আফ্রিকার শিশুদের পাশে বাংলাদেশের লতা
- লিডারশিপ ডেস্ক
বাফাতা মানে মিশনারিজ, ডায়াসোসি মানে এরিয়া বা অঞ্চল। গিনিয়া বিসাউয়া ডায়াসোসি বাফাতা বা গিনিয়া বিসাউয়ার মিশনারিজ এরিয়ার ২৬টি নিউট্রিশন সেন্টারের প্রধান তিনি। বাস করেন গাবুতে। তিনি সেখানে একমাত্র মুসলমান, যিনি সেবিকা হিসেবে কাজ করছেন। নিমন্ত্রণ পেয়ে চলতি বছরের সেপ্টেম্বরের ৪ তারিখে গিয়েছিলেন ভ্যাটিকান সিটিতে। তিনি বাংলাদেশের নাগরিক রেবেকা সুলতানা লতা। আফ্রিকার রোগাক্রান্ত ও দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের পাশে সাহায্যের হাত বাড়াতে পাড়ি জমিয়েছেন আফ্রিকায়।
রেবেকা সুলতানা বলেন, পশ্চিম আফ্রিকার একটি ছোট প্রদেশ গিনিয়া বিসাউয়া। একেবারে সেনেগালের সীমান্তে। কুসংস্কার আর জরাজীর্ণতায় পূর্ণ সমাজ। সন্তান প্রসবের সময় মা অথবা সন্তান বা উভয়ে মারা যাবে- এটা একটা নিয়ম বলেই মানে গিনিয়া বিসাউয়ার অধিবাসীরা। তাই প্রতিনিয়ত শিশু মরছে, মা মরছেন। কোনো ভাবান্তর নেই কারও। সেই মৃতের কবর দেওয়া হচ্ছে ঘরের মেঝেতে অথবা বারান্দায়। যমজ সন্তান হওয়া গিনিয়ায় স্বাভাবিক ব্যাপার। দু’জন তো বটেই, তিনজন যমজেরও দৃষ্টান্ত আছে ভূরি ভূরি। এমনও হয়, প্রসবের জন্য মাকে দু’জন মিলে উপুড় করে ঝাঁকিয়ে বাচ্চা প্রসব করানো হয়। ওরা যমজ সন্তানের শেষেরটাকে ইরাং বা বিধাতার সন্তান মনে করে। তাই শেষেরজনকে সাগরপাড়ে রেখে ওরা উৎসব করে। ভাটার স্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে যায় সেই শিশু, ওরা এটাকে বলে বিধাতা তার সন্তানকে নিয়ে গেছেন!
কখনও আবার উইপোকার ঢিবিতে রেখে দেওয়া হয় ইরাংকে। সেখানে রেখে উৎসব করে আর উইপোকা কামড়ে কামড়ে খেয়ে ফেলে বাচ্চাটাকে। অবশ্য ওরা বাচ্চাকে রেখে যখন মদ খেয়ে উৎসবে মত্ত হয়, তখন অনেক বাচ্চাকে মিশনারির কাজা বাম্বারা সেফ সেন্টারে নিয়ে আসা হয়। ওরা জানতে পারলে খবর আছে। বিধাতার বিরুদ্ধাচরণ করার অপরাধে মৃত্যু নিশ্চিত। গাবুর কাজা বাম্বারা সেফ সেন্টারে এমন প্রায় ৩০ বাচ্চা আছে এখন।
গাবুর অধিবাসীরা মূলত জাতিতে ফুলা, ওদের ভাষাও ফুলা। আফ্রিকার এই জায়গাটা কুসংস্কারাচ্ছন্ন। মানুষদের গায়ে গন্ধ, এলাকায় বিদ্যুৎ নেই, পানির সংকট। সাপের আধিক্য খুব, রাতে একটু আলো কমে গেলে হাতে তালি দিতে দিতে রাস্তায় যেতে হয়, যাতে সাপ দূরে থাকে।
গ্রামের বাড়িগুলোতে দুটি করে ঘর। ভেতরে অন্ধকার মাটির ঘর। একটা ঘরে মশারি টানানো, যেখানে বাড়ির পুরুষ মানুষটা থাকে। সে কোনো কাজ করে না। মাটির ঘরের দাওয়ায় বসে বসে মদ খায়। তার সঙ্গে নতুন বউ থাকে মশারির নিচে। সবারই ছয় থেকে সাতটা বউ। পুরনো বউরা অন্য ঘরটাতে থাকে। তারা সারিবদ্ধভাবে ঘুমায়। নতুন বউ গর্ভবতী হলে আরও একটা বিয়ে করে বাড়ির কর্তা।
নতুন বউ ছাড়া অন্য কোনো বউ কোনোভাবে গর্ভবতী হলে ধরে নেওয়া হয় ওটা শয়তানের সন্তান, তার মৃত্যু অনিবার্য। ওদের আচার দেখে তাজ্জব হতে হয়। বাচ্চা জন্মালে কেউ খবরও নেয় না। কেউ মরলে উৎসব থাকে কমপক্ষে সাত দিন পর্যন্ত। ওদের ঘরে খাবার নেই, কিন্তু সবার বাড়িতে একটা গরু, ছাগল অথবা শূকর থাকবেই। যেটা মৃত্যু উৎসবের জন্য রেখে দেওয়া হয়। অনেক বাকাদো বা রাখাল শিশু গরু চরাবে, কিন্তু স্কুলে যাবে না। তারা বলে, বাবা মারা গেলে খাওয়াব কী, পশুটাকে যদি বড় না করতে পারি। কেউ মারা গেলে লাশ কাপড়ে মুড়িয়ে চারদিকে গোল হয়ে বসে সবাই। প্রথমে বসে নিকটাত্মীয় পরে সম্পর্কের দূরত্ব অনুযায়ী বসতে থাকে বাকিরা। আশপাশের ১০ গ্রামের মানুষ যোগ দেয় উৎসবে। কখনও কখনও এই আয়োজন সপ্তাহব্যাপী চলে। ৪০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় মৃতের শরীরে পচন ধরে। উৎসবে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে কলেরার মহামারী দেখা দেয়। অনেক সময় লাইন দিয়ে মানুষ মারা যায় সেই মহামারীতে। কোনো কোনো বৃদ্ধের মৃত্যুতে ৪০টি পর্যন্ত পশু জবাই হয়। সঙ্গে তালের মদ ও বিয়ার। ঘরে খাবার নেই, কিন্তু কেউ মরলে পশু-মদ কোনোটার কমতি হয় না ওদের।
কেউ মারা গেলে অনেক সময় তার সঙ্গে অন্যদের পোড়ানোর প্রচলন আছে ওদের সমাজে। কেউ মারা গেলে বিজয় গস্ট নামে একটা জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয় পোড়ানোর জন্য। সমাজের জাম্বাকো বা মাতবর কাউকে লক্ষ্য করে তারপর লতায়-পাতায় কারণ দেখিয়ে তাকে পোড়ানো হয় মৃতের সঙ্গে। আবার কখনও সাপ দিয়ে মারা হয়। সে আরেক কাহিনী।
লতার মুখে শুনি আফ্রিকার আরও কিছু অজানা কথা। ওখানে পলিগামি বলে একটা জাতি আছে। ওদের সমাজে তো একটা ওয়াইনের বোতল মেয়ের বাবার হাতে ধরিয়ে দিয়ে ছয় থেকে সাত বছরের মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে যায়। অনেক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে এখন সরকারি নিষেধাজ্ঞা জারি হলেও ওরা মানে না।
লতা বলেন, ওদের আরেকটা জাতির নাম বালান্তা, যাদের আচার আরও অদ্ভুত। ওদের রাজা নির্বাচন করার পদ্ধতি হলো, একটা গরু বা খাসি ঠিক করা হয়। তার পরে সেটা যে চুরি করতে পারে সেই রাজা। তবে চুরি করতে গিয়ে ধরা খেলে তার পরিণতি নিশ্চিত মৃত্যু। গিনিয়া বিসাউয়া প্রথম যাওয়ার পর দিন আমার হাতের ওপরই সাত-আটজন বাচ্চা মারা গেছে। এমন অসহায়ভাবে বাচ্চারা মরে যাচ্ছে দেখে কেঁদেছি খুব। সেই অবস্থা থেকে অনেকখানি উত্তরণ ঘটেছে। এখন আমার হাতে কোনো বাচ্চা মরে না। একটা জরাজীর্ণ বাচ্চাকে তিন দিনে সারিয়ে তুলতে পারি। এখন আমি ওদের খুব প্রিয়। ওরা আমার জন্য পেঁপে, কলা নিয়ে আসে। ওরা বেশিরভাগই এইচআইভিতে আক্রান্ত। এমনকি শিশুরাও। ভয়ে থাকতাম প্রথমদিকে, সাবধানতা অবলম্বন করতাম। সাবধানতার মধ্যেও একবার তো আমার ম্যালেরিয়া হয়ে গেল। পরে পেনিসিলিন নিয়ে ম্যালেরিয়া সারিয়েছি। ওখানে এখনও অ্যান্টিবায়োটিক মানে পেনিসিলিন।
২০০৭ সালে গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ থেকে ফুড অ্যান্ড নিউট্রিশনে মাস্টার্স শেষ করে ইতালির রোমাত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফাও-এর স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে যান রেবেকা। ওখান থেকে এসে মিয়ানমারের চ্যারিটিতে কাজ করেন কিছুদিন। সেটা ছিল ২০১১ সাল। মিয়ানমারের সিস্টার আর ব্রাদাররা তো মানতেই পারছিল না_ বাংলাদেশের কেউ তাদের দেশে চ্যারিটি কাজ করবে, তাও আবার মুসলিম। মিয়ানমারের আগে শিক্ষানবিশ কাজ করেছেন গিনিয়া বিসাউয়াতে। সে অর্থে মিয়ানমার অনেক উন্নত। গিনিয়াতে বিদ্যুৎ নেই, পানি সংকট। তারপরও শেষ পর্যন্ত রেবেকা গিনিয়াতেই কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন। ২০১৩ সালে স্থায়ীভাবে গিনিয়া বিসাউয়াতে পাড়ি জমান। অনেক ভাষার মানুষ আছে গিনিয়াতে, কাজ করতে হলে ভাষা জানাটা জরুরি। কারণ ওরা মোটেও ইংরেজি জানে না। বাধ্য হয়ে রেবেকাই ভাষা শেখা শুরু করেন। ২০১৪ সালে ব্রাজিলও যান পর্তুগিজ ভাষা শিখতে। গিনিয়াতে শেখেন ক্রিয়োলো ভাষা। এখন প্রায় সব জাতির সঙ্গে কথা চালিয়ে যেতে পারেন। গিনিয়া বিসাউয়াতে থাকতেই পছন্দ করেন তিনি।
ঢাকার বাসিন্দা রেবেকার বাবা আবদুল লতিফ ব্যবসায়ী। মা মরিয়ম বেগম গৃহিণী। দুই ভাই, এক বোনের মধ্যে সবার বড়। আগে থেকেই রক্তে ছিল সেবার মনোভাব। তিনি এ বিষয়ে স্মরণ করেন ইতালির নাগরিক ব্রাদার লোসিওর কথা। যার কাছে ভালোবাসা আবিষ্কার করতে শিখেছেন রেবেকা। এক সময় ব্রাদার লোসিওর সঙ্গে ঢাকার পথশিশুদের নিয়ে কাজ করতেন।
অনেক আত্মীয় মনে করেন রেবেকার অনেক টাকা-পয়সা। বলে, তুমি বিদেশে চাকরি কর, তোমার তো টাকার শেষ নেই। রেবেকা হেসে বলেন, আমার সঙ্গে পড়াশোনা করা বন্ধুরা চাকরি করে যা বেতন পায়, আমি তার আট ভাগের এক ভাগ পাই। আমি যা পাই এটা বেতন নয়। স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করে কেবল হাত খরচ পাই। এ নিয়ে ভাবিও না। মানুষের পাশে দাঁড়াতেই আমার ভালো লাগে।