অজোপাড়াগাঁ থেকে সহ-উপাচার্য
- জোবায়ের চৌধুরী
‘আমারে তুমি অশেষ করেছ, এমনি লীলা তব/ ফুরায়ে ফেলে আবার ভরেছ জীবন নব নব…!’ নিজের জীবনের উত্থান-পতনের গল্প বলতে গিয়ে কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এ গানের কথা স্মরণ করিয়ে দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) প্রথম নারী সহ-উপাচার্য, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ বাংলা সাহিত্যের অন্যতম গবেষক অধ্যাপক ড. শিরীন আখতার।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সহ-উপাচার্য হিসেবে সদ্য নিয়োগ পাওয়া ড. শিরীন আখতার তার অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন, ‘আমি সাহিত্যের শিক্ষার্থী। শিক্ষকতা ও সাহিত্যকে ভালোবাসি। সহ-উপাচার্য একটি দাপ্তরিক পদ মাত্র; শিক্ষকতা নিয়েই আমি সন্তুষ্ট এবং শিক্ষিকাই আমার মূল পরিচয়। সাহিত্যকে ধারণ করেই বাঁচতে চাই।’
কথায় কথায় জানা হয় হয় শৈশব, কৈশোর ও বেড়ে ওঠা। তিনি জানান, ১৯৫৬ সালে কক্সবাজার জেলার ঈদগাহ উপজেলার এক অজোপাড়া গায়ে জন্মগ্রহণ করেন এই সফল নারী। কক্সবাজারে তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হলেও চট্টগ্রাম শহরে স্বপরিবারে এসে ১৯৭৩ সালে ডা. খাস্তগীর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও ১৯৭৫ সালে চট্টগ্রাম গার্লস কলেজ থেকে এইচএসসি সম্পন্ন করেন তিনি। এরপর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) থেকে ১৯৮০ সালে বিএ অনার্স ও পরের বছর ১৯৮১ সালে এমএ ডিগ্রী লাভ করেন। এছাড়াও ১৯৯১ সালে ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রীও অর্জন করেন তিনি।
দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে নারীর অবস্থান ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ড. শিরীন আখতার বলেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী, জাতীয় সংসদের স্পিকারসহ দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে নারীরা আসীন। উচ্চপর্যায়ে নারীদের অবস্থান সন্তোষজনক হলেও সমাজের নিম্ন-মধ্য পর্যায়ে নারী ক্ষমতায়ন তেমন আলোর মুখ দেখেনি। শিশুহত্যা-নারী নির্যাতন অব্যাহত থাকলে দেশ কখনও এগিয়ে যেতে পারবে না। তাই প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা ও আন্দোলনের।
কর্মজীবনে ড. শিরীন আখতার চট্টগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজসহ বন্দরনগরীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেন। ১৯৯৬ সালে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। এর এক দশকের মাথায় ২০০৬ সালের ২৫ জানুয়ারি অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন এই শিক্ষাবিদ। একই বছর নজরুল জন্মজয়ন্তী চট্টগ্রাম কর্তৃক নজরুল পদক সম্মাননায়ও ভূষিত হন তিনি। এ কৃতী গবেষকের ১৪টি গবেষণা প্রবন্ধসহ দেশ-বিদেশ থেকে প্রকাশিত গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধ রয়েছে। এছাড়াও তিনি ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, থাইল্যান্ড, সৌদি আরব, সিঙ্গাপুর এবং সংযুক্ত আরব আমীরাত সফর করেছেন।
ছাত্ররাজনীতি প্রসঙ্গে ড. শিরীন আখতার বলেন, ‘আমার স্বামী ও ভাই ছাত্ররাজনীতি করতো। ছাত্ররাজনীতি কখনই খারাপ ছিল না, এখনও খারাপ নয়। অস্থির সমাজ ব্যবস্থার ছাপই বর্তমানে ছাত্ররাজনীতিকে নেতিবাচক অবস্থানে এনেছে।’ ইতিবাচক রাজনৈতিক পরিবর্তনের মাধ্যমে সেই সত্তর দশকের সোনালী ছাত্ররাজনীতিতে ছাত্রনেতারা ফিরে যেতে পারবে বলেও মনে করেন তিনি।
কক্সবাজার জেলা আওয়ামীলীগের প্রথম সভাপতি ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ‘কিং মেকার’ বলে খ্যাত আফসার কামাল চৌধুরীর সুযোগ্য কন্যা ড. শিরীন আখতার। ছয় ভাই বোনের মধ্যে তার অবস্থান দ্বিতীয়। অনার্স ১ম বর্ষে থাকাকালীন মুক্তিযুদ্ধের ২নং সেক্টরের ২নং ব্যাচের বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর (অব) লতিফুল আলম চৌধুরীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। পারিবারিক জীবনে এক ছেলে ও এক মেয়ে সন্তানের জননী তিনি। রাজনৈতিক জীবনে তিনি বেশ কয়েকবার কক্সবাজার জেলা মহিলা আওয়ামীলীগের সদস্যও ছিলেন। ছোটবেলায় বেশ কয়েকবার বঙ্গবন্ধুর সানিধ্যও পেয়েছেন তিনি।
এছাড়াও ড. শিরীন আখতার বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছেন। বাংলা একাডেমীর আজীবন সদস্য, ‘উৎস’র নির্বাহী পরিচালক, চিটাগাং ক্লাবের সদস্য, ‘টিআইবি’র সদস্য এবং সাংসস্কৃতিক গোষ্ঠী ‘সন্দীপনা’, ‘অবসর’সহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের নানা দায়িত্বে রয়েছেন তিনি।
তরুণদের উদ্দেশে এই পথিকৃত নারী বলেন, ‘থেমে গেলে চলবে না। স্বপ্ন দেখতে হবে। ষাট বছরে এসেও আমি স্বপ্ন দেখি। এখনও আমি রূপকথার গল্প পড়ি স্বপ্ন দেখার লক্ষ্যে।’