আমি ছিলাম এক নিঃসঙ্গ বালিকা : ম্যাডোনা
ম্যাডোনা। এক নামেই যাঁকে পুরো বিশ্ব চেনে। তিনি আমেরিকান পপ গায়িকা, অভিনেত্রী এবং নৃত্যশিল্পী। বিশ্বব্যাপী তাঁর গানের অ্যালবাম বিক্রি হয়েছে তিন’শ মিলিয়ন কপিরও অধিক। ম্যাডোনাকে বিবেচনা করা হয় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নারী কণ্ঠশিল্পী হিসেবে। কিন্তু সহজ ছিল না এই প্রথিতযশা কণ্ঠশিল্পীর বেড়ে ওঠা। তাঁর গল্প শোনাচ্ছেন মারুফ ইসলাম।
দেশের নাম যুক্তরাষ্ট্র আর রাজ্যের নাম মিশিগান। এই মিশিগান রাজ্যের ছোট্ট এক শহর রচেস্টার হিল। কে জানত, এই অখ্যাত শহরই একদিন পরিচিত হবে বিখ্যাত কোনো ব্যাক্তির নামে? আজ পুরো বিশ্ব জানে এই অখ্যাত এলাকাতেই জন্মেছিলেন বিখ্যাত পপ গায়িকা ম্যাডোনা।
১৯৫৮ সালের ১৬ আগস্ট। এদিনই জন্মেছেন ম্যাডোনা। তাঁর বাবার নাম সিলভো অ্যান্থনি টনি সিসেনো এবং মা ম্যাডোনা লুইস ফোর্টিন। বাবা-মা দুজনের জাতীয়তা ছিল ভিন্ন-কেউই মার্কিনী ছিলেন না। ম্যাডোনার দাদা ভাগ্যের অন্বেষণে ইতালি থেকে এই মিশিগানে এসে আস্তানা গেঁড়েছিলেন, সেই সুবাদে তাঁর বাবা একজন ইতালিয়ান। আর মা ছিলেন ফরাসী-কানাডিয়ান। এমন এক বৈশ্বিক পরিবারে জন্ম নেওয়া ম্যাডোনার জাতীয়তা তবে কী? ম্যাডোনা হেঁসে বলেন, ‘আমেরিকান।’
আমেরিকান জাতীয়তায় বিশ্বাসী ম্যাডোনার দিন কাটছিল হেসে খেলে। বড় দুই ভাইয়ের পরে জন্ম তাঁর। অনেকটা আদরে আদরে বেড়ে উঠছিলেন ছোট্ট ননি। হ্যাঁ, মায়ের নামের সাথে তাঁর নাম মিলে যাওয়ায় পরিবারের সবাই তাকে ডাকত ‘লিটল ননি’ নামে। কিন্তু এ সুখ বেশি দিন সইলো না ননির কপালে। বয়স যখন পাঁচ তখনই একদিন হঠাৎ করেই মরে গেলেন মা। তার স্তন ক্যান্সার হয়েছিল। বাবা একটি মোটর গ্যারেজে প্রকৌশলীর কাজ করতেন। মাকে ঠিকমতো সময় দিতে পারেননি, ঠিকমতো তার চিকিৎসাও করাতে পারেননি। শুধু নিয়ম করে সন্তান উৎপাদন করে গেছেন। ম্যাডোনার পরে আরও তিনিটি সন্তান জন্ম দিয়েছেন তিনি। সব মিলিয়ে ম্যাডেনারা ছিলেন ছয় ভাই-বোন। মার মৃত্যুর পর ম্যাডেনার ‘ননি’ নামটা চিরতরে মুছে যায় – ওই নামে তাঁকে আর কেউ ডাকত না। তখন থেকেই তিনি ম্যাডোনা।
মাত্র ৩৫ ডলার পকেটে নিয়ে চলে আসেন নিউইয়র্ক শহরে। এখানে এক রেস্টুরেন্টে খাদ্য পরিবেশিকার চাকরি নেন। পাশাপাশি অ্যালভিন অ্যালে ডান্স থিয়েটারে নাচের ক্লাস নিতে শুরু করেন। মাঝে মাঝে পিয়ার লেঙ্গ ডান্স থিয়েটারে পারফর্ম করতেন।
ছোট্ট ম্যাডেনার জীবন তখন শুরু হলো দাদা-দাদির কোলে। কিন্তু এই পরিবর্তন ছোট্ট শিশু মানতে নারাজ। বিশেষত তার মায়ের বিকল্প হিসেবে কাউকে সে মেনে নিতে চাইত না। এমনকি বাড়িতে কাজের লোকদেরও সে সহ্য করতে পারত না। ফলে তার আচরণে এলো পরিবর্তন। অনেক পরে ম্যাডোনা যখন বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পী হয়ে উঠেছেন তখন ভ্যানিটি ফেয়ার ম্যাগাজিনে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আমি ছিলাম এক নিঃসঙ্গ বালিকা। সারাদিন একা একা সময় কাটত আমার। প্রকৃতির মাঝে কি যেন খুঁজতাম।’
১৯৬৬ সালে ম্যাডোনার বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। নতুন সংসারে আরও দুটি সন্তানের বাবাও হন। সংসারে নতুন অতিথি এলেও এই সময় আরও বেশি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন ম্যাডোনা। নিঃসঙ্গতা ঘোচাতে ম্যাডোনা সম্পুর্ন মনোযোগ ঢেলে দেন স্কুলের পড়াশোনায়। ফল হিসাবে পরীক্ষায় ভালো নম্বর পেতে থাকেন। গ্রাজুয়েশন শেষ করার পর তিনি নাচের ওপর শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে ভর্তি হন মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ে। বলা যায়, এ সময়ই শুরু হয় তাঁর নাচের ক্যারিয়ার।
কিন্তু বিধি বাম! বেশি দিন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করতে পারেননি তিনি। মাত্র ৩৫ ডলার পকেটে নিয়ে চলে আসেন নিউইয়র্ক শহরে। এখানে এক রেস্টুরেন্টে খাদ্য পরিবেশিকার চাকরি নেন। পাশাপাশি অ্যালভিন অ্যালে ডান্স থিয়েটারে নাচের ক্লাস নিতে শুরু করেন। মাঝে মাঝে পিয়ার লেঙ্গ ডান্স থিয়েটারে পারফর্ম করতেন। এই সময়ের একটি স্মৃতি প্রায়ই মনে পড়ে তার। একদিন রিহার্সেল শেষ করে বাসায় ফিরছিলেন ম্যাডোনা। মধ্যরাত হয়ে গেছে। রাস্তা বেশ ফাঁকা। হঠাৎ তাঁর সামনে দুজন যুবক লাফিয়ে পড়ে! তিনি থমকে দাঁড়ান, দেখেন তাদের হাতে চকচক করছে ধারালো চাকু! তাদের বক্তব্য, ফেলাটিয়ো নাটকে যদি অভিনয় না করো তবে তোমার পরিণতি ভয়াবহ হবে। ‘মূল ঘটনা হচ্ছে ওই নাটকে আমি অভিনয়ে রাজি ছিলাম না, কারণ চরিত্রটা আমার পছন্দ হয়নি। সেখানে এমন এক নারী চরিত্রে অভিনয় করতে বলা হয় যে কিনা শক্ত-সমর্থ হওয়া সত্বেও নিজেকে রক্ষা করতে পারে না। সঙ্গত কারণে ওই চরিত্রে অভিনয় করতে আমি রাজি ছিলাম না। শেষ পর্যন্ত অস্ত্রের মুখে আমাকে বাধ্য করা হয় অভিনয় করতে। এই স্মৃতি আমি কোনোদিন ভুলব না।’ কথাগুলো এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন ম্যাডোনা।
১৯৭৯ সালের দিকে ম্যাডোনার জীবনের মোড় ঘুরে যায়। তিনি ফ্রান্সের ডিসকো আর্টিস্ট প্যাট্রিক হার্নান্তেজের সঙ্গে পারফর্ম করার সুযোগ পান। তারপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি এই বিশ্বখ্যাত গায়িকাকে। ক্রমশ শুধু সামনে এগিয়ে গেছেন।