পাবনায় তিনিই প্রথম
- লিডারশিপ ডেস্ক
১৮২৮ সাল। ব্রিটিশ শাসন আমল। পাবনা তখন রাজশাহী জেলার একটি মহকুমা। ভৌগোলিক বিবেচনায় ওই বছরের ৮ অক্টোবর এক পরিপত্রে তদানীন্তন বগুড়া ও সিরাজগঞ্জ মহকুমা, নদীয়া জেলার কুষ্টিয়ার কিয়দংশ এবং রাজবাড়ীর কিয়দংশের সমন্বয়ে পাবনাকে জেলা ঘোষণা করা হয়। তখন পাবনা জেলার সর্বোচ্চ আসনটিতে আসীন হন ডব্লিউ ডি উইলস নামের একজন ডেপুটি কালেক্টর বা ডিসি। প্রায় ২০০ বছরের পাবনা জেলার জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ইংরেজ, , বাঙালিসহ ১৩৯ জন গুণী ব্যক্তি। আর এ গুণীদের সবাই পুরুষ। এ ইতিহাস ভঙ্গ হয়েছে ২০১৬ সালের ২৯ জানুয়ারি। পাবনার জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব নিলেন একজন নারী, যার নাম রেখা রানী বালো।
১৯৬৫ সালের ডিসেম্বরে মহীয়সী এ নারী জন্ম নেন উপেন্দ্র মোহন বালো এবং রেনু বালোর ঘরে। মা-বাবা আদর করে নাম রেখেছিলেন রেখা। তাদের ছোট্ট মেয়েটি একদিন দেশ ও জাতির কল্যাণে আত্মনিয়োগ করবে, প্রশাসনিক দক্ষতায় মানুষের অন্তরে রেখাপাত ঘটাবে; হয়তো এমনটা না জেনেই তার নাম রেখেছিলেন রেখা। তিনি যখন স্কুলের গণ্ডিতে পা রাখলেন, তখন পণ্ডিত মশাইয়ের খাতায় নাম লেখানো হলো রেখা রানী বালো। তিন ভাই ও চার বোনের মধ্যে রেখা রানী বালো ষষ্ঠ। বাবা ব্রিটিশ শাসন থেকে একজন এলএমএফ ডাক্তার হিসেবে নিজ গ্রাম ছাড়াও আশপাশের গ্রামের লোকের স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত ছিলেন। মা ছিলেন গৃহিণী। দক্ষিণ জামসা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক শেষে ঢাকায় চলে আসেন রেখা রানী বালো। উচ্চশিক্ষার প্রত্যয়ে ভর্তি হন ঢাকার লালমাটিয়া কলেজে। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন ১৯৯০ সালে। একই বছরে তাকে বসতে হয় বিয়ের পিঁড়িতে। সে সময় রেখা রানী ভেবেছিলেন সংসারের টানাপড়েনে হয়তো আর এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু হাল ছাড়েননি। সংসার সামলেও বিসিএসের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিলেন তিনি। এক্ষেত্রে তার স্বামী ও পরিবারের অনুপ্রেরণা বড় ভূমিকা রেখেছিল বলে মনে করেন তিনি। নিজের চেষ্টা আর স্বামীর অনুপ্রেরণাতে ১৯৯৩ সালে ১৫তম বিসিএসে কৃতকার্য হন রেখা রানী। এর পর আর পেছন ফিরে তাকানো নয়।
১৯৯৫ সালের দিকে সহকারী কমিশনার ও ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে গাজীপুরে প্রথম কর্মজীবন শুরু করেন। প্রথম চাকরির অনূভূতির কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘শুরুর দিকে আমার ভেতর এ নিয়ে তেমন কোনো ভাবনা ছিল না। কিন্তু পরে যখন এ পদের গুরুত্ব বুঝলাম তখন সংকল্প করলাম আরো বড় পদে গিয়ে দেশ ও দশের সেবা করার। সে চেষ্টাই এখন পর্যন্ত করে যাচ্ছি।’
কর্মজীবনে কোনো প্রতিবন্ধকতায় পড়েছেন কিনা, জানতে চাইলে উত্তরে রেখা রানী বলেন, ‘আমার পরিবার বরাবরই আমাকে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা জুগিয়েছে। আর কর্মজীবনের কথাই যদি বলি, তবে কিছু ক্ষেত্রে বাধা তো এসেছেই। সবটা সামলে নিয়েছি। তবে অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি, এ দেশের মানুষ নারীদের সম্মান করতে জানে। আবার নারীদেরকেও সে সম্মান অক্ষুণ্ন রেখে এগোতে হয়। ব্যক্তিগতভাবে বরাবরই আমার অবস্থান ছিল ন্যায়ের পক্ষে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে। সে দৃঢ় অবস্থানের সুবাদেই হয়তো আজ পর্যন্ত আমার কর্মজীবনে বড় ধরনের কোনো বিপদ আসেনি।’ তবে সরকারি চাকরিতে কর্মরত নারীদের রেশন ও ঝুঁকি ভাতা প্রণয়ন করা দরকার বলে মনে করেন তিনি।
রেখা রানীর মতে, স্বামী, সংসার সামলিয়েও নারীরা পারে দেশ ও দশের কল্যাণ করতে। তবে এর জন্য চাই সদিচ্ছা। সাধারণত পুরুষের তুলনায় নারীরাই সংসারের দায়িত্ব বেশি পালন করে। অন্যদিকে যারা কর্মজীবী, তারা যেমন একদিকে সংসার সামলান, তেমনিভাবে কর্মক্ষেত্রেও নিজের শতভাগ দেয়ার চেষ্টা করেন। সারা দিন কর্মব্যস্ততার শেষে বাসায় গিয়ে যখন সন্তানদের দেখা না পাওয়া যায়, তখন যেকোনো মায়েরই বুকের মাঝে নীরব যন্ত্রণা হয়। তার পরও নারীরা সহিষ্ণু।
আলাপচারিতায় সদালাপী, হাস্যোজ্জ্বল, বিনয়ী, নম্র, ভদ্র, সত্ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপসহীন পাবনা জেলা প্রশাসক রেখা রানী বালোকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, আপনার ভবিষ্যত্ পরিকল্পনা কী? ছোট্ট হাসির মাধ্যমে বললেন, বর্তমানে যেমন দেশের সেবা করছি; তেমনি পরিবারের আদর্শের বিষয়টি মাথায় রেখে দেশ ও সমাজ সংস্কারে আত্মনিয়োগ করার ইচ্ছা আছে। গ্রামের অবহেলিত নারীদের জন্য কিছু করার ভাবনাটাও রয়েছে।