সুই–সুতায় জীবনের নকশা
- লিডারশিপ ডেস্ক
বাঙালি গৃহবধূ বলতে আমাদের চোখের সামনে নারীর যে চেহারা ফুটে ওঠে, তা থেকে তিনি আলাদা। তিনি সংগ্রামী, পরোপকারী এবং পরিশ্রমী। পরিশ্রম করে শুধু নিজের ভাগ্যবদলই করেননি, গ্রামের অনেক নারীকে স্বাবলম্বী হওয়ার পথ দেখিয়েছেন। তাঁর সহায়তায় সুই-সুতা দিয়ে কাপড়ে নকশা তুলে রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার অন্তত তিন শ নারী দাঁড়িয়েছেন নিজের পায়ে। এই গৃহবধূর নাম শিল্পী বেগম। সবার কাছে তিনি প্রিয় শিল্পী আপা। কুটিরশিল্পের ১৬ ধরনের কাজে পটু তিনি। প্রায় দিনই ঘুম থেকে উঠে বেরিয়ে পড়েন। কাজ নিয়ে মোটরসাইকেলে ছুটে চলেন তারাগঞ্জে বিভিন্ন গ্রামে। কাজ বুঝিয়ে দিয়ে ফেরেন বাড়িতে। দরিদ্র নারীদের দুঃখ ঘোচাতে এ তাঁর অন্য রকম আন্দোলন।
শিল্পীর বাড়ি রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার জিগারতলাগ্রামে। দশম শ্রেণিতে উঠে ১৯৯৬ সালে ১৫ বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয় পলাশের নাটুয়াপাড়া গ্রামের আবদুল হান্নানের সঙ্গে। স্বামী ছিলেন বেকার। অভাব ছিল নিত্যসঙ্গী। প্রায়ই অনাহারে-অর্ধাহারে থাকতে হতো। কিন্তু শিল্পীর স্বপ্ন ছিল পরিবারের অবস্থা ফেরানোর। ১৯৯৭ সালে এসএসসি পাস করে চাকরি খোঁজা শুরু করেন। ডিগ্রি পাস স্বামীর ব্র্যাকে একটা চাকরি জুটলেও বেকারই থাকতে হলো শিল্পীকে।
শুরুর কথা
বাবার বাড়িতে মায়ের কাছে শিল্পী শিখেছিলেন সুই-সুতার কাজ। সেটা কাজে লাগানোর জন্য একটা সেলাই মেশিন কিনলেন। নিজ বাড়িতে শুরু করেন কাপড় সেলাইয়ের কাজ। এতে কিছু আয় হয়। দুই বছরের আয়ের টাকায় কেনেন একটি গাভি ও চারটি ছাগল। তাঁর নতুন জীবনের গল্প এখান থেকেই শুরু।
২০০৪ সালের জুন মাসের কথা। শিল্পী মেনানগর গ্রামে ননদ রাজিয়া খাতুনের বাড়িতে বেড়াতে যান। সেখানে মইনুল হক নামের এক ব্যক্তির অধীনে কয়েকজন নারীকে শাড়িতে নকশা তোলার কাজ করতে দেখেন। কাজটি তাঁর মনে ধরে। কাজটি শিখতে তিনি আগ্রহী হন। কিছুদিন পর ননদের বাড়িতে দিন দশেক থেকে মইনুলের কাছে শিখে নেন সেই কাজ। সেটা কাজে লাগিয়ে মেয়েদের পোশাক তৈরির জন্য একটি দোকান খোলার সিদ্ধান্ত নেন। ভাবলেন, এখানে তৈরি করা পোশাক হবে আলাদা, যাতে থাকবে সুই-সুতার কাজ।
এই ভাবনা থেকেই ২০০৫ সালে ৬০০ টাকা দিয়ে একটি কাঠের ফ্রেম কেনেন। নিজ বাড়িতে শুরু করেন সেলাই ও হাতের কাজ। ধীরে ধীরে এই পোশাকের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে এলাকায়। আয় ও ব্যবসার পরিধি বেড়ে যাওয়ায় তারাগঞ্জ বাজারে পোশাক বিক্রির জন্য একটি দোকান করেন। পসার বেড়ে যাওয়ায় ২০০৭ সালে স্বামী চাকরি ছেড়ে তাঁকে সহায়তা করতে থাকেন।
এগিয়ে চলা
শাড়িতে নকশা তোলার গল্প শুনে ২০০৯ সালে শিল্পীর বাড়িতে আসেন ঢাকার কাপড় ব্যবসায়ী এজাজ উদ্দিন। এজাজের ঢাকায় কয়েকটি কাপড়ের শোরুম রয়েছে। তিনি শিল্পীকে ঢাকায় নিয়ে যান। স্থানীয় এজেন্ট মনোনীত করে তাঁর হাতে তুলে দেন শাড়ি, পাঞ্জাবি ও থ্রি পিসে নকশা করার সরঞ্জাম। এজেন্ট হওয়ার পর শিল্পীর কাছে শাড়ি ও পাঞ্জাবি তৈরির কাপড়, সুতা ও উপকরণ আসতে থাকে। তখন এ কাজের সঙ্গে গ্রামের দরিদ্র ও অভাবী পরিবারের নারীদের যুক্ত করার চিন্তা করেন শিল্পী।
২০১০ সালে গ্রামের ৫০ জন দরিদ্র নারীকে নিয়ে গঠন করেন ‘হতদরিদ্র কর্মজীবী মহিলা উন্নয়ন সমিতি’। তাঁদের প্রশিক্ষণ দিয়ে নকশা ও কারচুপির কাজে লাগিয়ে দেন। প্রথমে ৫০ জনের মতো নারী এই কাজ শুরু করলেও বর্তমানে সদস্য ২৮০ জন। কারিগরেরা লেহেঙ্গায় নকশা করার জন্য ৫০০ টাকা, শাড়িতে ৭০০ টাকা, পাঞ্জাবি ও থ্রি পিসে ৪০০ টাকা করে মজুরি পান। শাড়ি, থ্রি পিস, পাঞ্জাবিতে নকশার কাজ করিয়ে দেওয়ার জন্য শিল্পী ৯০ টাকা করে কমিশন পান। এই আয়ের টাকায় আবাদি জমি ও পাকা বাড়ি করেছেন। কিনেছেন মোটরসাইকেল। তারাগঞ্জ বাজারে কাপড়ের দোকান তো রয়েছেই। তাঁর এক মেয়ে নুসরাত নাহার রংপুর কারমাইকেল কলেজে, আরেক মেয়ে নওশীন নাহার তারাগঞ্জ মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে।
সেই গ্রামে একদিন
সম্প্রতি এক সকালে জিগারতলা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, গ্রামটির নারীরা পাঞ্জাবি, লেহেঙ্গা, শাড়িতে নকশা তোলার কাজ করছেন। একটি সাধারণ কাপড়ে নকশার কাজের পর কতটা অসাধারণ হয়ে ওঠে, তা না দেখে বিশ্বাস করা কঠিন। সেখানকার বেশির ভাগ বাড়িতে চকচক করছে টিনের চালা। খড়ের ঘর নেই বললেই চলে। গ্রামের নারীরা শাড়িতে সুই দিয়ে চুমকি, জরি, পুঁতি বসানোর কাজে ব্যস্ত।
মাহামুদা আক্তার (৪০) নামের এক কারিগর জানান, এখন ঢাকার ব্যবসায়ী ছাড়াও বিভিন্ন জেলা-উপজেলার পাইকারেরা অর্ডার দিয়ে শাড়িতে নকশার কাজ করে নেন। তাঁরাই এখন শাড়িতে কাজ করতে প্রয়োজনীয় সুই-সুতা, চুমকি, জরি ও পাথর দেন। প্রতিটি শাড়ির মজুরি বাবদ কারিগরদের দেওয়া হয় ৬০০-৭০০ টাকা। একজন নারী কারিগর মাসে ছয়-সাতটি শাড়িতে নকশার কাজ করতে পারেন।
সামাজিক কর্মকাণ্ড
সমিতিতে গিয়ে দেখা যায়, শিল্পী বেগম সদস্যদের নিয়ে বৈঠক করছেন। সমিতির সদস্য ছাড়াও বাইরের নারীরা শাড়িতে নকশার কাজ করেন। তাঁরা সপ্তাহে সমিতিতে ২০ টাকা করে সঞ্চয় দেন। সদস্যদের এ সঞ্চয়ের টাকা দিয়ে গরু কিনে মোটাতাজা করার জন্য সদস্যদের মধ্যে বর্গা দেওয়া হয়েছে। এ খাত থেকে আসা আয়ের ১৫ শতাংশ অর্থ গ্রামবাসীর কল্যাণে ব্যয় করা হয়।
মর্জিনা বেগম নামের এক সদস্য বলেন, এ পর্যন্ত গরিব ঘরের ১৪টি মেয়ের বিয়েতে সহযোগিতা করা হয়েছে, চিকিৎসার জন্য ১১ জনকে টাকা দেওয়া হয়েছে। ৪ জন নারীর সন্তান প্রসবের সময়ও সহায়তা করা হয়েছে।
সমিতির আরেক সদস্য রশিদা খাতুন বলেন, এ সমিতির সদস্যরা সবাই সমান পরিশ্রম করেন। সবাইকে কাজও ভাগ করে দেওয়া আছে। সমিতির ১৬ জন নারী নিয়ে এক একটি দল গঠন করা আছে। এ দলের সদস্যরা মাসে একবার ঘরে ঘরে গিয়ে জন্মনিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে নারীদের ধারণা দেন। শিশুদের সময়মতো টিকা দেওয়া হয়েছে কি না খোঁজ নেন।
তাঁরা যা বললেন
তারাগঞ্জ উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান মাহামুদা বেগম বলেন, কী করে ছোট্ট একটি সুই-সুতার কাজ বিশাল কর্মযজ্ঞ হয়ে উঠতে পারে, তা শিল্পীর কাছে শিখতে হবে। শিল্পীর হাত ধরে গ্রামের নারীরা বাঁচার পথ খুঁজে পাচ্ছেন। অন্য এলাকার নারীরাও তাঁদের দেখে অনুপ্রেরণা পাবেন।
উপজেলার ইউএনও জিলুফা সুলতানা বলেন, ‘শিল্পীর কর্মকাণ্ড দেখে আমরা একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছি। ওই প্রকল্পের অধীনে উপজেলা পরিষদের অফিসার্স ক্লাবের হলরুমে শিল্পী বেগম বিনা পারিশ্রমিকে হতদরিদ্র নারীদের শাড়ি, পাঞ্জাবি ও থ্রি পিসে নকশা করার প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন।’
শিল্পীর উদ্যোগের প্রতি সম্মান আছে স্বামী হান্নানের। বললেন, ‘শিল্পীর কর্মকাণ্ডে আমি খুশি। আমি ব্যক্তিগতভাবে তাঁকে সব সময় উৎসাহ দিয়ে থাকি। লোকজন যখন শিল্পীর প্রশংসা করে, স্বামী হিসেবে আমার গর্ব হয়।’
সূত্র: প্রথম আলো