কুস্তিবিদ থেকে উদ্যোক্তা

কুস্তিবিদ থেকে উদ্যোক্তা

  • লিডারশিপ ডেস্ক

তিনি দেশের হয়ে কুস্তিতে সাফল্য পাওয়া একজন পেয়েছেন ইন্দোবাংলা কুস্তি প্রতিযোগিতার স্বর্ণপদকও নামযশখ্যাতিতে খুব বেশি পুরনো না হলেও; সফল উদ্যোক্তাদের তালিকায় তিনি একেবারেই নতুন এগিয়ে চলার জিদই সবার থেকে আলাদা করে তুলেছে তাকে এক সময়ের সেরা কুস্তিগির খেলার সাম্রাজ্যকে পেছনে ফেলে তিনি এখন একজন সফল উদ্যোক্তা 


বেগম রোকেয়া বলেছিলেন, ‘আমরা উপার্জন করিব না কেন? আমাদের কী হাত-পা নেই নাকি বুদ্ধির অভাব! কী নেই? যে পরিশ্রমে আমরা কি স্বাধীন ব্যবসা করিতে পারিব না?’ কথাটি সে সময়ে ব্যাপক আলোচিত হলেও সময় পাল্টেছে। আমাদের মেয়েরা এখন আর সেকালে আটকে নেই। শুধু ছেলেরাই যে বিচিত্র সব আবিষ্কার, খেলাধুলা, ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারেন তা কিন্তু নয়। মেয়েরাও বাইরের কাজে পিছিয়ে নেই, সেটা প্রমাণ হয়েছে বার বার। যদিও বিশ্বজুড়ে মেয়েদের সফলতার গল্পগুলো বেশ চ্যালেঞ্জিং। তেমনি এক দুঃসাহসিক নারী শিরিন সুলতানা। একজন নারী হওয়া সত্ত্বেও তিনি পাড় করেছেন অনেক দুঃসাহসিক অভিযান। ভিনদেশে, দেশের হয়ে কুস্তি খেলায় সাফল্য পাওয়া দুজনের একজন। সফলতায় যুক্ত করেন ইন্দো-বাংলা কুস্তি স্বর্ণপদক। অল্প বয়সে নাম-যশ-খ্যাতিতে পরিপূর্ণ এ নারী সফল উদ্যোক্তাদের তালিকায়ও নাম লেখান। নিজ জেলা ময়মনসিংহের গ্রামের বাড়িতে গড়ে তোলেন নিজস্ব খামার। মাত্র ৩ হাজার ৬০০ মুরগি নিয়ে শুরু করা খামারে এখন এর সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়ে। পুরুষের পাশাপাশি এগিয়ে চলার জিদই সবার থেকে আলাদা করে তুলেছে তাকে। অতীত পেছনে ছাপিয়ে বর্তমানে তিনি একজন সফল উদ্যোক্তা।

indexময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া থানার পাহাড় অনন্তপুর গ্রামের শিরিন সুলতানা। বাবা হায়দার আলী মণ্ডল মারা গেছেন আগেই। মা ও দুই ভাইকে নিয়েই তার সংসার। সকালে ঘুম থেকে উঠেই বুকে বই জড়িয়ে স্কুলে যাওয়া। স্কুল থেকে ফিরে খেলার ছলে মায়ের কাছে রান্নার বায়না ধরা। শৈশবের স্মৃতি পেছনে ফেলে গ্রামের সেই মেয়েটি ভোল পাল্টে হয়ে যান দেশের সম্পদ। ভাবছেন কোনো আলাদিনের চেরাগ পেল না তো! না; তেমন কিছুই নয়। এর ইতিহাস কারও অজানা থাকার কথা নয়।

পাহাড় অনন্তপুর গ্রামের সেই শিরিন সুলতানা এক সময়ের সেরা কুস্তিগির। সেই ছোট্ট থেকেই সাফল্যের মুকুট অর্জনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন। ছোটবেলায় টিভির সামনে বসে অনেক কুস্তি খেলা দেখতেন। যদিও কখনো ভাবেননি নিজেই এ খেলায় অংশ নেবেন। ২০০৯ সালে যোগ দেন বাংলাদেশ আনসার ব্যাটালিয়নে। আনসারের হয়ে কুস্তি খেলোয়াড়ের তালিকায় নাম লেখান। একই সালে আনসারে ট্যালেন্ট হান্টে জাতীয় মহিলা ফুটবল দলের সাবেক খেলোয়াড় রেহানা পারভীনের চোখে ধরা পড়েন। ব্যস, নামিয়ে দিলেন মাঠে। সেই থেকেই মাঠ দাপিয়ে বেড়ান। কুস্তি খেলোয়াড় হিসেবে নিজেকে অল্প সময়েই ধারালো করে তোলেন। শুরু থেকেই একের পর এক সফলতা ছিনিয়ে আনেন অকপটে। ২০১০ সালে (৫৫ কেজি ওজনে) স্বর্ণ জয় করেন। শুধু ২০১০ই নয়, কুস্তিতে জাতীয় পর্যায়ে ২০১১ ও ২০১২-তেও স্বর্ণ জেতেন। দেশের বাইরে কলকাতায় ২০১৩ সালে জেতেন ইন্দো-বাংলা আন্তরেসলিং চ্যাম্পিয়নশিপ। সেখানে দেশের হয়ে স্বর্ণপদক পান। একই সালে তিনি গ্র্যান্ড ফিক্সড রেসলিংয়ে তাম্র পদক পান। এ ছাড়াও চলতি বছরে ভারতের শিলংয়ে হয়ে যাওয়া সাফ গেমসে দেশের হয়ে রৌপ্য পদক নিয়ে আসেন। ২০০৯ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত জাতীয় প্রতিযোগিতায় স্বর্ণ জেতেন। এ ছাড়াও তার সফলতার ঝুড়িতে রয়েছে সেরা খেলোয়াড় হিসেবে ক্রীড়া লেখক সমিতির পুরস্কার, শেরেবাংলা পুরস্কার, হিউম্যান রাইটস পুরস্কার এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে পাওয়া রাষ্ট্রীয় পুরস্কার। শুধু কুস্তি নয়, খেলেছেন মার্শাল আর্ট এবং কাবাডিও। এখানেই থেমে থাকেননি। পরিশ্রমকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ রেসলিং ফেডারেশনের লেবেল-২ শেষ করেন। এরপরই সুযোগ আসে নারী কোচ হওয়ার। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ রেসলিং ফেডারেশনের প্রথম নারী কোচ।

অল্প বয়সে সাফল্যের গল্পকথা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে বলেন, ‘নাম-যশ-খ্যাতি এগুলো আমার কাছে খুব পুরনো নয়, তাই নিজের ঢাক নিজে পেটাই না। আমি যেমন ছিলাম, তেমনি আছি এবং ভবিষ্যতে আরও উচ্চতায় যেতে চাই।’ এ জন্যই হয়তো তিনি গ্রামে সবার মধ্যমণি। গ্রামে সবসময়ই যাওয়া পড়ে, তাই সবাই তার সঙ্গে কথা বলতে আসেন। গ্রামের অনেক মেয়ে তাকে দেখে অনুপ্রেরণা পায়। নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে গিয়ে মৃদু হেসে বলেন, ‘প্রথম প্রথম বেশ নার্ভাস ফিল করতাম। পরবর্তীতে ভাবী, দেয়ার ইজ নাথিং লাইক প্রেশার। লোকে যখন দেশের নারী কুস্তি খেলোয়াড় বলে ডাকে; আমি সেটা বেশ উপভোগ করি।’ নিজেকে বাংলাদেশের রোল মডেল হিসেবে মানতে নারাজ। যদিও বর্তমানে তিনি উঠতি বয়সের খেলোয়াড় থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ সবার কাছে আদর্শ। তবুও তিনি তো কাউকে না কাউকে অবশ্যই আদর্শ  মানেন। সাবেক মহিলা ফুটবলার হেলেনা পারভীনের নাম বলতেই হয়। তিনিই তার অনুপ্রেরণার উৎস। এ ছাড়া তিনি বই পড়তেও ভালোবাসেন। মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যার, জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলনের বই পড়েন। তা ছাড়া কবি গুরু রবিঠাকুর ও শরত্চন্দ্র তো আছেই।

index2এই তো গেল অতীতের গল্পকথা। এবার আসি বর্তমানে। ‘একজন নারীকে সফল হতে সাহসের সঙ্গে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হয়। ভয় পেলে পিছিয়ে পরবেন এটাই স্বাভাবিক। কেননা দুনিয়াজোড়া নারীদের সফলতার গল্পগুলো বেশ চ্যালেঞ্জিং।’ কথাটি শিরিন সুলতানা বেশ মানেন। অসম্ভবকে মনের জোর আর নিজের কর্ম দিয়ে অর্জন করা যায় বলে তিনি বিশ্বাস করেন। এক সময়ের সেরা খেলোয়াড় বর্তমানে নিজেই খামার করে ব্যবসা করছেন। মাত্র ৩ হাজার ৬০০ মুরগি নিয়ে শুরু করা খামারে এখন এর সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়ে। বলাবাহুল্য, তার এই খামার থেকে বর্তমানে প্রতিদিন ১০ হাজার ডিম আসে। এ ছাড়াও সফলকামী এ নারী ২০০৯ সালে তার খামারের পাশে পরিবেশ-বন্ধু ১০০০ গাছ রোপণ করেছেন। গাছগুলো এখন বেশ বড়ও হয়েছে। এগুলো ছাড়াও তার ভবিষ্যৎ প্ল্যানিং রয়েছে বিশাল। ফিশারি খামার, ডেইরি ফার্মও শুরু করেছেন। এগুলো ছাড়াও করছেন ব্ল্যাকবেঙ্গল ছাগলের খামার।

শিরিন সুলতানা একটি ভিশন নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। তার ভিশনের নাম ‘ভিশন ২০২০’। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘প্রত্যেক সফল মানুষই একটি নির্দিষ্ট প্ল্যানিং নিয়ে এগিয়ে গেছেন। পরবর্তী সময়ে হাজারো কাঠখড় সয়ে তারা হয়েছেন দেশ ও জাতির আইডল। আমিও একটি ভিশন নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। এক দিন সফল হবই।’ নিজের এ ব্যবসায়ের অনুপ্রেরণা সম্পর্কে বলেন, ‘আমাদের দেশের মহিলা উদ্যোক্তা হেলেনা জাহাঙ্গীর ও জোবায়ের রহমান নিলু যাদের দেখে বেশ অনুপ্রাণিত।’ মূলত এদের সাফল্য দেখে নিজে কিছু করার ভাবনা। এরপরই খামার তৈরি করেন। পরিবারে মা ও দুই ভাইয়ের সহায়তায় তিনি আজকের শিরিন হয়ে উঠেছেন। বাবার রেখে যাওয়া গ্রামের সম্পত্তি কাজে লাগিয়ে গড়ে তুলেছেন এই খামার। এখানেই তিনি গড়ে তুলতে চান ফিশারি, ডেইরি ফার্ম। এক কথায়, পরিবারের সহায়তা থাকায় তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। মূলত এ পেশায় আসার আগে বাংলাদেশ আনসারের নারী কুস্তি খেলোয়াড়ের চাকরি করতেন। এ পেশা সম্পর্কে বলেন, ‘খেলায় খুব সুনাম পেলেও নিজে থেকেই ভাবতে থাকি হেলেনা জাহাঙ্গীর ও জোবায়ের রহমান নিলু আপাদের মতো কছুি একটা করব। গ্রামের ভিটেমাটি থাকাতে চিন্তা করলাম খামারই করে ফেলি। সেই ভাবনা থেকেই আজকের খামার।’ তার এক কথা, কাজের প্রতি ভালোবাসা না থাকলে কোনোভাবেই সফলতা আসে না, সেটা প্রমাণ করতে খুব বেশি কষ্ট করার প্রয়োজন নেই। পৃথিবীর সফল সব নারীর ক্ষেত্রেই এটা প্রমাণিত। তাই যে কোনো নারীর সফলতার মূলমন্ত্র হিসেবে কাজের প্রতি উৎসাহী মনোভাবকে বলা যেতেই পারে।

সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিনfavicon59-4

Sharing is caring!

Leave a Comment