এক রিয়েল লাইফ হিরোইনের গল্প
- হাসনাত কাদীর
সিনেমার পর্দায় অনেকেই নায়িকা হন। হয়ে ওঠেন পর্দার তারকা। কিন্তু পর্দার বাইরে কতজন সত্যিকারের তারকা? সে সংখ্যা খুব অল্প। সেই অল্প সংখ্যক ‘রিয়েল লাইফ হিরোইন’দের অন্যতম যিনি- তিনি হলেন পারভীন সুলতানা দিতি। যেন উপন্যাসের পাতা থেকে উঠে এসেছেন। কোনো ছোট-খাটো নায়িকা নন তিনি। দু’হাতে বাধা ঠেলে এগিয়ে যাওয়া এক দৃঢ়চেতা নারী!
নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁও। সোনারগাঁও এর শান্ত সুন্দর গ্রাম দত্তপাড়া। দত্তপাড়ায় প্রতিদিন ভোর হয় এক মিষ্টি মেয়ের গানের সুরে। মেয়েটি রেওয়াজ করে, গান গায়। স্কুলের অনুষ্ঠানে মুগ্ধ করে শ্রোতাদের। উপহার নিয়ে বাড়ি ফেরে। শিশু একাডেমী আয়োজিত প্রতিযোগিতায় অর্জন করেন জাতীয় পুরস্কার। বাবা-মা, পাড়া-প্রতিবেশীর বুক ভরে ওঠে গর্বে। বালিকার দিন কাটে গান আর দস্যিপনায়। দিন যায়, মাস যায়, বেড়ে ওঠে বালিকা। পড়াশোনার জন্যে দত্তপাড়া থেকে ঢাকা আসে সে। তখন কিশোরী বয়স তার। কিশোরী বড় হয়, বড় হয় সাথে তার স্বপ্ন। এখন সে গান করে বিটিভিতে।
দিতি’র দু’চোখ ভরা স্বপ্ন— দেশবিখ্যাত শিল্পী হবে সে। এমন সময় বাস্তবতা বদলে দিল তার গতিপথ। মানস বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিপরীতে ‘লাইলি মজনু’ নাটকে তাকে ডাকলেন আল মনসুর। তিনি এলেন, অভিনয় করলেন। ব্যাপক সাড়া পেলেন দর্শক মহলে। কণ্ঠশিল্পী দিতি’র আড়ালে লুকানো অভিনেত্রী সত্ত্বা প্রকাশ পেতে শুরু করল ধীরে ধীরে। স্বপ্নের আড়লে থাকা স্বপ্ন এবার ডানা মেললো। বড় অভিনেত্রী হবেন দিতি। অভিনয়ে হাসাবেন, কাঁদাবেন। আর জয় করবেন মানুষের হৃদয়। যেখানে স্বপ্নের আনাগোনা সেখানেই দিতি দুর্দান্ত। কিন্তু সময় তখন গত শতকের আশির দশক। দেশটা বাংলাদেশ। কোন মুসলিম পরিবার থেকে মেয়ের অভিনয়ে নামা সহজ কাজ না। বাঁধা হয়ে দাড়ায় পুরো সমাজ। সে বাধায় দেয়াল হয়ে ওঠে স্বয়ং পরিবার। থমকে দাঁড়াতে হয় দিতিকে।
কিন্তু দিতি কি থেমে যাবেন চিরতরে? মৃত্যু হবে স্বপ্নের? আগেই বলেছি দিতি ‘রিয়েল লাইফ হিরোইন’। নিজ যোগ্যতায় দু’হাতে বাধা ঠেলে এগিয়ে যাওয়া দৃঢ়চেতা এক নারী। স্বপ্ন জয়ে কোন বাধাই তাকে আটকে রাখতে পারে না।
১৯৮৪ সাল। এফডিসি’র ‘নতুন মুখের সন্ধ্যানে’ অডিশন দিলেন তিনি। স্বপ্ন, সাধনা, চাওয়া আর মেধার মিলন ঘটলে আটকে থাকে না কেউ। সুনিশ্চিত ভাবেই ধরা দেবে সাফল্য। দিতি নির্বাচিত হলেন। প্রস্তাব এলো বড় পর্দায় অভিনয়ের। স্বপ্ন সত্যি হতে কয়েক কদম বাকি। কিন্তু সেই কয়েক কদম যেন হিমালয়ের মত দুর্গম!
বাব-মা, আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী। যেন বাধার সুউচ্চ দেয়াল। মেয়ে সিনেমায় নামবে। ‘সিনেমায় নামা’ মানে চরিত্রের চূড়ান্ত বিসর্জন। জাত কূল সম্মান—সব যে ডুবে যাবে! সমস্ত প্রতিকূলতার মাঝে দাঁড়িয়ে দিতি অবিচল। তিনি ভাবেন, সমাজ যেভাবে দেখে তা-ই চূড়ান্ত দৃষ্টিকোণ নয়। লোকে যা বলে তা-ই শেষ কথা নয়। তিনি ভাবেন—জীবন আসলে কী? জীবন আসলে কেন?
জীবন তো একবারই পায় মানুষ। বাঁচতে হয় পবিত্র আনন্দের জন্য। স্বপ্নকে মুঠোয় পোরাতেই আনন্দ। চরিত্র-সততা-নৈতিকতা— সব নিজেরই ভেতর। সময় পাল্টায়। সময়ের সাথে বদলায় মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি। আজ যা দৃষ্টিকটু কালই তা হতে পারে সর্বজনগৃহীত। আর সাফল্য বদলে দেয় প্রচলিত মূল্যায়ন পদ্ধতিকেও। দিতি দেয়ালের দিকে তাকান। দেয়ালের ওপাশে তাঁর স্বপ্ন। কাঙ্ক্ষিত জীবন তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। জীবন সম্পর্কে এতসব ভেবে— কিংবা কে জানে হয়ত কিছুই না ভেবে শুধু স্বপ্নেরই টানে— দিতি টপকে গেলেন বাধার বিশাল দেয়াল।
লাইট…ক্যামেরা…অ্যাকশন…। উদয়ন চৌধুরীর ‘ডাক দিয়ে যাই’ ছবিতে দিতি অভিনয় করছেন মন-প্রাণ ঢেলে। ছবি মুক্তি পাবে। দর্শক একাত্ম হয়ে যাবে তাঁর চরিত্রের সুখে-দুঃখে। করতালিতে ভরে যাবে প্রেক্ষাগৃহ। কত স্বপ্ন! কিন্তু স্বপ্নেরও পতন আছে।
ছবিটি ৮০ শতাংশ কাজের পর থেমে গেল। কিন্তু হতাশ হলে তো চলবে না। ‘ডাক দিয়ে যাই’ থেমে গেছে। দিতি থামেননি। অফার এলো ‘আমিই ওস্তাদ’ ছবিতে অভিনয়ের। দিতি মন-প্রাণ সপে দিলেন আজমল হুদা’র ছবিতে। ছবি মুক্তি পেল। করতালিতে মুখোর হল প্রেক্ষাগৃহ নবাগতা এক নায়িকার অভিনয়ে। বাংলা সিনেমায় যেন এক নতুন যুগের আভাস পাওয়া গেল।
সে সময়ের তরুণ নায়ক সোহেল রানা। ‘হীরামতি’র শুটিংয়ে পরস্পরের প্রেমে পড়েন দিতি আর সোহেল রানা। প্রেম তো আসেই। রূপালী পর্দার নায়িকার জীবনেও আসে। কিন্তু ক্যারিয়ারের চিন্তায়, গ্ল্যামার হারানোর ভয়ে তারা পাশ কাটিয়ে যান। বয়স চল্লিশ ছুঁয়ে গেলেও প্রকৃতিকে অস্বীকার করে বোকার মত আলোর মোহে পড়ে থাকেন কত নায়িকা। দিতি সেই বোকার দলে নন। তিনি কান পাতেন তাঁর হৃদয়ে। জানলেন, অনেক আলোর ঝলকানি নয়—জীবন বেশি মোহনীয়। খ্যাতির চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বেশি ভালোবাসা। ভালোবেসে তিনি বিয়ে করলেন। ঘর বাঁধলেন সোহেল রানার সাথে। ১৯৮৭ তে জন্ম নিল মেয়ে লামিয়া। ’৮৯ তে ছেলে দীপ্ত। সুখের জীবন। কিন্তু সুখ বেশিদিন সইলো না। ঘর ভেঙ্গে গেল। ১৯৯৮ এর ১৭ ডিসেম্বর রাতে সোহেল রানা খুন হলেন বনানীর ট্রাম্পস ক্লাবে।
জীবন থেমে থাকে না। মাথা উঁচু করে দাঁড়ান দিতি। জীবন এগিয়ে যায়। পাশে এসে দাঁড়ান তাঁর সবচে’ বেশি সংখ্যক সিনেমার নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন। কিন্তু তাঁর সাথেও অল্প সময়েই বিচ্ছেদ। তারপর আর কারো ছায়া তিনি খোঁজেন নি। একাকী হেঁটেছেন বহুপথ। একা। দু’ হাতে আগলে রেখেছেন দুই সন্তান। বুকের সবটুকু ভালোবাসায় মানুষ করেছেন তাদের।
২০১৫ সালে হঠাৎই ধরা পড়ল দিতির মস্তিষ্কে বাসা বেঁধেছে মরনব্যাধি ক্যানসার। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দিতি শুয়ে আছেন চেন্নাইয়ের হাসপাতালে। তখন তিনি তাঁর সন্তানদের বলেছিলেন, ‘আমি যদি অসুস্থ না হতাম তাহলে তো কোন দিনও জানতাম না আমাকে কত মানুষ ভালোবাসে। তোমরা যে এত যুদ্ধ করতে জানো আমি তো কোনো দিনও ভাবি নাই। পৃথিবীতে ডাক্তাররা, নার্সরা এত ভালো হতে পারে এটা তো কোন দিনও জানতাম না। এত হাজার হাজার মানুষ যে আমার জন্য দোয়া করছে, এটাই তো আমার সবচে’ বড় পাওয়া। এখন আমার কোন কিছু নিয়ে কোন চিন্তা নাই, দুঃখ নাই…।’
হাসপাতালে ক্যান্সার রুগীদের জন্য কাউন্সিলর রয়েছে। দিতি কে বলা হল কাউন্সিলরের সাথে কথা বলতে। তিনি রাজি হলেন। কিন্তু কথা বলতে পাঠালেন মেয়ে লামিয়াকে। নিজেকে নিয়ে তাঁর যত না চিন্তা তাঁর চে’ বেশি দুশ্চিন্তা মেয়ে কষ্ট পাচ্ছে ভেবে!
তিনি একজন অভিনেত্রী। দিন শেষে চেহারাই তাঁর কাছে সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কথা। কেমোথেরাপির সময় দিতি’র চুল পড়ে যাচ্ছিল। মনখারাপ হওয়ার কথা। কিন্তু না। তিনি মনখারাপ করেন নি। তিনি পারভীন সুলতানা দিতি। খুব সহজ ভাবেই গ্রহণ করেন জীবনের মন্দ-ভালো। তিনি চুলগুলি যত্ন করে একটি থলেতে জমাতে শুরু করলেন। সুস্থ হয়ে দু’টি পরচুলা বানাবেন। একটি নিজের জন্য। আরেকটি বন্ধুর জন্য উপহার। বন্ধুটির চুল পড়ে যাচ্ছে!
একজন জীবনবোধ সম্পন্ন দার্শনিকের মতোই জীবনকে তিনি গ্রহণ করেছিলেন খুব সহজ ভাবে। যেখানে ভালোবাসা এবং ভালোবাসাই সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ। ভালোবাসার বিনিময়ে যিনি ভালোবাসাই চেয়েছিলেন এবং পেয়েছিলেন ভালোবাসাই। ১৯৬৫ সালের ৩১ মার্চ নারায়ণগঞ্জ এর সোনারগাঁও-এ জন্ম নেয়া দিতি গত ২০ মার্চ পুরো দেশকে চোখের জলে ভাসিয়ে চলে যান না ফেরার দেশে। একা। একেবারেই একা। পিছে পড়ে রয় ২৮ বছরে অভিনীত প্রায় ২ শত সিনেমা। পড়ে রয় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার। গাওয়া গান। আর তাঁকে ঘিরে কত মুগ্ধতা, কত শত স্মৃতি। কত ভালোবাসা।
নায়িকা অনেকেই হয়। অনেকেই হারিয়ে যায় লাইট আর মেকাপের প্রলেপে। ব্যক্তিসত্ত্বা হারিয়ে হয়ে ওঠে রঙ করা পুতুল। তোতা পাখির মত মুখস্ত সংলাপ আওড়াতে পারে খুব। কিন্তু নিজস্ব দর্শন আর জীবনবোধের পেয়েলাটা শুন্য। এর ব্যতিক্রম যারা তাঁরা সংখ্যায় খুব বেশি নন। সেই অল্পসংখ্যক বাংলা সিনেমার নায়িকার ভেতর দিতি অনন্য।
এফডিসি’তে জানাজা শেষে দিতিকে নেয়া হল দত্তপাড়া গ্রামে। এই সেই উজ্জ্বল বালিকা বেলার গাঁ, কৈশোরের স্মৃতি বিজড়িত জমিন। সকাল থেকে এখানে প্রিয় মানুষটির বিদায় বেলায় ভালোবাসা জানাতে ভীড় করেছেন শত শত মানুষ। তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনায় এক মিনিট নিরবতা পালনের পর ছুটি হয়ে গেছে স্কুল-কলেজ। ভীড়ের ভেতর থেকে একজন বয়স্কা মহিলা বললেন- এত বড় শিল্পী, কোন দেমাগ দেখিনি কোন দিন। দত্তপাড়া বেড়াতে আসলে সবার সাথে কী আন্তরিকতার সাথে মিশেছে! সবার সঙ্গে কী ভালো সম্পর্ক ছিল তাঁর! মেয়েটা এত তাড়াতাড়ি চলে গেল…!
যারাই দিতিকে কাছ থেকে দেখেছেন, তারাই জানেন বয়স্ক মহিলাটি তাদের মনের কথাটা বলেছেন— যতটা সত্যি বলেছেন, ততোটাই খাঁটি।