স্থানীয় সফটওয়ার শিল্প উন্নয়নে কাজ করতে চান ফারহানা রহমান
- রবিউল কমল
সফটওয়্যার খাতে নিজস্ব মেধাকে কাজে লাগানোর মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখার উদ্দেশ্যে ২০০৩ সালে ফারহানা এ রহমান নিজ উদ্যোগে গড়ে তোলেন ইউওয়াই সফটওয়্যার কম্পানী। সে সময় সফটওয়্যারে নারী উদ্যোক্তা ছিল যথসামান্য। সন্তানের দেখাশুনা আর এমন এক চ্যালেঞ্জিং পেশায় সকল বৈরীতাকে হার মানিয়ে সামনে এগিয়েছেন। মূলত: সফটওয়্যার ডেভেলপ, আউটর্সোসিং ওয়েব সহ বিভিন্ন কাজে তার প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে দেশে বিদেশে তার প্রতিষ্ঠানসহ বাংলাদেশের অবস্থানকে সুদৃঢ় করেছে।
মাত্র একজন কর্মী দিয়ে নিজের বাসার ড্রয়িংরুমে যাত্রা শুরু করা ইউওয়াই সিস্টেমস এখন একশর বেশি মানুষের পরিবার। তবে শুরুটা মোটেই সহজ ছিলনা বলে জানালেন ফরহানা রহমান। তিনি বলেন, ‘আউটসোর্সিংয়ের কাজ শুরু করি ২০০৩ সাল থেকে। তখন ছোট ছোট কাজ করতাম। নিজের দক্ষতা ও সক্ষমতা বোঝার জন্য বিদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আউটসোর্সিংয়ের কাজ শুরু করি। শুরুতে অফিসটা আমার বাসায় ছিল। তখন আউটসোর্সিংয়ে ভারত খুব ভালো করা শুরু করে। ভারতের কয়েকজন বন্ধুর কাছ থেকে এই ব্যবসাটা সম্পর্কে জানি। তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে অনেক কিছুকরা যায় এবং অনেক দুর এগুনো যায়-এই গল্পগুলো শুনতাম। পরে গ্রাফিক্স এবং ওয়েব ডেভেলপমেন্টের ওপর কিছু প্রশিক্ষণ নিয়ে এই ব্যবসায় নামি। এরপর ২০০৫ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে অফিস নিয়ে ব্যবসা শুরু করি। একটা কাজের কত মূল্য নির্ধারন করলে আরো কাজ পাওয়া যাবে এসবই করে করে শিখতে হয়েছে। শুরুতে একটি আমেরিকান প্রতিষ্ঠানের কাজ পাই। এরপর আস্তে আস্তে কাজের পরিমাণ বাড়তে থাকে এবং প্রতিষ্ঠানের কলেবরও বৃদ্ধি পায়।
ইউওয়াই সিস্টেমস লিমিটেড এরই মধ্যে গুণগতমানের স্বীকৃতি হিসেবে অর্জন করেছে আইএসও ৯০০১-২০০৮ সনদ।’ এই নারী উদ্যোক্তা বলেন, ‘এই সময় থেকে আমি ওয়েব নির্ভর সেবা নিয়ে ইউরোপিয়ান মার্কেটে কাজ করছি। এছাড়া আমরা সফটওয়ার ডেভেলপমেন্টেও কাজ করি। সফটওয়্যার রপ্তানী বা আউটসোর্সিংয়ের পরিবর্তীত প্রেক্ষাপটে নিজের সাম্প্রতিক কাজ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এখন রেসপন্সিভ ওয়েবের জনপ্রিয়তা দেখা যাচ্ছে। বিশ্বজুড়ে সবকিছু এখন মোবাইলকেন্দ্রিক করার চেষ্টা চলছে। বিদেশে আমরা সাড়ে তিন হাজার ই-কমার্স ওয়েবসাইট করে দিয়েছি। এছাড়া ইউরোপের ৭ হাজার ওয়েবসাইটকে আমরা রেসপন্সিভ করেছি।’
ভ্যাট ব্যবস্থাপনা সফটওয়ারে বাংলাদেশে পথপ্রদর্শক ফারহানা রহমানের প্রতিষ্ঠান। তিনি বলেন, ‘ভ্যাট দিয়ে থাকে ক্রেতা বা সেবা গ্রহিতা। যে কোন প্রতিষ্ঠানের এই ভ্যাট ব্যবস্থাপনায় একজন অপারেটরের কিংবা পরামর্শক রাখতে হয়। সফটওয়ারের মাধ্যমে যে কোন প্রতিষ্ঠানই বাড়তি জনবল ছাড়াই সহজেই তার ভ্যাট ব্যবস্থাপা করতে পারে। আমাদের ইউওয়াই ভিএমএস (ভ্যাট ম্যানেজমেন্ট সফটওয়ার) দেশের ছোট, বড় কম্পানি, বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করে থাকে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ভ্যাটের আওতায় আনার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে তারা সফটওয়ার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করেছিল। যে পাঁচটি কম্পানির সফটওয়ার এনবিআরের তালিকাভূক্ত তার মধ্যে অন্যতম ইউওয়াইভিএমএস। ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন হলে এসব সফটওয়ার ব্যবহার বাড়বে।
হেলথ প্রায়োর নামে একটি পোর্টালের কর্ণধার বেসিসের এই সাবেক সহসভাপতি। তিনি বলেন, ‘এখনো এই সেবার বাজার চাহিদা দেখছি। কিন্তু কিছু নীতিগত সমস্যা রয়েছে। এই পোর্টালের মাধ্যমে আমাদের দেশের রোগিরা ডাক্তারদের সাথে যোগাযোগ করতে পারে। বিভিন্ন সমস্যার চিকিৎসায় কোথায় সুচিকিৎসা আছে সে সম্পকেও সহায়ক আমাদের ওয়েবসাইট।’আউটসোর্সিংয়ে বাংলাদেশের ব্যাপক সম্ভাবনা থাকলেও এ খাতে বাংলাদেশ এখনো পিছিয়ে। এর কারণ জানতে চাইলে ফারহানা রহমান বলেন, ‘এক্ষেত্রে আমাদের সবচেয়ে বড় বাধা আমাদের মানসম্মত দক্ষ জনবল নেই।
প্রশিক্ষণের জন্য আন্তর্জাতিকমানের স্বীকৃত কোন ইনস্টিটিউট নেই। বিশ্বের বড় কোন প্রতিষ্ঠান বড় কাজের প্রতিশ্রুতি দিলেও আমরা তা করতে পারছি না। সাত হাজার ওয়েবসাইট করতে আমার নিজের প্রতিষ্ঠানেই একটি ট্রেনিং সেন্টার খুলে ফেলতে হয়েছে। কারণ একই কোয়ালিটির মানুষ বাজারে নেই। অথচ ফিলিপাইনে একটি কম্পনিতেই হাজার হাজার দক্ষ মানুষ নিয়ে পরিচালিত হচ্ছে। তাদের ইনস্টিটিউট থেকে যে জনবল বের হচ্ছে তাদের দক্ষতা প্রায় সমপর্যায়ের। তাদেরকে নিয়ে এসে কাজে বসিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু আমাদের এখানে তা কল্পনাও করা যায় না।’
ব্যবসায়িক কর্মকান্ডের পাশাপাশি দেশের সফটওয়্যার শিল্প ব্যবসার উন্নয়নে যোগ দিয়েছেন বেসিসে। ২০১০ সালে বেসিসের প্রথম নারী পরিচালক হিসাবে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন ফারহানা। আগামী ২৫ জুন অনুষ্ঠিতব্য বেসিস নির্বাচনে পরিচালক হিসেবে প্রতিদ্বদ্বিতা করছেন তিনি। বেসিস নিয়ে নিজের পরিকল্পনার কথা উল্লেখ কওে ফারহানা রহমান বলেন, ‘আমি যেহেতু গত ১০ বছর ধরে আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িত। বেসিসের ইন্টারন্যাশনাল মার্কেট বিষয়ক কমিটিতে দীর্ঘদিন কাজ করেছি। এজন্য আমাদের দেশের ছোট ছোট কম্পনিগুলো আন্তর্জাতিক বাজারে উপস্থাপন করবে, কিভাবে দক্ষ মানব সম্পদ তৈরী ও ব্র্যান্ডিং করবে সে বিষয়ে আমি বেসিসেকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করতে চাই। স্থানীয় বাজারেও অনেক কাজের জায়গা আছে। কোন কোন অ্যাকাউন্টিং কিংবা ইআরপি সফটওয়ার প্রয়োজন হলে কোন কম্পানি কোথায় পাবে তা অনেকেই জানেন না। বেসিসের ওয়েবসাইটেও কে কি করে সেই ক্যাটাগরি অনুযায়ি পাওয়া যায় না। স্থানীয় বাজারের জন্য সেই সংযোগ তৈরী করতে চাই।’
তথ্যপ্রযুক্তিতে নারীদের আগ্রহী করা সেই সাথে সহযোগিতার মানসে ফারহানা যোগ দেন বাংলাদেশ ইউম্যান ইন আইটি বা বিডব্লিউ আইটিতে। সহ সভাপতি হিসাবে কাজ করছেন প্রযুক্তিখাতে নারী উন্নয়নে। এছাড়াও সামাজিক দায়িত্ব পালনে সাধারণ সম্পাদক যুক্ত আছেন অটিজম শিশু কল্যাণ সমিতির সঙ্গে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘নারীদের তথ্যপ্রযুক্তি সেবায় নিয়ে আসতে সাপোর্ট সার্ভিস তৈরী করার ইচ্ছা আছে আমরা। বেসিসের ইউম্যান ফেরামকে শক্তিশালি করা আমরা লক্ষ্য। অর্টিজমের ক্ষেত্রে প্রযুক্তি কম্পানিগুলো কিভাবে কাজ করতে পারে সে বিষয়েও আমি কিছু করতে চাই।