মালিহার সহজ উদ্যোগ
- লিডারশিপ ডেস্ক
নামটা ‘সহজ’ হলেও কাজটা মোটেও সহজ নয়। কাজের চাপে দম ফেলার সময় নেই। তবু মুখে তৃপ্তির হাসি লেগেই আছে। এ হাসিই নাকি পঞ্চাশের অধিক কর্মীর কাজের অনুপ্রেরণা। মালিহা এম কাদির; আমেরিকা কিংবা সিঙ্গাপুরের উন্নত জীবনের মায়া ছেড়ে দেশের মানুষকে আধুনিক সেবা দিতে উদ্যোগ নিয়েছেন হার্ভার্ড বিজনেস স্কুল থেকে এমবিএ সম্পন্ন করা এ উদ্যমী নারী। নামিদামি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করলেও সহজ তার প্রথম উদ্যোগ। স্বপ্নটা তাই একটু বড়।
কর্মজীবী নারী হিসেবে পেশাজীবনের শুরু থেকেই মালিহা এম কাদিরের ভাবনাজুড়ে জীবন কীভাবে আরো সহজ হবে। আমেরিকায় থাকাকালীন সময়ে ‘রিয়েল সিম্পল’ নামের একটি ম্যাগাজিন পড়তেন। এটা তার প্রিয় ম্যাগাজিন। এর থিম হলো ‘হাউ টু মেইক লাইফ সিম্পল’। নানান ধরনের কাজ কীভাবে দ্রুত ও সহজে করা যায়, সেসব নিয়েই তৈরি হয়েছে এ ম্যাগাজিন। অন্যদিকে মালিহার কল্পনার বিষয় প্রযুক্তির মাধ্যমে কীভাবে মানুষের জীবন সহজ করা যায়। দুই ভাবনা একযোগ হয়েই জন্ম হয় সহজডটকমের।
মালিহা এম কাদিরের শৈশব কেটেছে ঢাকায়। মা-বাবার একমাত্র সন্তান, ছোটবেলা থেকেই ক্লাসে প্রথম ছিলেন। বাবা রিয়েল এস্টেট ব্যবসা ও মা জীবন বীমা করপোরেশনে কাজ করতেন। মা-ই তার অনুপ্রেরণার উৎস।
মালিহার মা-বাবার দেশের বাইরে গিয়ে পড়াশোনার শখ ছিল। সেখান থেকে তারও বিদেশে পড়াশোনার আগ্রহ জন্মে। ইংলিশ মিডিয়ামে ও লেভেল সম্পন্ন করে মালিহা আমেরিকায় চলে যান। সেখানে স্মিথ কলেজে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইকোনমিকসে স্নাতক শেষ করেন।
এর পর ২০০০ সালে ক্যারিয়ারের শুরুতে মরগান স্ট্যানলির মার্জারস অ্যান্ড একিউজিশন টিমে কাজ শুরু করেন। মার্কেট একিউজিশনে কোম্পানিগুলো যখন মার্জ করে, সেগুলোর ফিন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিস করতেন তিনি। সে সময় অনেকটা শ্রম দিতে হয়েছে তাকে। কখনো রাত ৩টা-৪টা পর্যন্ত অফিসে কাজ করতে হতো। নিজের লক্ষ্য পূরণে সে কষ্টগুলোও সয়ে নিয়েছিলেন।
মালিহার পরিকল্পনা ছিল একটি ভালো অভিজ্ঞতা অর্জন করে দেশে ফিরে কিছু করার। ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকিং সেক্ষেত্রে ভালো একটা শেখার জায়গা। তাই হাল না ছেড়ে দিয়ে লেগে রইলেন। টানা তিন বছর কাজ করলেন সেখানে। এ সময়টায় স্বামী খালিদ কাদিরের কাছ থেকে দারুণ সহযোগিতা পেয়েছেন বলে জানান মালিহা। খালিদ কাদির ব্রুমার অ্যান্ড পার্টনারসের একজন অংশীদার। মালিহার এগিয়ে যাওয়ার পথে তার অভিজ্ঞতাও কাজে লেগেছে অনেকটা।
মরগান স্ট্যানলিতে কাজ করতে করতেই একসময় হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএ করার সিদ্ধান্ত নেন মালিহা। হার্ভার্ডে এমবিএ পড়ার সময় ২০০৫ সালে তার প্রথম সন্তান আনুশকার জন্ম। ছোট্ট মেয়ে আনুশকাকে নিয়েই হার্ভার্ড থেকে ২০০৮ সালে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেন। এর মধ্যখানে দুই বছর বাংলাদেশে ব্র্যাকনেটেও কাজ করেন মালিহা। ব্র্যাকনেটে ক্ল্যাসিফাইড কন্টেন্ট নিয়ে কাজ করতেন। হার্ভার্ড থেকে এমবিএ শেষে তিনি সিঙ্গাপুরে ব্যাংকিং সেক্টরে কাজ শুরু করেন। এক বছর কাজ করেন স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকে এবং পরে নকিয়ায় সিনিয়র ম্যানেজার হিসেবে ডিজিটাল কন্টেন্ট সার্ভিসে যোগ দেন।
নকিয়া লাইফ টুলস ডিজিটাল সার্ভিসের ইমার্জিং মার্কেট বিজনেস ডেভেলপমেন্ট সেক্টরটি তিনি দেখতেন। যেখানে মোবাইল গ্রাহকদের এ সার্ভিসের মাধ্যমে কৃষি, স্বাস্থ্য, ইংরেজি শিক্ষা নিয়ে এসএমএসএ পরামর্শ দেয়া হতো। ভারত, চীন, ইন্দোনেশিয়া— এ তিন দেশ ছিল তার দায়িত্বে। তিনি জানান, সেখান থেকেই মূলত বাংলাদেশেও এমন কিছু করা যায় কিনা, সে ভাবনার জন্ম। নকিয়ার প্রতিনিধি হিসেবে বাংলাদেশে আসেন সার্ভিসগুলো চালুর সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে। কিন্তু নকিয়া পরিকল্পনা থেকে সরে এলে সিঙ্গাপুরে ইউরোপীয় অনলাইন কোম্পানি ভিসতাপ্রিন্ট ডটকমে যোগ দেন মালিহা। কোম্পানি তাদের ইমার্জিং মার্কেট এক্সপেনশন করার জন্য তাকে নিয়োগ দেয়। এ সময়ে বিভিন্ন দেশ নিয়মিত ভ্রমণ করতে হতো তার। ভিসতাপ্রিন্টে কাজ করার সময় থেকেই বাংলাদেশে আসার বিষয়টি মনস্থির করে ফেলেন।
বাংলাদেশে এসে বোঝার চেষ্টা করেন, এখানকার ইন্টারনেটের কী অবস্থা। দেখলেন, বাংলাদেশের ইন্টারনেট সেবা অনেকটাই সহজ হয়ে গেছে। ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ছে দিন দিন। বিভিন্ন অনলাইন ক্লাসিফাইড সাইটগুলো জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। চাকরি ছেড়ে দিয়ে সিঙ্গাপুরে বসেই সহজের টিম গোছানো শুরু করেন। একদিন সিঙ্গাপুর থেকে ফোনে সহজের পরিকল্পনার কথা জানালে বাবা মজা করে বলেছিলেন, ‘তুমি তো পাগল। এত ভালো চাকরি ছেড়ে দেশে এসে তুমি বাসের টিকিট বিক্রি করবে।’ কিন্তু দৃঢ়প্রত্যয়ী মালিহা এম কাদির তার সিদ্ধান্তে অনড় রইলেন। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশে পাকাপাকিভাবে চলে আসেন। এর এক মাস পর জানুয়ারি থেকে পুরোদমে কাজ শুরু করেন। লোভনীয় চাকরি ছেড়ে নিজেই উদ্যোগী হয়ে প্রতিষ্ঠা করলেন সহজডটকম। এ মুহূর্তে অনলাইনে ২৫টি বাস ও ১২টি লঞ্চ অপারেটরের টিকিট বিক্রি হচ্ছে সহজডটকমে। হোটেল রিজার্ভেশন, ইভেন্টের টিকিট বিক্রির পাশাপাশি এ বছর তাদের সেবায় যোগ হয়েছে সিনেমার টিকিট বিক্রিও।
মালিহা এম কাদির জানান, সহজ তার প্রথম উদ্যোগ। কাজটা অনেক মজার। যারা সহজ ব্যবহার করছেন, তারা নাকি বোঝেন এর মজাটা। তবে অনলাইন ব্যবহার অনেকে কঠিন মনে করেন। কারণ তারা এভাবে টিকিট কিনে অভ্যস্ত নন। তাই অনলাইনে মানুষকে নতুন নতুন এ ধরনের সেবায় অভ্যস্ত করাটাই বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন মালিহা এম কাদির।