজ আর এই জীবনটার জন্য।
কিছুদিন আগে আমার কাজিন লরার ৫০ বছর পূর্ণ হলো। স্নাতকেরা, জীবনের ৫০টা বছর যে কী দ্রুত কেটে যায় আর তখন যে নিজেকে কতটা বৃদ্ধ মনে হয়, এই অনুভূতি তোমরা বুঝবে না। তোমাদের মা-বাবা নিশ্চয়ই বোঝেন। লরাকে ফোন করে আমি বলেছিলাম, ‘শুভ জন্মদিন লরা। শুধু এ কথা বলার জন্যই আমি তোমাকে ফোন করিনি। তুমি হয়তো সকালে ঘুম থেকে উঠেই ভাবতে বসেছ, “হায়, বয়সটা ৫০ ছুঁয়ে ফেলল!” সে ক্ষেত্রে আমি তোমাকে মনে করিয়ে দিতে চাই, এভাবে ভেব না। মনে রেখ, এ বছর তুমি যেমন ৫০ ছুঁয়েছ, ডেভ বেঁচে থাকলে ওর বয়সও ৫০ হতো। ডেভ পারেনি, তুমি তো পেরেছ।’ বুড়ো হই বা না হই, বয়স কোনো কৌতুকের বিষয় নয়। প্রতিটা বছর, প্রতিটা মুহূর্ত…এমনকি এই যে বাইরে বৃষ্টি পড়ছে…এটাও জীবনের একটা উপহার।
নতুন বছরে আমার প্রতিজ্ঞা ছিল, ঘুমাতে যাওয়ার আগে দিনের তিনটি আনন্দের মুহূর্ত আমি লিখে রাখব। এই সহজ অভ্যাস আমার জীবন বদলে দিয়েছে। আগে প্রতি রাতে বিছানায় শুয়ে ভাবতাম, কত কী ভুল করলাম, আগামী দিন না জানি কত ভুল করতে যাচ্ছি। এখন ঘুমাতে যাওয়ার আগে ভাবি, আজ কী কী পেলাম। দারুণ সব মুহূর্তের স্মৃতি দিয়ে আমার নোটবুক ভারী হয়ে উঠছে। তোমরাও চেষ্টা করে দেখতে পারো, আজই শুরু করো। আজকের দিনটাতে নিশ্চয়ই লেখার মতো অনেক কিছু তুমি পাবে।
আর হ্যাঁ, আজ রাতে আমার দিনের সেরা তিন মুহূর্তের মধ্যে আমি তোমাদের কথাও লিখব। লিখব, তোমরা আমার মধ্যে আশা আর ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি সঞ্চার করেছ।
অবশেষে আমি যে আমার লম্বা বক্তব্যটা শেষ করতে যাচ্ছি, তোমরাও এই আনন্দের মুহূর্তটার কথা লিখে রাখতে পারো (হাসি)। পুরো পৃথিবী তোমাদের অপেক্ষায় আছে। এই অপার সম্ভাবনাকে তোমরা কীভাবে কাজে লাগাও, দেখার জন্য আমি মুখিয়ে আছি।
অভিনন্দন আবারও। (সংক্ষেপিত)