কল্পনা থেকে বাস্তব
- লিডারশিপ ডেস্ক
আমি খুব কল্পনাপ্রবণ মেয়ে। হয়তো গল্পের বই পড়ছি বা সিনেমা দেখছি; সেটা শেষ হওয়ার আগেই কল্পনার জাল বুনতে শুরু করি। কল্পনায় তো আর হারিয়ে যেতে মানা নেই, তাই না? আমিও হারিয়ে যাই। একদম ছোটবেলা থেকে আমার কল্পনার একটা রাজ্য ছিল। সে রাজ্যে আমিই নায়ক। সেই আমি ভীষণ সাহসী আর শক্তিশালী, অপরাধীদের যম। তবে নিষ্ঠুর কিন্তু নই। অনাথ-আতুরদের জন্য মন কাঁদে আমার। নায়ক হিসেবে আমার পরনে সব সময় পুলিশের পোশাক থাকত। আসলে বোধ-বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে আমি শুধু পুলিশ কর্মকর্তা হওয়ার স্বপ্নই দেখেছি। যখন থেকে আমি মনে মনে
পুলিশ কর্মকর্তা, তখন যে খুব বেশি সংখ্যায় নারী পুলিশ আমরা পেয়েছি, তা কিন্তু বলা যাবে না।আমার বাবা আশরাফ আলম খান। তিনি ছিলেন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা। আমাদের বাড়ি পাবনায়। তবে বাবাকে নিয়মিত বদলি হতে হতো বলে পুরো শৈশব ছিল বৈচিত্র্যে ভরা। বাবার পোস্টিং প্রথমে ছিল পাবনার দামুড়হুদায়। সেখান থেকে কুড়িগ্রাম, যশোর, মুন্সিগঞ্জ, সিলেট ও চাঁদপুর। মাধ্যমিক পরীক্ষা অবশ্য ঢাকা থেকে দিয়েছিলাম; নানার বাসার কাছেই ধোলাইপাড় হাইস্কুল, সেখান থেকে। এরপর সেন্ট্রাল উইমেন্স কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক ও ইডেন থেকে স্নাতক এবং স্নাতোকোত্তর।
আমার বিষয় ছিল ইংরেজি সাহিত্য। নিজে পছন্দ করে সাহিত্য বেছে নিয়েছিলাম। আমার প্রিয় কবি উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ। সাহিত্যে পড়ালেখা শেষ করে প্রথমে ঢাকার রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজে ঢুকেছিলাম শিক্ষক হিসেবে। এর মধ্যে অবশ্য ২৫ তম বিসিএসটাও দিয়ে রেখেছিলাম। ক্যাডার হিসেবে প্রথম পছন্দ ছিল পুলিশ। ২৫ তম বিসিএস পরীক্ষার ফল বেরোনোর আগেই ২৬ তম বিসিএস (বিশেষ) পরীক্ষার ফল বেরোল। সব প্রক্রিয়া শেষে আমি চৌদ্দগ্রামের সরকারি কলেজে প্রভাষক হিসেবে কাজে ঢুকে পড়লাম। তবে অপেক্ষা করছিলাম পুলিশে ডাক পাব বলে। শেষ পর্যন্ত সুযোগ পেয়ে গেলাম।
একটা কথা আমার মনে হয়, আমি পুলিশের চাকরি করছি সাহিত্য পড়ে এসে। এই সাহিত্য আমাকে মানবিক হতে শিখিয়েছে। আমি যখন কোনো লাশ দেখি, আমার মনটা ডুকরে কেঁদে ওঠে। কোথাও কেউ আহত হয়েছেন, ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছেন, মনে হয় যে সে ব্যথা আমারও।
বাবা-মায়ের বড় মেয়ে আমি। এমন একটি পরিবারে জন্ম নিয়ে আমার গর্বের সীমা নেই। পরিবার থেকে আমার বা আমার ছোট ভাইবোন কারও ওপর কখনোই কিছু চাপিয়ে দেওয়া হয়নি। তবে আমি পুলিশে চাকরির সুযোগ পাওয়ার পর কেন যেন মনে হলো বাবা একটু মন খারাপ করেছেন। কারণটা আমাকে একদিন তিনি বলেও ফেললেন। আগেই বলেছি, বাবা ছিলেন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা। মেয়ে যে পুলিশ হতে চাইছে, এটাই ছিল তাঁর মনঃকষ্টের কারণ। বাবা বললেন, মানুষের মধ্যে পুলিশের একটু ইমেজ-সংকট আছে। ব্যস, এইটুকুই। এর চেয়ে বেশি কিছু তিনি বলেননি।
মায়ের দুশ্চিন্তা ছিল অন্য জায়গায়। পুলিশে এত পরিশ্রমের কাজ আমি পারব কি না। শিক্ষকতা পেশাটা মায়ের কাছে ছিল অনেক বেশি স্বস্তিদায়ক। তবে মা-ও আমার ইচ্ছাকেই মূল্য দিয়েছিলেন।
আমি পুলিশে ঢুকলাম। ফল বেরোনোর পর হাতে মাস তিনেক সময় ছিল। কিছুদিন পুলিশ সদর দপ্তরে থাকার পর আমাদের পাঠানো হলো সারদায় প্রশিক্ষণে। যাওয়ার আগেই সিনিয়ররা সারদা সম্পর্কে সতর্ক করলেন। প্রশিক্ষণের সময়টা নাকি দারুণ কষ্টের। একটা মাঠের কথা শুনলাম, সেটা নাকি এত বিশাল যে দৌড়ে পেরোনো যায় না। আমি অবশ্য তখন প্রজাপতির মতো ফুরফুরে মেজাজে। পরদিন সারদায় পৌঁছেই দৌড়ে গেলাম মাঠটা দেখতে। দেখে আমি একটুও ভড়কাইনি। কই, মাঠটা তো বেশ ছোটই মনে হচ্ছে। এই মাঠ নিয়ে এত গল্প! পরদিন সারদা প্রশিক্ষণ একাডেমি ঘুরিয়ে দেখানো হলো আমাদের। তারপর শুরু হলো প্রশিক্ষণ। ভোর চারটায় উঠে পিটি দিয়ে শুরু হলো প্রশিক্ষণ। প্রথমে স্ট্রেচিং করানো হলো। তারপর সেই মাঠ প্রদক্ষিণ। বিশ্বাস করুন, অর্ধেকটা মাঠ পেরোনোর পর আমার দম শেষ। আমরা যারা মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে—ষষ্ঠ–সপ্তম শ্রেণিতে ওঠার পর আর সে অর্থে দৌড়ে বেড়ানোর সুযোগ পাইনি—তাদের পক্ষে দৌড়ে সে মাঠ পেরোনো আসলেই কঠিন।
সারদায় আমাদের হাবিলদার র্যাংকের প্রশিক্ষকেরা ট্রেনিং দিতেন। আমরা তাঁদের ওস্তাদ বলে ডাকতাম। ওস্তাদ আমাকে বললেন, ‘আপনি দাঁড়ান। বিশ্রাম করেন। দেখেন। পরে আবার শুরু করবেন।’ আমি তা-ই করলাম। তো দৌড় শেষে ওস্তাদ বললেন পরের অনুশীলনের জন্য প্রস্তুত হতে। আমি ভাবলাম, তিনি বোধ হয় আমার সঙ্গে রসিকতা করছেন। ওমা! দেখি সত্যি সত্যি আবার ডাকা হলো। আমি গেলাম। সারাটা দিন পর যখন একটু বিশ্রামের সুযোগ পেলাম, মনে হলো আমার হাত-পা ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেছে। আমার খুব অসুস্থ লাগছিল। তাহলে কি পারব না?
বাবাকে ফোন করলাম। ‘বাবা, আমার ভীষণ খারাপ লাগছে। বোধ হয় আমি পারলাম না।’ বাবা খুব সাহস দিলেন। বললেন, ‘শখ করে যখন পুলিশেই গেছ, শেষ করে এসো। আমি চাই, তুমি হার মানবে না।’ সাহস সঞ্চয় করলাম। কিছুদিন পর দেখলাম মাঠটা শুধু দৌড়ে পেরোতে পারছি তা-ই নয়, রাইফেল কাঁধে নিয়েও দিব্যি দৌড়াচ্ছি। দেয়াল বেয়ে ওপরে উঠছি। রাইফেলটা কত বড় ছিল জানেন? প্রায় আমার সমান। কিন্তু এখনো একটা প্রশিক্ষণের কথা ভাবলে আমার ভয় লাগে।
সারদার ঘোড়াগুলো অনেকেই দেখেছেন। যাঁরা খুব একটা ধর্মকর্ম করতেন না, তাঁরাও ঘোড়ায় চড়ার দিন ভোর চারটায় উঠে আগে নামাজ পড়তেন। জিনে হাত রাখলে পড়ে যাওয়ার ভয়, আবার লাগাম ধরলে ঘোড়া দুই পা উঁচিয়ে এমন ভাবভঙ্গি করত, মনে হতো এই বুঝি গেলাম। ধীরে ধীরে সারদার জীবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠলাম। মানিয়ে নিলাম। শুধু একটা সময় মনে হলো, কোমরের কাছে প্যান্টটা দড়ি দিয়ে বাঁধতে হবে। এর মধ্যেই বাবা-মা আমাকে দেখতে এলেন সারদায়। আড়ালে নিশ্চয়ই চোখ মুছেছেন, তাঁদের আদরের মেয়ের স্বাস্থ্যের অবস্থা দেখে।
সারদার সহকর্মীরা প্রাণের বন্ধু হয়ে উঠলেন। কষ্ট ছিল একটাই। আমরা খুঁজতাম মুখরোচক খাবার। কিন্তু দেওয়া হতো পুষ্টিকর খাবার। সপ্তাহে এক দিন যদি-বা মুখরোচক কিছু দেওয়া হতো, তাতে মন ভরত না।
প্রশিক্ষণ শেষে ঢাকায় এলাম। আমার দায়িত্ব পড়ল বগুড়ায়। আমি গেলাম গাবতলী থানার দায়িত্ব নিয়ে। গাবতলী ছিল সবদিক থেকেই চ্যালেঞ্জিং। খুবই অপরাধপ্রবণ জায়গা। এখানে আসার আগে অনেকেই বলছিলেন, নারী কর্মকর্তাদের থানায় পাঠানো হয় না। আমি মনে মনে ভাবলাম, পাঠালেই বা কী। আমি তো প্রস্তুত। খুনখারাবি, চুরি-ডাকাতি—যে মামলাই হোক না কেন, আমি ঘটনাস্থলে যেতাম। মানুষের কাছাকাছি যেতে আমার সব সময়ই ভালো লাগে। একসময় বগুড়াকে বিদায় জানানোর সময় হলো। আমি ফিরলাম ঢাকায়। এপিবিএন, পুলিশ সদর দপ্তরে প্রশাসনিক কাজটাই বেশি করেছি। ঢাকা মহানগর পুলিশে (ডিএমপি) জয়েন্ট ট্রাফিক কমিশনারের অধীনে কাজ করেছি। কাজটা ছিল ট্রাফিক সমন্বয়ের। এর মধ্যেই ২০০৮ সালে বিয়ে হলো আমার। শুরু হলো জীবনের নতুন অধ্যায়। আমার বরের সঙ্গে আমার পরিচয় কাজের সূত্রে। সেও পুলিশেই আছে। আমার আর সব সিদ্ধান্তকে যেমন বাবা-মা সম্মান করেছেন, বিয়ের ব্যাপারেও আলাদা কিছু ঘটল না। দুই পরিবারই খুশিমনে মেনে নিল। তবে একসঙ্গে থাকার সুযোগ সেভাবে হলো না। আমি আইন বিষয়ে পড়তে চলে গেলাম জাপানে, আর ও শান্তিরক্ষী মিশনে সুদানে। দুজনের মধ্যে যোজন যোজন দূরত্ব তখন। আমি গত বছরের ডিসেম্বরে জাপান থেকে ফিরলাম, আর আমার স্বামী দেশে ফিরল এ বছরের মাঝামাঝি।
তবে এখনো যে সংসার খুব গুছিয়ে করছি, তা নয়। আমি উত্তরার অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার। আমার অধীনে পাঁচটি অঞ্চল—টাউন ইন্সপেক্টর থেকে এসি পর্যন্ত—প্রায় এক হাজার পুলিশের তদারক করা আমার কাজ। যতটা সম্ভব চেষ্টা করছি। ভোর সাড়ে ছয়টায় বাসা থেকে বের হই। এয়ারপোর্ট রোডটা কেমন, সে তো সবাই জানেন। খুব সতর্ক থাকতে হয়। আমার আওতায় থাকা প্রতিটি পোস্টে ফোর্স আছে কি না দেখি। দুপুরে একবার, রাতে আরেকবার টহল দিই। ঢাকার রাস্তায় যাঁরা গাড়ি চালান, তাঁরা আসলে এখনো ট্রাফিকের দায়িত্বে নারীদের খুব একটা দেখেননি। তাঁরা তো র্যাংক-ট্যাংক খুব একটা বোঝেন না। বলেন, ‘দ্যাখো, মহিলা সার্জেন্ট নেমেছে।’ কেউ কেউ আবার কায়দা করে স্যালুট দেয়। মজাই লাগে।রান্নাবান্নার জন্য বাবুর্চি আছেন। প্রথম প্রথম সানস্ক্রিন লোশন মুখে মেখে নামতাম। এখন আর ওসব ভাবি-টাবি না। সপ্তাহে একটা দিন ছুটি। সেদিন একটু আরাম করি। আরাম মানে রাত দশটার বদলে সন্ধ্যা সাতটায় বাড়ি ফেরার চেষ্টা করি। টিভি দেখি, গান শুনি। মেয়ে হিসেবে একটা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হই মাঝেমধ্যেই। একটি কথা ধরে নেওয়া হয় যে পুরুষেরা পুলিশ হিসেবে সব পারেন। কিন্তু মেয়েদের সেটা প্রমাণ করতে হয়। ভাবতে খুব ভালো লাগে, মেয়েরা যেখানে যাচ্ছে, খুব ভালো করছে। কোথাও থেমে থাকছে না। শান্তিরক্ষী মিশনে বাংলাদেশের মেয়ে পুলিশরা বেশ ভালো করছে। আমি পুলিশে আছি। এখানে ভালোভাবে আছি, থাকব, একদিন শীর্ষ পদে যাব, এই আশা করি।
হোমায়রা পারভীন: অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার, উত্তরা বিভাগ, ঢাকা