মাছ চাষ করে ভাগ্য পরিবর্তন
- এস এম রাসেল
যুগ যুগ ধরে আমাদের বলা হয় মাছে-ভাতে বাঙ্গালি।মাছ ছাড়া যেন আমাদের দুপুর ও রাতের খাবার চলেই না। কিন্তু এ মাছ চাষ কারা করছে ? কীভাবে মাছ আমাদের বাড়ির পাশের বাজারে আসছে? মাছ চাষ করে কীভাবে নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করেছে ; তা আজকে আপানদের শুনাবো।
স্বল্প সময়ে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে মাছ চাষে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছেন চাষীরা। ফলে কৃষির পরিবর্তে মাছ চাষে আগ্রহী হচ্ছেন তারা। ছোট ছোট পুকুর জলাশয়ে উন্নত জাতের মাছ চাষ করে স্বচ্ছল হয়েছেন অনেকেই।
রাজা নামে একজন মাছ ব্যবসায়ী
রাজা বলেন, প্রথমে পোল্ট্রি ফিডের ব্যবসা শুরু করি। কিন্তু লোকসান হওয়ায় হতাশ হয়ে পড়ি। এমন সময় ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মৎস্য ট্রেডে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে ২০১০ সালে নিজের একটি পুকুরে শুরু করি মাছ চাষ। পরবর্তীতে মৎস্য অধিদপ্তর এবং যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ, পরামর্শে তার মৎস্য চাষ সম্প্রসারণ করতে থাকেন। তারপর থেকে তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। একের পর এক সাফল্য হাতে এসে ধরা দিয়েছে। মৎস্যচাষি রাজা তিল তিল করে অতি যত্নে গড়ে তোলেন তাদের প্রতিষ্ঠান রাজা-বাদশা মৎস্য খামার। ঠাকুরগাঁও ছাড়াও পার্শবর্তী জেলা দিনাজপুর, পঞ্চগড় ও নীলফামারীর মৎস্যচাষিদের কাছে রাজা লাভ করেন ব্যাপক পরিচিতি। গড়ে তোলেন একটি হ্যাচারি। এই অত্যাধুনিক হ্যাচারিতে তিনি রুই, মৃগেল, কাতলা, সিলভার কার্প, ব্রিগেড, কমন কার্প, গ্রাস কার্প, কালবাউস, থাইপুঁটি ইত্যাদি মাছের ডিম এবং ডিম থেকে রেণু-পোনা উৎপন্ন করছেন। তিনি জানান, শিগগিরই হ্যাচারিতে দেশি ছোট মাছ যেমন: মলা, গোলসা, পাবদা, কই, শিং, মাগুর ইত্যাদি মাছের প্রজনন করার পরিকল্পনা রয়েছে। বর্তমানে প্রায় ১ হাজার কেজি রেণু-পোনা উৎপাদন হচ্ছে এই হ্যাচারি থেকে। ১ হাজার কেজি রেণু-পোনা সংখ্যায় প্রতি কেজি ৮ হাজার হিসাবে যার পরিমাণ কয়েক লাখ টাকা। বর্তমানে মাছ চাষের সমস্যার কথা বলতে গিয়ে এই সফল মাছচাষি জানালেন তার নানান অভিযোগ। প্রথমেই ব্যাংকঋণ না পাওয়ার কথা জানালেন তিনি। বললেন, নিজের টাকার সঙ্গে যদি ব্যাংক সহযোগিতা করতো তাহলে মাছ চাষকে শিল্প হিসেবে তিনি উন্নত করতে পারতেন।
মাছ চাষ করে কোটিপতি মিরসরাইয়ের কামরুল
২০০৩ সালে কথা। তখন তিনি লেখাপাড়ায় ব্যস্ত। তখনই মনস্থির করলেন পড়ালেখার পাশাপাশি কিছু একটা করতে হবে। তাই নিজেদের কিছু জমি বন্ধক দিয়ে বাড়ির কাছে একটি পুকুরে মাছচাষ শুরু করেন। সেই থেকে শুরু। আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। জমি বন্ধকের ৪০ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে শুরু হয় তার পথচলা। কঠোর পরিশ্রম আর একাগ্রতা তাকে নিয়ে গেছে উন্নতির শিখরে। চট্টগ্রামের মৎস্য জোন হিসেবে খ্যাত মুহুরী প্রকল্প এলাকায় এখন শত শত মাছচাষির মডেল কামরুল হোসেন প্রকাশ কামরুল হুজুর। আধুনিক পদ্ধতিতে মাছ চাষের জন্য তিনি উপজেলার মাছচাষিদের কাছে মডেল। অনেকে তাকে অনুসরণ করে চাষ করছেন। নিয়মিত তার কাছ থেকে পরামর্শ নেন চাষিরা।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, চোখের দৃষ্টি যতটুকু যায় শুধু প্রকল্প আর প্রকল্প। মুহুরী প্রজেক্ট এলাকায় অবস্থিত ‘ফারহা মৎস্য প্রকল্প’ নামে তার প্রকল্পে দেখভাল করছেন কামরুল। প্রকল্পে নিয়োজিত শ্রমিকদের (কর্মীদের) পরামর্শ দিচ্ছেন তিনি।
এ প্রতিবেদকের সাথে কথা হয় কামরুলের। কামরুল হোসেন বলেন, ২০০৩ সালে ছাত্র থাকা অবস্থায় আমাদের কিছু জায়গা বন্ধক দিয়ে ৪০ হাজার টাকা নেই। ৩০ হাজার টাকা দিয়ে পাঁচ বছরের জন্য একটি পুকুর ইজারা নেই। বারইয়ারহাটের একটি খাদ্যের দোকান থেকে বাকিতে খাদ্য নিয়ে মাছচাষ শুরু করি। প্রথম বছরে আড়াই লাখ টাকার মাছ বিক্রি করি। এর পর থেকে মাছ চাষের পরিধি বাড়াতে থাকি। বর্তমানে ৪০ একর জায়গায় আমার মৎস্য প্রকল্প রয়েছে। বর্তমানে আমার প্রকল্পে ১৫ জন কর্মচারী রয়েছেন। মাছচাষ আমার জীবনের একটি অংশ। নিজের কঠোর পরিশ্রম আর মানুষের দোয়ায় আমি সফল হয়েছি।
তিনি আরো বলেন, প্রতি তিন মাস পরপর প্রকল্প থেকে মাছ বিক্রি করি। চট্টগ্রাম শহর থেকে পাইকারি ব্যবসায়ীরা এসে প্রকল্পের পাড় থেকে মাছ কিনে নিয়ে যান। বছরে প্রতি একরে প্রায় আট লাখ টাকার মাছ বিক্রি করি। যার মধ্যে খরচ পড়ে পাঁচ লাখ টাকা। এই হিসাবে বছরে আমার প্রকল্প থেকে প্রায় চার কোটি টাকার মাছ বিক্রি করি। তাতে আমার দেড় কোটি টাকার মতো লাভ থাকে।
কামরুল বলেন, এখানে অন্য মাছচাষিরা প্রতি একর থেকে বছরে ১৫-১৬ লাখ টাকার মাছ বিক্রি করে থাকেন। আমি আধুনিক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করে প্রতি একর থেকে বছরে ২৫ লাখ টাকার মাছ বিক্রি করি। আমার কিছু কৌশল অবলম্বন করে মাছচাষ করি।
জানা গেছে, মাছ চাষ করে সাবলম্বী হয়েছেন কামরুল হোসেন। কোটি টাকা খরচ করে বাড়ি করেছেন, একটি মাছের খাদ্যের দোকান দিয়েছেন। এ ছাড়া উপজেলার বাণিজ্যিককেন্দ্র বারইয়ারহাটে একটি লাইভ মৎস্য আড়ত প্রতিষ্ঠা করেছেন। আড়তে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ জীবিত রাখা হবে। যেখান থেকে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মাছ সরবরাহ করা হবে। সফল মাছচাষি কামরুল হোসেন উপজেলার ৫ নম্বর ওছমানপুর ইউনিয়নের বাঁশখালী গ্রামের মৃত আব্দুল মান্নানের ছেলে।
ইবাক (ইছাখালী, বাঁশখালী ও কোম্পানীনগর) সমবায় সমিতির সভাপতি এম এইচ লাভলু চৌধুরী বলেন, মাছ চাষ করে কামরুল এখন জিরো থেকে হিরো। তিনি কৌশলে মাছচাষ করে অন্য চাষিদের চেয়ে বেশি উৎপাদন করেন। তিনি নিয়মিত মাছের পরিচর্জা করেন। পানি ও মাটির গুণ বুঝে যখন যা দরকার তা করেন।
উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ বলেন, কামরুল একজন সফল মাছচাষি। মুহুরী প্রজেক্ট এলাকায় শত শত মাছচাষিদের মধ্যে তিনি ব্যতিক্রম। মাছচাষে অনেক দক্ষ। মাছের গুণাগুণ বুঝে খাদ্য, ওষুধ দেন। এতে অন্যদের চেয়ে বেশি মাছ উৎপাদন করতে পারেন তিনি।
এরকম আরও অনেকেই মাছ চাষ করে নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করেছেন। আপনারাও চাইলে কামরুল ও রাজার মত মাছ চাষ করে ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারেন।
সুত্রঃ চ্যানেল২৪, বিভিন্ন ওয়েবসাইট