দস্যি মেয়েটিই পেপসিকোর প্রধান
নীলিমা হক রুমা : যাঁর নামের সাথে জড়িয়ে আছে বিভিন্ন বিশেষণ, যার সফলতার গল্প শুনে অসংখ্য নারী পেতে পারেন এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা ও ঘুরে দাঁড়ানোর সাহস তিনি হচ্ছেন পেপসিকো লিমিটেডের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইন্দ্রা কৃষ্ণমুর্তি নুই। ভারতীয় এই নারী কীভাবে পৌঁছে গেছেন সাফল্যের শীর্ষে সেই গল্পই শোনাব আজ।
১৯৫৫ সালের ২৮ অক্টোবর মাদ্রাজে জন্মগ্রহণ করেন ইন্দ্রা কে নুই। তিনি ১৯৭৪ সালে মাদ্রাজ ক্রিস্টিয়ান কলেজ থেকে একইসাথে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও গণিতে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৭৬ সালে ইন্ডিয়ান ইন্সিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট থেকে এমবিএ ডিগ্রী সম্পন্ন করেন। ১৯৭৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল স্কুল অব ম্যানেজমেন্ট থেকে পাবলিক অ্যান্ড প্রাইভেট ম্যানেজমেন্ট এর উপর মাস্টার্স ডিগ্রী লাভ করেন।
ক্যারিয়ারের শুরুতেই তিনি জনসন অ্যান্ড জনসন কোম্পানিতে প্রোডাক্ট ম্যানেজার হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৯৭৮ সালে মাস্টার্স ডিগ্রী সম্পন্ন করে বোস্টন কনসাল্টিং গ্রুপে যোগদান করেন এবং পরবর্তীতে মটোরোলা এবং এশিয়া ব্রাউন বভেরিতে স্ট্রাটেজি পজিশনে কর্মরত ছিলেন। পরবর্তীতে, ১৯৯৪ সালে ইন্দ্রা নুই পেপসিকো’তে প্রেসিডেন্ট হিসেবে যোগদান করেন এবং ২০১১ সালে চিপ ফাইনান্স অফিসার পদে যোগদান করেন। এক দশকের বেশি সময় যাবত তিনি কোম্পানির গ্লোবাল স্ট্রাটেজি’র দিকটি পরিচালনা করছেন এবং পেপসিকোকে পুনঃর্গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ইন্দ্রা নুই চিপ ফাইনান্স অফিসার হিসেবে যোগদান করার পরপরেই কোম্পানির বার্ষিক নিট আয় ২.৮ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ৬.৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয় যা কোম্পানির জন্য বড় একটা অর্জন। ২০০৬ সালে তিনি পেপসিকো’র ৪৪ বছরের ইতিহাসে পঞ্ছমতম প্রধান নির্বাহী অফিসার হিসেবে উন্নীত হন। ইন্দ্রা নুইয়ের কৌশলগত দিক নির্দেশনা তার কোম্পানিকে ব্যাপকভাবে সফলতা এনে দেয়। তিনি পেপসিকোর পণ্যকে তিনটি তালিকায় ভাগ করেন – ফান ফর ইউ, বেটার ফর ইউ ও গুড ফর ইউ। আর সেটা থেকেই অনেকটা বুঝা যাচ্ছে তিনি যে সত্যিকার অর্থেই সৃজনশীলতা ও দক্ষতার দিক দিয়ে কয়েক ধাপ এগিয়ে এবং কোম্পানিকে প্রতিনিয়ত উন্নয়নের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন একনিষ্ঠভাবে। ইন্দ্রা নুই পেপসিকো’র সকল পণ্যের স্বাস্থ্যগত ও গুণগত মানোন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।
সফল এই নারী তাঁর কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সম্মাননা। ব্যাবসাক্ষেত্রে ব্যাপক সফলতার জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রভাবশালী ও ক্ষমতাধর নারীর তালিকায় শীর্ষ অবস্থানে স্থান করে নিয়েছেন ইন্দ্রা নুই। ফোর্বস ম্যাগাজিন ২০০৮ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত টানা সাত বছর বিশ্বের ১০০ ক্ষমতাধর নারীর তালিকায় তাঁকে শীর্ষ মর্যাদা প্রদান করে। ফরচুন ম্যাগাজিন কর্তৃক প্রকাশিত ব্যাবসাক্ষেত্রে সফল নারীদের বার্ষিক তালিকায় ২০০৬ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ইন্দ্রা নুই প্রথম অবস্থানে রয়েছেন। ২০১৪ সালে ফরচুন ম্যাগাজিন কর্তৃক প্রকাশিত ক্ষমতাধর নারীর তালিকায় তৃতীয় অবস্থানে রয়েছেন তিনি। ২০০৯ সালে গ্লোবাল সাপ্লাই চেইন লিডার গ্রুপ কর্তৃক বছরের সেরা সিইও হিসেবে স্বীকৃতি পান। সর্বশেষ, ২০১৫ সালে ফোর্বস ম্যাগাজিন কর্তৃক প্রকাশিত ক্ষমতাধর নারীর তালিকায় ১৫তম অবস্থানে রয়েছেন। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল কর্তৃক প্রকাশিত ৫০ জন প্রভাবশালী নারীর তালিকায় স্থান করে নিয়েছেন ইন্দ্রা নুই। প্রতিভাবাবান, ক্ষমতাধর ও প্রভাবশালী নারী ইন্দ্রা নুই’র ঝুলিতে এমন আরোও অনেক অনেক স্বীকৃতি রয়েছে।
বলা বাহুল্য এই নারীর সফলতার স্বপ্নগাথার শুরু কোথায় আসলে? হ্যাঁ, মাদ্রাজে জন্মগ্রহণ করা ইন্দ্রা নুই’র বেড়ে ওঠা সেই সমাজেই যেখানে রক্ষণশীলতা কঠিনভাবে বিরাজমান ছিল। তবে সেই রক্ষণশীল সমাজকাঠামোর বাইরে এসে নিজের মতো করে বেড়ে ওঠার যে সাহসিকতা দেখিয়েছেন সেটাই তাঁর নারী হিসেবে সফলতার শীর্ষে ওঠার মূলমন্ত্র। তিনি গাছে চড়া থেকে শুরু করে সবরকম দস্যিপনায় মেতে থাকতেন যা দেখে তাঁর বাবা-মা বিস্মিত ও চিন্তিত হতেন। তবে তাঁর পরিবারের পুরুষ সদস্যদের চিন্তাভাবনা ছিল এমন যে, নারীদের অবশ্যই সবকিছুতে সমান অধিকার থাকতে হবে। পরিবারের পুরুষ সদস্যদের এমন দৃষ্টিভঙ্গিকে তিনি নিজের জন্য সৌভাগ্য হিসেবেই মনে করেন আর এটাই ছিল তাঁর জন্য সবচেয়ে বড় প্রেরণার উৎস। তাঁর মতে – ‘আমি দস্যি মেয়ে ছিলাম কিন্তু আমি একজন ভালো শিক্ষার্থী ছিলাম, বাবা-মায়ের ভালো মেয়ে ছিলাম। তাই আমি কখনো এমন কিছু করিনি যা আমার পরিবারে অসম্মান বয়ে আনে।’ তিনি বলেন, চলার পথে তাঁর শৈশবের সময়টিকে সবসময় স্মরণ করেন যা কিনা পেপসিকো’র ক্রমাগত সমৃদ্ধির জন্য মূল ভূমিকা পালন করে।
ব্যাক্তিজীবনে ইন্দ্রা নুই দুই কন্যা সন্তানের জননী। ফোর্বোস ম্যাগাজিন কর্তৃক প্রকাশিত বিশ্বের ক্ষমতাধর মায়ের তালিকায় তৃতীয় স্থানে তাঁর অবস্থান। মা হিসেবে তিনি যেমন সফল তেমনি মেয়ে হিসেবে অনেক দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। শত ব্যস্ততর মাঝেও তিনি প্রতিদিন দুই থেকে তিনবার মাকে ফোন করে খোঁজখবর রাখেন। সম্প্রতি ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট কলকাতায় অনুষ্ঠিত ৫০তম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিতে গিয়ে সবার উদ্দেশে বলেন- ‘কখনোই বাবা-মা কে বলবে না তুমি ব্যস্ত আছো, আমি পঞ্চাশটি কোম্পানি পরিচালনা করি এবং এখন পর্যন্ত আমার মা’কে দিনে দুই থেকে তিনবার ফোন করি।’ তাঁর মতে, আমাদের মনে করা উচিত যে আজকের সফলতা আমাদের একার অবদান নয়। তাই সামনে যা আছে তা নিয়ে পরে না থেকে পেছনের মানুষগুলোকেও মনে রাখতে হবে। আর জীবনে সফল হতে হলে উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে কাজ করে যেতে হবে।
তথ্যসূত্র : উইকিপিডিয়া, পেপসিকো লিমিটেড, ফরচুন ম্যাগাজিন, ফোর্বস ম্যাগাজিন, দ্যা ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, বিজনেস ইনসাইডার, দ্য হিন্দু ।