প্রান্তিক মানুষের বন্ধু রুনা খান
- লিডারশিপ ডেস্ক
মানুষ নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে তার জীবনে। সেগুলো সে কীভাবে কাজে লাগাবে, তা নির্ভর করে সেই ব্যক্তির ওপরই। সৌভাগ্যবশত সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম নেয়ায় নিজের জীবনে সুযোগ-সুবিধার কমতি ছিল না রুনা খানের। যা নিজের জীবনে পেয়েছেন, তা দিয়েই সমাজ ও দেশের জন্য কিছু করে যেতে চান, এমন উপলব্ধি মনে আসার পর পরই পথচলার দিক নির্ণয় করে ফেলেন রুনা। কারণ সবাই তো এই একই মাটির মানুষ। মাটির নির্যাসটাও সবার জন্যই এক।
বগুড়ার বিখ্যাত জমিদার পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন রুনা খান। জন্ম ঢাকায়। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা শুরু ব্রিটিশ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে। সেখান থেকে দেশ ঘুরে পাকিস্তান ও ভারতে দুটি স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন। ভারতে শেষ করেন স্কুলজীবন। এর পর কলকাতার বিখ্যাত লেডি ব্রোবর্ন কলেজ থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন। বিএ ডিগ্রি গ্রহণের পর পরই প্রথমবার গাঁটছড়া বাঁধেন তিনি। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাঠ সেখানেই শেষ করেন রুনা খান। তবে স্বপ্নের পথ ধরে চলাটা তখনো বাকিই ছিল। সেটি তিনি চালিয়ে গেছেন পরবর্তী জীবনে।
রুনা খানের প্রতিদিন এগিয়ে চলার যে উদ্যম, তা যেন ঝলকে ওঠে তার কথাবার্তায়। জানা যায়, এ স্বতঃস্ফূর্ততা তার ছোটবেলা থেকেই। রুনা খান মনে করেন, একটা মানুষ শেষ পর্যন্ত জীবনে কী করবে বা কতটা পথ হেঁটে যাবে, তা অনেকটাই ঠিক করে দেয় তার ছোটবেলা। তেমনই এ সময় মনের ভেতর যে আকাঙ্ক্ষা আর বাসনাকে পুষতেন তিনি, সেটিরই প্রতিফলন ঘটিয়েছেন নিজের জীবনে। ছোটবেলা থেকেই যেকোনো ঘটনা তীব্রভাবে প্রভাব ফেলত রুনা খানের মনে। বন্ধুদের নিয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে গিয়ে যদি কখনো চোখে পড়ত হতদরিদ্র মানুষের অসহায়ত্ব, দেখা যেত সেটি গাঢ় প্রভাব ফেলত তার মাঝে।
সে অনুভব থেকে ছোটবেলায় নিজের বাবার কাছে একটি চিঠি লেখেন রুনা। জানতে চেয়েছিলেন, কেন এ উপলব্ধিগুলো তার ওপর এত তীব্র হয়ে আঘাত হানে। উত্তরে তার বাবা বলেছিলেন, ‘হীরা আর কয়লা দুটোই কার্বন দিয়ে তৈরি। যখন একটা কয়লাই অনেক বছর ধরে অনেক তীব্র দহনের ভেতর দিয়ে যায়, সেটিই শেষ পর্যন্ত হীরকে পরিণত হয়।’ এমনটাই যেন ঘটেছে রুনা খানের সঙ্গে। তার উপলব্ধির তীব্রতা থেকেই আজ এগিয়ে যাচ্ছে ফ্রেন্ডশিপ নামের প্রতিষ্ঠানটি।
পরিবার থেকে কাজের ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা যেমন পেয়েছেন, জটিলতা যে একেবারে তৈরি হয়নি তেমনও নয়। অনেকেই ভাবতেন, একা একজন নারী খুব বেশি দূর এগোতেই পারবে না। নানাভাবে নানা জন পেছন থেকে আটকে ধরতে চেয়েছে রুনা খানের উদ্যোগকে। কাজ করতে গিয়ে দেখেছেন অনেকেই তাকে গুরুত্বই দিতে চাননি। কিন্তু আত্মমর্যাদার সঙ্গে কোনো দিনই আপস করেননি রুনা খান। বিশেষ করে যে নারীরা এ সমাজে একাই কিছু করে দেখাতে চান, তাদের জন্য তিনি বলেন, নিজের দূরদর্শিতা ও নৈতিকতা দিয়ে লক্ষ্যকে মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে এগিয়ে গেলেই সহজ হবে পথচলাটা। রুনা খান বলেন, ‘এ পৃথিবীতে লক্ষ্য হারিয়ে ফেলাটা অনেক সহজ। তাই নিজের লক্ষ্যে স্থির থাকতে মূল্যবোধটা ঠিক রাখা গুরুত্বপূর্ণ। আত্মমর্যাদাও গুরুত্বপূর্ণ। যদি তুমি নিজেকে একজন মর্যাদাপূর্ণ মানুষ হিসেবে না দেখো, অন্য লোকেরা তোমায় কখনই মর্যাদা দেবে না।’
প্রান্তিক শ্রেণীর মানুষকে নিয়ে কাজ করতে গিয়ে নানা ধরনের মানুষের দেখা পেয়েছেন তিনি। এর মাঝেই এমন কিছু নারীর জীবনকে কাছ থেকে দেখেছেন, যারা তাকে নতুন করে শিখিয়েছে শক্তি আর দৃঢ়তার রূপ। যেমন, বার্জার সিনড্রোমে আক্রান্ত শয্যাশায়ী স্বামী ও দুই সন্তানের মাকে দেখেছেন নৌকায় চড়ে, হেঁটে আর বাসে করে শহরে গিয়ে ভিক্ষা করে খাবার আর তেল কিনে ঘরে ফিরতে। দেখেছেন স্বামীর মৃত্যুর পর তার নেয়া ধার শোধ করতে এক নারী একা লাঙল চালিয়েছেন জমি চাষ করতে। এমন মাকেও দেখেছেন তিনি, যারা নিজের সন্তানের চিকিত্সা ব্যয় বহন করতে নিজেকে পর্যন্ত বিক্রি করে দিচ্ছে।
কাজ করেন যাদের নিয়ে, তাদের জায়গা থেকেই যেমন দেখেছেন নারীদের, সেখান থেকে প্রশ্ন করেন রুনা, ‘নারীদের দুর্বলতাটা তাহলে কোথায়?’। যারা ভাবেন নারীরা দুর্বল, তাদের উদ্দেশে রুনা খান বলেন, ‘বলতে হয়, এটা মস্তিষ্কে। কার্যত এমন কিছুই নেই।’