মেয়েকে লেখা চন্দা কোচারের চিঠি

মেয়েকে লেখা চন্দা কোচারের চিঠি

  • শিমি আক্তার

চাকরিজীবী মা-বাবার পক্ষে বীরত্বপূর্ণ কাজ করা বা ভেলকি দেখানো এত সহজ কাজ নয়। তবু কেউ কেউ চমক দেখানো সাফল্য অর্জন করেন। মহিলাদের কাছে এ ক্ষেত্রে এক জলন্ত উদহারণ হয়ে উঠেছেন ভারতের আইসিআইসিআই  ব্যাংকের প্রধান ‍নির্বাহী চন্দা কোচার। তিনি পেশাদারিত্ব ও পারিবারিক জীবনে সমানভাবেই ভেলকি দেখিয়েছেন।

সম্প্রতি সুধা মেননের লিগেছি নামক একটি বইতে ‘লেটার ফ্রম এমিনেন্ট প্যারেন্টস টু দেয়ার ডটারস’ শীর্ষক একটি লেখায় চন্দা তাঁর মেয়ে আরতিকে উদ্দেশ্য করে একটি চিঠি লিখেছেন।

কী লিখেছেন সেই চিঠিতে চন্দা? চলুন দেখা যাক:


প্রিয় আরতী

এটা দেখে  আজ আমি অত্যন্ত গর্ব বোধ করছি যে, তুমি আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছো একজন আত্মবিশ্বাসি তরুণী হিসেবে, যে জীবন চলার পথে সঠিক প্রান্তে এসে উপস্থিত হয়েছে। আমি দেখতে চাই, তুমি আগামী দিনগুলোতে অনেক উন্নতি ও সমৃদ্ধি লাভ করেছ।

এই মুহুর্তে আমাকেও আমার অতীত জীবনের স্মৃতি মনে করিয়ে দিচ্ছে। চলার পথে জীবনের শিক্ষাটা আমি পেয়েছি নিঃসঙ্গতা থেকে। যখন আমি ওই সময়টা চিন্তা করি আমি বুঝতে পারি যে  শৈশবকালেই এসব শিক্ষার অধিকাংশ শিখেছি, যার বেশিরভাগ উদাহরণই আমার মা-বাবার। তারা ধীরে ধীরে যে মূল্যবোধের ভীতটা আমার মাঝে তৈরি করে দিয়েছেন তার মধ্য দিয়ে আজও আমি আমার জীবনটাকে চালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি।

মা-বাবা আমাদের দুইবোন ও এক ভাইকে সমানভাবে মানুষ করেছেন। আমাদের শিক্ষা-দীক্ষা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় মা-বাবা কোনো লিঙ্গ বৈষম্যের আশ্রয় নেননি।

chanda-and-daughterতোমার নানা-নানি আমাদের তিন ভাই-বোনকেই সর্বদা একই বার্তা দিতেন। তাঁরা আমাদের সন্তুষ্টির উপর মনোযোগ দিতন এবং আমাদের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতেন। তাঁদের সেই উদ্যোগ আমাদেরকে আলাদাভাবে আত্মবিশ্বাস বাড়াতে ও স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম করেছে এবং আত্মোউন্নয়নের জন্য এটা আমাকে সাহায্যও করেছে।

আমার বয়স যখন তের, তখন আমার বাবা হঠাৎ করেই হার্ট অ্যাটাকে মার যান। আমার মা তখন পর্যন্ত হোমমেকার ছিলেন। তার উপর তিন সন্তানের দায়িত্ব এসে পড়ল। এখন আমরা বুঝতে পারি, আমার মা তখন কত শক্ত ছিলেন এবং তিনি সর্বোত্তমভাবে দায়িত্ব পালনে দৃঢ় প্রত্যয়ী ছিলেন। ধীরে ধীরে তিনি ডিজাইন ও টেক্সটাইলের উপর দক্ষতা অর্জন করেন, একটি ছোট ফার্মে চাকরি পান এবং দ্রুতই তিনি প্রতিষ্ঠানের জন্য অপরিহার্য হয়ে ওঠেন। একহাতে পুরো পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে তা পালন করা তার জন্য অবশ্যই চ্যালেঞ্জিং ছিল, কিন্তু তিনি কখনোই আমাদেরকে তাঁর কষ্ট বুঝতে দেননি। তিনি আমাদের কলেজে ওঠা পর্যন্ত কঠোর পরিশ্রম করে গেছেন। আমি কখনো জানতাম না যে, আমার মায়ের এমন আত্মনির্ভরতা ও আত্মবিশ্বাসের মতো বড় সম্পদ ছিল।

যাইহোক। দক্ষতার সঙ্গে খারাপ পরিস্থিতিতে মোকাবেলা করা ও সামনে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখা কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা আমি আমার মায়ের কাছ থেকে শিখতে পেরেছি।

তোমাকে কঠিন পরিস্থিতির মোকবেলা  করতে হবে এবং  সেখান থেকে বলিষ্ঠভাবে বেরিয়ে আসতে হবে। আমার মনে পড়ে, ২০০৮ সালের শেষের দিকে কীভাবে আমরা একটা পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিলাম যেখানে বিশ্ব অর্থনীতির মন্দার কারণে  আইসিআইসিআই ব্যাংকে  টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছিল। প্রধান গণমাধ্যমগুলো খুব সুক্ষ্মভাবে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে এবং জনসন্মুখে ব্যপকভাবে  এই নিয়ে আলোচনা হয়। আমি সকল স্টেকহোল্ডারদের সাথে নিয়মতান্ত্রিকভাবে যোগাযোগ রক্ষা করি।ব্যাংক যে ভালো অবস্থায় ছিল তা বিনিয়োগ কারীদের কাছে তুলে ধরি।

আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে অনেকেই ভীত হয়েছিল এই ভেবে যে  তাদের কষ্টে অর্জিত জমাকৃত সঞ্চয় ও বিনিয়োগ ঝুঁকিতে পড়তে পারে। আমি ব্যাংকের বিভিন্ন শাখার কর্মচারীদের নির্দেশ দিয়েছিলাম যেসব আমানতকারী টাকা তুলতে আসবে তাদের কথা সহানুভুতির সঙ্গে শুনুন, তাদের বসতে বলুন, এক গ্লাস পানি পান করতে দিন এবং যদি আমানতকারীরা  টাকা তুলতে চায়, তাদের  স্বাগত জানান। আর তাঁদেরকে বুঝিয়ে বলুন যে ব্যাংক প্রকৃতপক্ষে খারাপ অবস্থায় নেই।

কীভাবে পরিস্থিতি মানিয়ে নিতে হয় এবং অজানা কিছুর জন্য ভয় না পাওয়ার শিক্ষাটাও আমি আমার মায়ের কাছ থেকে শিখেছি। আমার পেশার জন্য কঠোর পরিশ্রমের সময়েও আমার পরিবারকে দেখাশোনা করতে হয়েছে এবং প্রয়োজনে আমার মায়ের পাশেও থাকতে হয়েছে। বিনিময়ে তারা তাদের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা ও পেশার জন্য সমর্থন যুগিয়েছে। মনে রাখবে সম্পর্ক বজায় রাখা খুবই গুরত্বপূর্ণ। আরো মনে রাখবে যে একটি সম্পর্ক হলো দ্বিমুখী রাস্তা। সুতরাং, প্রস্তুত থাকো তুমি অন্যকে যতটা দিতে পারবে বিনিময়ে ঠিক ততটাই ফেরত পাবে।

chanda-1-1460612281
স্বামী দীপক কোচার ও কন্যা আরতীর সঙ্গে চন্দা কোচার। ছবি : ইন্ডিয়া নিউজ।

পেশাগত কারণে আমাকে বাইরে যতটা সময় কাটাতে হয়েছে তাতে যদি তোমার বাবা অভিযোগ করতো তাহলে আমি কোনভাবেই এতটা পথ এগিয়ে যেতে পারতাম না। তোমার বাবা ও আমি প্রত্যেকেই নিজ নিজ পেশাগত কারণে ব্যস্ত থাকার পরেও আমাদের সম্পর্ককে আমরা প্রতিপালন করেছি এবং আমি বিশ্বাস করি যখন সময় আসবে তুমিও তোমার স্বামীর সঙ্গে একইভাবে আমাদের পথ অনুসরণ করবে। আমার বাড়িতে দীর্ঘ  সময় অনুপস্থিতির জন্য  যদি তোমার অভিযোগ থাকতো এবং ঘ্যানঘ্যান করতে, ক্যারিয়ার গঠনের প্রতি আমি কখনোই মনোযোগী হতে পারতাম না। আমি ভাগ্যবতী যে  এমন মহান এবং সহযোগীতাপরায়ন পরিবার পেয়েছি এবং সত্যিই আশাকরি তোমার বেলায়ও এমনটিই হবে !

আমার  ওই দিনের কথা মনে পড়ে যেদিন তোমার বোর্ডের পরীক্ষা শুরু হয়, আমি ছুটি নিলাম যাতে আমি নিজে তোমাকে পরীক্ষার হলে নিয়ে যেতে পারি। যখন তুমি বুঝতে পারলে আমি আসছি, তুমি আমাকে বললে কীভাবে তুমি এত বছর একাকী পরীক্ষা দিতে যেতে। তোমার বলা সেদিনের সেই কথা শুনে আমি কষ্ট পেয়েছিলাম, কিন্তু আমিও কিছু বিকল্প পথের কথা ভেবেছিলাম। চাকরীজীবি মা হিসেবে তোমাকে অনেক ছোট বেলায় অনেক স্বাধীনতা দিয়েছি। তোমাকে শুধুই স্বাধীনতা দেওয়া হয়নি, তোমার ছোট ভাইযের প্রতিপালনের ভুমিকাও তোমাকে দেওয়া হয়েছিল এবং কখনোই  আমার অনুপস্থিতি তাকে বুঝতে দাওনি।  আমি তোমার প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা রেখেছিলাম  এবং তুমি এখন বড় হয়েছ একজন চমৎকার স্বাধীনচেতা তরুণী হিসেবে।

আমি ভাগ্যে বিশ্বাসী। কিন্তু আমি আরো বিশ্বাস করি যে, কঠোর পরিশ্রম এবং অধ্যবসায় আমাদের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করতে পারে। স্বপ্ন সেইগুলে যা তুমি অর্জন করতে চাও, এবং রচনা কর তোমার নিজের মতো করে। যেহেতু তোমাকে সামনে এগিয়ে যেতে হবে, আমি চাই তুমি সফলতার জন্য সেই পথে পা বাড়াও। দেখবে, একসময় সফল হবে। আকাশ ছোয়ার লক্ষ্য স্থির করো, কিন্তু ধীরে ধীরে চলো।  একাকী চলার পথে প্রত্যেকটা পদক্ষেপ উপভোগ করো। যারা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পদক্ষেপে এগিয়ে যায়, তাঁরা সফলতার সাথে যাত্রা শেষ করতে পারে।

তোমাকে সামনে এগিযে যাওয়ার জন্য কিছু কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হতে পারে, যা অন্যরা অবজ্ঞা করতে পারে। কিন্তু তুমি যা বিশ্বাস করো তোমার সেই সিদ্ধান্তে অটুট থাকার জন্য অবশ্যই সাহস রাখো। কাউকে দোষী সাব্যস্ত করার আগে নিশ্চিত হও যে তুমি যা জানো তাই সঠিক । তোমার পথ থেকে সন্দেহকে  দূরে সরিয়ে রাখো।

আরতি, মন দৃঢ় থাকলে সবই অর্জন করা যায়, কিন্তু তোমার লক্ষ্য অর্জনে কখনো সততা ও ন্যায়ের বিরুদ্ধে কোনো কিছুর সাথে আপোস করবে না। তোমার স্বপ্নপূরণের জন্য কোনো কিছুতে ছাড়  দিও না। মনে রাখবে তোমার প্রতি তোমার আশেপাশের জনগণের একটা স্পর্শকাতর  আবেগ রযেছে এবং আরো খেয়াল রাখবে তোমাকে ফিরে পেতে তুমি যদি চাপকে প্রশয় না দাও, এটা কখোনোই তোমার জীবনে কোন ইস্যু হতে পারবে না।

মনে রাখবে  ভালো ও খারাপ সময় দুটোই সমানভাবে জীবনের অংশ হতে পারে এবং তোমাকে শিখতে হবে উভয় সময়ে  কীভাবে নিজেকে সঠিকভাবে পরিচালিত করতে হয়। তোমাকে অনেক সুযোগ তৈরী করতে হবে এবং প্রতিটি সুযোগ থেকে শিক্ষা নিতে হবে ও তা একাকি মোকাবেলা করতে হবে।

ইতি

তোমার মা

সূত্র : ভোগ ম্যাগাজিন। ইংরেজি থেকে অনুবাদ : শিমি আক্তার

Sharing is caring!

Leave a Comment