স্মরণীয় বরণীয়
অনাদিকাল থেকে নারীকে তার অধিকার আদায় করে নিতে গিয়ে বারবার নামতে হয়েছে সংগ্রামে। সমাজ এবং সমাজনিয়ন্তা পুরুষ কখনোই নারীকে তার প্রাপ্য মর্যাদা দিতে চায়নি। তাই ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের এ ভূখন্ডে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে নারীকে ভেদ করে আসতে হয়েছে এক অকল্পনীয় অচলায়তন। যাঁরা এই অচলায়তন ভেঙে বের হয়ে আসতে পেরেছেন তাঁরা ইতিহাসের পাতায় স্মরণীয় হয়ে আছেন নারী জাগরণের অগ্রদূত হিসেবে। এমন পাঁচ পথিকৃৎ নারীর কথা জানাচ্ছেন রিক্তা রিচি।
বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন
বাঙালি মুসলিম সমাজে নারী জাগরনের পথিকৃত এবং উনবিংশ শতাব্দীর একজন খ্যাতিমান বাঙালি সাহিত্যিক ও সমাজ সংস্কারক হিসেবে মর্যাদাপূর্ন একটি নাম বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। তাঁর জন্ম ১৮৮০ সালের ৯ ই ডিসেম্বর রংপুর জেলার মিঠাপুকুর থানার পায়রাবন্ধ গ্রামে। পিতা জহীরুদ্দিন মোহাম্মদ আবু আলী হায়দার এবং মাতা রাহাতুন্নেসা সাবেরা চৌধুরানীর ৬ সন্তানের মধ্যে বেগম রোকেয়া একজন।
তৎকালীন মুসলিম সমাজব্যবস্থা অনুসারে নারীদের জ্ঞান অর্জনের জন্য কোনো বিদ্যাপীঠে পাঠানো হতো না। সে অনুযায়ী বেগম রোকেয়া এবং তার বোনদের বাইরে পড়াশোনা করার সুযোগ হয়নি। তার আধুনিক মানসিকতা নিয়ে বেড়ে ওঠা বড়ভাই ইব্রাহীম সাহেবের প্রচেষ্টায় বেগম রোকেয়া এবং তার বোন করিমুন্নেসা ঘরে বসেই বাংলা ও ইংরেজী শিক্ষা লাভ করেন। অধীক জ্ঞানপিপাসু বেগম রোকেয়া সকল গঞ্জনা, প্রতিবন্ধকতা এড়িয়ে চুপি চুপি মোম বাতির আলোয় বড় ভাই এর নিকট থেকে বাংলা ও ইংরেজী শিক্ষা অর্জন করেন। ভাগলপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন এর সাথে ১৮৯৬ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হোন। তার স্বামীর অনুপ্রেরনায় তিনি সাহিত্যচর্চা শুরু করেন। ১৯০২ সালে পিপাসা নামের একটি বাংলা গল্পের মধ্য দিয়ে তিনি সাহিত্যজগতে পদার্পন করেন।
বেগম রোকেয়া হাস্যরস এবং ব্যাঙ্গ বিদ্রুপ এর মাধ্যমে পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর অসম অবস্থান ফুটিয়ে তুলেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য ইংরেজী রচনা “sultanas dream”. তবে সুলতানার স্বপ্ন তার অনুদিত রচনা। তার অন্যান্য গ্রন্থগুলো হল: পদ্মরাগ, অবরোধবাসিনী, মতিচূর ইত্যাদি।
১৯০৯ সালে সাখাওয়াত হোসেনের মৃত্যুর পাঁচ মাস পর ভাগলপুরে বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল নামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন যা শুধুমাত্র মেয়েদের জন্য ছিল। প্রথম অবস্থায় ছাত্রী ছিল মাত্র ৮ জন। চার বছরের মধ্যে ছাত্রী সংখ্যা হয় ৮৪। পরবর্তীতে এটি হাইস্কুলে পরিণত হয়।
তৎকালীন মুসলিম নারীসমাজকে জ্ঞানচর্চায়, অধিকার সচেতনতায়, ও মুক্তি প্রদানের লক্ষে প্রবুদ্ধ করতে সচেষ্ট হয়েছেন যে মহীয়সী নারী তিনি হলেন বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। এই মহীয়সী নারীর মৃত্যু হয় ১৯৩২ সালের ৯ই ডিসেম্বর।
.
সুফিয়া কামাল
বাংলাদেশের বিশিষ্ট মহিলা কবি ও নারী আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃত কবি সুফিয়া কামাল। কবি সুফিয়া কামালের জন্ম ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে বরিশালের শায়েস্তাবাদে। তবে তার পৈত্রিক নিবাস ছিল কুমিল্লায়। সুফিয়া কামালের জন্মের সময় মুসলমান নারীদের কাটাতে হত গৃহবন্দী জীবন। স্কুল কলেজে পড়ার সুযোগ ছিলনা। ঐ বিরুদ্ধ পরিবেশে কবি সুফিয়া কামাল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ পাননি। মা সাবেরা খাতুনের কাছে বাংলা শিক্ষা লাভ করেন। ১৯২৪ সালে মাত্র ১৩ বছর বয়সে মামাত ভাই সৈয়দ নেহাল হোসেনের সাথে বিয়ের পর থেকে তার স্বামীর অনুপ্রেরনায় সাহিত্যপাঠে মনোযোগী হোন। সাহিত্যপাঠের পাশাপাশি সুফিয়া কামাল সাহিত্য রচনা শুরু করেন। সুফিয়া কামালের প্রথম কবিতা বাসন্তী সেসময়ের প্রভাবশালী সাময়িকী সওগাতে প্রকাশিত হয় ১৯২৬ সালে। সাহিত্য সাধনা এবং নারী আন্দোলনে ব্রতী হয়ে তিনি খ্যাত হয়েছেন মহিলা কবি হিসেবে।
সুফিয়া কামালের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হল: সাঝের মায়া, মায়া কাজল, কেয়ার কাঁটা, উদাত্ত পৃথিবী ইত্যাদি। গল্প, ভ্রমণকাহিনী, স্মৃতিকথা ইত্যাদি লিখেও সুনাম অর্জন করেছেন তিনি। সুফিয়া কামাল ভূষিত হয়েছিলেন অনেকগুলো পদক ও পুরষ্কারে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল: বাংলা একাডেমি পুরষ্কার, একুশে পদক, নাসির উদ্দিন স্বর্নপদক ইত্যাদি।
১৯৯৯ সালের ২০ নভেম্বর ঢাকায় সুফিয়া কামাল মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে পূর্ন রাষ্ট্রিয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়।
.
প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার
ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নারী মুক্তিযোদ্ধা ও প্রথম বিপ্লবী শহীদ ব্যাক্তিত্ব ছিলেন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৯১১ সালের ৫ মে চট্রগ্রামের ধলঘাট গ্রামে। তার পিতা ছিলেন জগদ্বন্ধু ওয়াদ্দেদার এবং মাতা ছিলেন প্রতিভাদেবী। প্রীতিলতাকে তাঁর মা আদর করে রানী বলে ডাকতেন। ১৯১৮ সালে ডা. খাস্তগীর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক এবং ১৯২৮ সালে কৃতিত্বের সাথে মেট্রিক পাশ করেন মেধাবী ছাত্রী রানী। পরবর্তীতে পড়াশুনার এক পর্যায়ে বিপ্লবী লীলা নাগের সাথে পরিচিত হোন। অনেক দিন পর লীলা নাগের সাথে প্রীতিলতার “দীপালি সংঘ” নিয়ে কথা হয় এবং লীলা নাগ বুঝতে পারেন প্রীতিলতাকে দিয়ে দেশের কাজ হবে। তাই ফর্ম পূরন করতে বলেন তাঁকে। ১৯২৯ সালে মাস্টারদা সূর্যসেন প্রীতিলতাকে তাদের দলের সদস্য করে নেন।
তারা গোপনে দেশ এর কল্যাণে কাজ করতেন এবং বিভিন্ন অভিযান চালাতেন। ১৯৩২ সালের ২৩ সেপ্তেম্বর রাতে চট্টগ্রামে পাহাড়তলীস্থ ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমনের সিদ্ধান্ত হলে সুর্যসেন এই অভযান এর দায়িত্ব দেন প্রীতিলতাকে। সে দিনের আক্রমনে প্রীতিলতার সাথে যারা ছিলেন তারা হলেন: কালিকিংকর দে, প্রফুল্ল দাশ, বীরেশ্বর রায়, শান্তি চক্রবর্তি, সুশীল দে, পান্না সেন প্রমুখ। তিনভাগে বিভক্ত হয়ে বিপলবীরা আগ্নেয়াস্ত্র হাতে আক্রমণ শুরু করেন। আক্রমণ শেষে সবাই ফিরে আসলেও সুস্থভাবে ফিরে আসেননি প্রীতিলতা। তিনি গুলিবিদ্ধ হোন। কিন্তু তিনি যে ছিলেন অগ্নিকন্যা। জীবন দেবেন তবুও ইংরেজদের হাতে ধরা দেবেন না তাই গুলিবিদ্ধ অবস্থাতেই “পটাশিয়াম ছায়ানাইড” খেয়ে আত্মদান করলেন।
.
নবাব ফয়জুন্নেসা
নবাব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী ছিলেন এশিয়ার প্রথম মহিলা নবাব। তিনি শিক্ষিত হয়েছেন তার অদম্য ইচ্ছাশক্তির কারনে। তিনি জন্মগ্রহন করেন কুমিল্লার হোমনাবাদ পরগনার অন্তর্গত পশ্চিমগায়ে ১৮৩৪ সালে। তার বাবা ছিলেন জমিদার আহমেদ আলী চৌধুরী এবং মা ছিলেন আরাফান্নেসা চৌধুরানী।
পড়াশুনায় প্রবল ইচ্ছাশক্তি ছিল বলে বাবা তাঁর জন্য গৃহশিক্ষক নিয়োগ করেন। গৃহশিক্ষকের সাহায্যে তিনি বিভিন্ন ভাষায় যেমন বাংলা, আরবী, ফারসি, সংস্কৃত পারদর্শী হোন।
জমিদার সৈয়দ মোহাম্মদ গাজীর সাথে ১৮৬০ সালে বিয়ে হয় নবাব ফয়জুন্নেসার। তাঁর সংসারজীবন সুখের হয়নি। তাই বিচ্ছেদ ঘটে। ১৮৭৩ সালে তার বাবা মারা যাওয়ার পর পশ্চিমগাও এর জমিদারী লাভ করেন। দেশে বিদেশে শিক্ষা প্রচারে নবাব ফয়জুন্নেসার অবদান অনন্য। অবৈতনিক মাদ্রাসা, নওয়াব ফয়জুন্নেসা সরকারী কলেজ, নওয়াব ফয়জুন্নেসা ও বদরুন্নেসা উচ্চবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। স্বাথ্য রক্ষা ও চিকিৎসার জন্য তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ফয়জুন্নেসা জানানা হাসপাতাল। সাহিত্যচর্চায় নবাব ফয়জুন্নেসার রয়েছে বিশেষ অবদান। তিনি ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্রের সমসাময়িক লেখক। রুপজালাল, সঙ্গীত লহরী, সঙ্গীত সার তার রচনা।
নবাব ফয়জুন্নেসা তার কাজের স্বীকৃতি সেভাবে পাননি। মহারানি ভিক্টোরিয়া ১৮৮৯ সালে তাকে “নওয়াব” উপাধি দেন। ২০০৪ সালে তিনি মরনোত্তর একুশে পদক লাভ করেন।
এই মহীয়সী নারীর পরলোকগমন করেন ১৯০৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর।
.
জাহানারা ইমাম
শহীদ জননী, কথা সাহিত্যিক, শিক্ষাবীদ এবং একাত্তরের ঘাতক দালাল বিরোধী আন্দোলনের নেত্রী জাহানারা ইমামের জন্ম ১৯২৯ সালের ৩ মে। তার পুত্র শফী ইমাম রূমী পাকিস্থানী সেনাবাহিনীদের হাতে নির্মমভাবে শহীদ হোন। রূমীর শহীদ হওয়ার সুবাদে তিনি শহীদ জননীর মর্যাদায় ভূষিত হোন। ১৯৪২ সালে মেট্রিক, ১৯৪৪ এ আইএ এবং ১৯৪৭ এ বিএ পাশ করেন। যুক্তরাষ্ট্র থেকে সার্টিফিকেট ইন এডুকেশন ডিগ্রি অর্জন করেন ১৯৬৪ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৫ সালে এম এ পাশ করেন। কর্মজীবনে তিনি বিভিন্ন স্কুল কলেজে শিক্ষকতা করেছেন। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মুল কমিটি প্রতিষ্ঠা, গনআদালতের রায় প্রতিষ্ঠায় তার ভুমিকা সক্রিয় ছিল।
জাহানারা ইমাম শিশু সাহিত্য, অনুবাদ গ্রন্থ, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক রচনা ইত্যাদি রচিত করেছেন আপন হাতের মাধুরী দিয়ে নিপুন কালির আঁচরে। ‘একাত্তরের দিনগুলি’ তার শ্রেষ্ঠ রচনা। পুরস্কার ও সম্মাননা হিসেবে তিনি পেয়েছেন বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ সাহিত্য পুরষ্কার, বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরষ্কার, রোকেয়া পদক, সাহিত্য পদক সহ অনেক পুরষ্কার। এই মহীয়সী নারী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ১৯৯৪ সালের ২৬ জুন।