তরুণ উদ্যোক্তাদের আদর্শ মঞ্জুর এলাহী
- মো. আবু তাহের
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উন্মত্ততা-পীড়িত এক করুণ আবহের মধ্যেই সৈয়দ মঞ্জুর এলাহীর জন্ম ১৯৪২ সালে কলকাতায়। তাঁর সমকাল বুঝতে জানাই, একই বছরে জন্ম নেওয়া বড় মাপের মানুষদের মধ্যে আছেন পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং, কিংবদন্তীতুল্য মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাস উদ্দিন প্রমুখ। অন্যদিকে তাঁর পরিবারকে বোঝার জন্য জানাই, তাঁর পিতা সৈয়দ নাসিম আলী ছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি, আর মা ছিলেন বিদুষী শরিফা আলী।
প্রাথমিক থেকে স্নাতক পর্যায় পর্যন্ত ছাত্র ছিলেন ১৮৬০ সালে প্রতিষ্ঠিত উপমহাদেশের অন্যতম সেরা প্রতিষ্ঠান সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। সেখান থেকেই ১৯৬২ সালে ডিস্টিংশনসহ বিএ ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে একই বছরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ১৯৬৪ সালে অর্থনীতিতে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন।
পরিবারের মধ্যে শিক্ষকতা, আইন পেশা, সরকারি চাকরি বা ধ্রুপদী সংস্কৃতিচর্চার আবহ থাকলেও শিল্পোদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ী হয়ে ওঠার মতো আদৌ কোনো পরিবেশই সেখানে ছিল না। ফলে এ ব্যাপারে সরব বা নীরব কোনো সমর্থন থাকার তো প্রশ্নই ওঠে না। এমন পরিবেশের মধ্যে এমএ পরীক্ষা দিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে সকাল সন্ধ্যার আড্ডায় আর স্বজনরে সঙ্গে একান্ত আলোচনায় কর্মজীবনের সম্ভাব্য পেশা হিসেবে সিভিল সার্ভিসকে বেছে নেওয়ার তাগাদা ও পরমর্শই ছিল সর্বাধিক। ফলে স্বতস্ফূর্ত আগ্রহ থেকে না হলেও চারদিকের প্রভাবে সৈয়দ মঞ্জুর এলাহীও সেভাবেই প্রস্তুত হচ্ছিলেন, যেমনটি হচ্ছিলেন তাঁর এসএম হলের অন্যান্য মেধাবী বন্ধুরাও। হবেনই বা না কেন। সিএসবি অফিসার হিসেবে যোগদানের শুরুতেই চার শ টাকা বেতন, আর ক্ষমতা ও সৌর্য-বীর্য তো রয়েছেই।
এমন অবস্থায় এ ইচ্ছার পথে হঠাৎ বাধ সাধলেন তাঁরই এক মুরুব্বি স্থানীয় ব্যাক্তি। মোটা বেতনকে তুচ্ছ বানিয়ে তিনি বললেন, চার শ টাকার এ ছাপোষা চাকরি দিয়ে কী হবে? তারচেয়ে বরং বহুজাতিক কোম্পানির মোটা বেতনের চাকরির জন্য চেষ্টা করো এবং এর চেয়ে ঢের বেশি আরাম আয়েশে থাকবে। তিনিই সব পথ বাতলে দিলেন। চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানের ব্যায়ে বিমানে চড়ে ঢাকা থেকে করাচি গেলেন ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানির সিনিয়র ম্যানেজার পদে চাকরির সাক্ষাৎকার দিতে। নানা প্রশ্নের ইতিবাচক মিমাংসার পর শেষ পর্যায়ে সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীরা জিজ্ঞেস করলেন বেতন কত চান? তেইশ বছরের যুবক মঞ্জুর এলাহী সিভিল সার্ভিসে প্রবেশ পদের আকর্ষণীয় চার শ টাকা বেতন দ্বিগুণ করে তার সাথে আরও এক শ টাকা যোগ করে সাহস করে চাইলেন ৯০০ টাকা। শুনে সাক্ষাৎকার বো্র্ডের সবাই একযোগে হেসে উঠলেন। কিছুটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য দু দফায় কমিয়ে শেষ পর্যন্ত বললেন, ৬০০ টাকা হলেও তিনি রাজি আছেন। বোর্ড প্রধান গম্ভীর হয়ে বললেন, এ পরিমাণ টাকা তো দেওয়ায় যায়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এ পদের সর্বনিম্ন বেতন এক হাজার ৮০০ টাকা।
শেষ পর্যন্ত মাসিক ১৮০০ টাকা বেতন আর তার সাথে এর চেয়েও বেশি অঙ্কের প্রান্তিক সুবিধার অফার নিয়ে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানির চাকরিতে যোগদান করলেন। তবে শর্ত : দুই বছরের মধ্যে বিয়ে করতে পারবেন না। আর এ দুই বছরের মধ্যে এক বছর কাটাকে হবে তাদের লিভারপুলের অফিসে। শর্ত মেনেই চাকরি শুরু। কিন্তু দেড় বছর যেতে না যেতেই পরিবার থেকে জোর তাগিদ। অগত্যা কোম্পানির অনুমতি নিয়ে পৌণে দুই বছরের মাথায় বিয়ে। এবং সেখানেই আরও পাঁচ বছর ধরে চাকরি।
কিন্তু সেন্ট জেভিয়ার্সের জীবনে পাঠ্য পুস্তকের বাইরে যে বই তাকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ ও আকৃষ্ট করেছিল এবং করাচি বা লিভারপুলে বসেও যে বই তিনি বারবার পড়েছেন সে বইয়ের নায়ককে তিনি এত সহজে ভুলে যাবেন কেমন করে? না, তিনি তাকে ভুলতে তো পারেনইনি, জীবন থেকেও তাকে ছাড়াতে পারেননি।বরং তাকেই পেশাগত জীবনের আদর্শ হিসেবে বেছে নিয়েছেন। আর সৈয়দ মঞ্জুর এলাহীর জীবনের এই খ্যাতিমান আদর্শ ব্যাক্তিত্ব হচ্ছেন জমশেদজি নুসেরওয়ানজি টাটা। বস্তুত এই জমশেদজি টাটাই তাকে বহুজাতিক কোম্পানির মোটা বেতনের চাকরিকে পেছনে ফেলে আরও অনেক দূর এগিয়ে যাওয়ার হাতছানি দিয়ে ডাকলেন।১৯৭২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি নিজের ৩০তম জন্মদিনে ব্রিটিশ আমেরিকান ট্যোব্যাকোর চাকরি ছেড়ে নিজেকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলার প্রত্যয়ে যাত্রা শুরু করলেন।আর সেই থেকে দীর্ঘ ৪৪ বছরের পথ পরিক্রমায় আজ তিনি দেশের অন্যতম শীর্ষ শিল্প ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান গোষ্ঠী অ্যাপেক্স গ্রুপের সফল কর্ণধার, যার আওতাধীন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা এখন সাত।
অ্যাপেক্স গ্রুপের সুনাম ও সাফল্যের কথা এখন দেশের পরিধি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরেও বিস্তৃত। এ অর্জনের পেছনের রহস্য সৈয়দ মঞ্জুর এলাহীর ভাষায় মূলত তিনটি : ১. কারখানা বা প্রতিষ্ঠানের ভেতরের কর্মীদের সঙ্গে হৃদ্যতাপূর্ণ ও আনন্দদায়ক সম্পর্ক গড়ে তোলা, ২. কারখানা বা প্রতিষ্ঠানের বাইরে ঋণদানকারী ব্যাংক ও অন্যান্য সহায়ক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ ও লেনদেনের নিয়ম কানুন, ওয়াদা, সততা ও স্বচ্ছতা রক্ষা করে চলা এবং ৩. রফতানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ক্রেতা ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের শর্ত যথাযথভাবে মেনে চলা। শ্রমিক ঠকানো, ব্যাংকের ঋণ খেলাপ আর আন্তর্জাতিক ক্রেতার শর্ত পূরণে গড়িমসি-এসবের বিপরীতে দাঁড়াবার শক্তিই বস্তুত আজ অ্যাপেক্স তথা মঞ্জুর এলাহীকে এতদূর নিয়ে গেছে। প্রসঙ্গত: বলি, পিএইচপি পরিবারের ক্ষেত্রেও আমরা এই জিনিস লক্ষ্য করেছি। বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের উদ্যোক্তারা তাঁদের এই সংগ্রাম ও পথচলাকে নিজেদের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করতে পারেন বৈকি।
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী ১৯৯৬ ও ২০০২ সালে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রধান বিচারপতি বাবার আদর্শের প্রভাবের কারণেই হয়তো ন্যায়-নীতি ও বস্তুনিষ্ঠার গুণ তাঁর মধ্যেও প্রবলভাবেই রয়েছে, যে কারণে উভয় মেয়াদে উপদেষ্টা নির্বাচিত হওয়ার সময়ই তিনি দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের অকুণ্ঠ সমর্থন ও সহযোগিতা পেয়েছেন।
১৮৩৯ সালে জন্মগ্রহণকারী জমশেদজি টাটা প্রয়াত হয়েছেন ১৯০৪ সালে। তাঁর মৃত্যুর প্রায় ৭০ বছর পর তাকে না দেখেও তাকেই আদর্শ মেনে বহুজাতিক কোম্পানির মোটা অঙ্কের বেতনের চাকরি ছেড়ে উদ্যোক্তা হিসেবে যাত্রা করে শুধু শিল্প ও ব্যবসায় ক্ষেত্রেই নয়-সমগ্র বাংলাদেশেই তিনি একজন অনুকরণীয় ও শ্রদ্ধাভাজন ব্যাক্তি হয়েছেন। আর সে ক্ষেত্রে আমাদের নতুন প্রজন্মের তরুণরা যদি তাঁর মতো হতে চায় তাহলে নিশ্চয় সেটিকে নিছক আবেগ বলে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না।
২০১২ সালে তিনি বিশ্বখ্যাত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তব্য প্রদানের জন্য আমন্ত্রিত হন। সেখানে প্রদত্ত বক্তব্য উপস্থিত শ্রোতা দর্শকদের এতটাই মুগ্ধ করেছিল যে, বহুদিন পর্যন্ত সেখানে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁর নাম উচ্চারিত হয়েছে। উল্লেখ্য, হার্ভার্ডে এ ধরনের বক্তৃতার জন্য আমন্ত্রণ লাভের সুযোগ খুব বেশি সংখ্যক বাঙালির ভাগ্যে জোটেনি।
এছাড়া সৈয়দ মঞ্জুর এলাহীকে নিয়ে নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে বিখ্যাত মার্কিন সাময়ীকি ফোর্বসে। বিস্তারিত পড়ুন : http://goo.gl/pmMCUH
মঞ্জুর এলাহীর অজানা ৭
১. মাত্র চার বছর বয়সে তিনি বাবাকে হারান। এরপর বেড়ে ওঠেন বড় ভাইয়ের আশ্রয়-প্রশয়ে।
২. ১৯৭২ সালে রেমন্ড ক্লেরিক নামে এক ফরাসীর সঙ্গে দেখা হয় তাঁর। তিনি ফ্রান্স থেকে ট্যানারি কেমিক্যাল এনে ঢাকায় বিক্রি করতেন। এই ফরাসী ভদ্রলোকের কারণেই মঞ্জুর এলাহীর চামড়া শিল্পের ব্যবসায় জড়িয়ে পড়া।
৩. ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর চাকরি ছেড়ে চামড়ার ব্যবসায় জড়ানোর ইচ্ছা পোষণ করলে তাঁর স্ত্রী তাঁকে বাধা দেন। পরে শ্বশুরের সহযোগিতায় স্ত্রীকে বোঝোতে সক্ষম হন।
৪. ১৯৭৫ সালে তিনি ১২ লাখ ২২ হাজার টাকা দিয়ে ওরিয়েন্ট ট্যানারি কিনে নেন। আর এর মধ্য দিয়ে শুরু হয় তাঁর চামড়া শিল্পের ব্যবসায় পদযাত্রা।
৫. অ্যাপেক্স ট্যানারির যাত্রা শুরু হয় ১৯৭৬ সালের জানুয়ারিতে।
৬. ১৯৯০ সালে প্রথম অ্যাপেক্স সু বাজারে আসে।
৭. অ্যাপেক্স রিটেইল ব্যবসা শুরু করে ২০০০ সালে।