সিলিয়ার আকাশছোঁয়া স্বপ্ন

সিলিয়ার আকাশছোঁয়া স্বপ্ন

  • লিডারশিপ ডেস্ক

বিমানের ককপিটে বাঙালি এক মেয়ে। ঠিকানা যুক্তরাষ্ট্র। যোগাযোগ করা হলো তাঁর সঙ্গে। জানা গেল, ছোটবেলা থেকেই বৈমানিক হওয়ার স্বপ্ন দেখেছেন সিলিয়া সালাম। দশম শ্রেণিতে পড়ার সময়ই কাউকে না জানিয়ে চুপিচুপি যোগাযোগ করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের একটি ফ্লাইয়িং স্কুলের সঙ্গে। তারপর?


প্রশিক্ষণ বিমানটি উড়ে চলেছে আটলান্টিক সাগরের ওপর দিয়ে। সে বিমানের ককপিটে বসে সিলিয়া সালাম কি একবার চিমটি কাটলেন? কারণ, বিমান তো তিনি ভিকারুননিসা নূন স্কুলে পড়ার সময় রোজ চালাতেন! কিন্তু ভ্রম কাটতেই বিমানের ককপিটে নয়, নিজেকে আবিষ্কার করতেন বাসার ছাদে কিংবা পড়ার টেবিলে! ই-মেইল কথোপকথনে সিলিয়া সালাম বলেন, ‘সত্যিই সেদিনের পুরো ব্যাপারটা আমার কাছে স্বপ্নের মতো ছিল। বিমান থেকে নামার পর সবাই যখন বাহবা দিচ্ছিল, তখনো বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে এতক্ষণ বিমানটি আমার নিয়ন্ত্রণেই ছিল!’ বৈমানিক হওয়ার দুর্বার ইচ্ছাশক্তিই মাত্র ১৬ বছর বয়সে সিলিয়া সালামকে নিয়ে গিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রে। আর তা বেশি দিন আগের কথা নয়। ২০১১ সালে তখন সবে দশম শ্রেণিতে পড়তেন ভিকারুননিসা নূন স্কুলে। স্কুলের ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, কারাতে, বিতর্ক, ছবি আঁকা থেকে শুরু করে প্রথম আলো-এইচএসবিসি ভাষা প্রতিযোগের সেরা পদকে ভরা তাঁর ঘর।

কিন্তু লক্ষ্য তো আকাশে ওড়ার। সে সময় সিলিয়া খোঁজ পান যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ান ইয়াং ইগলস নামের একটি প্রতিষ্ঠানের। ভবিষ্যতে পাইলট হতে চায়, এমন শিশু-কিশোরদের বেসামরিক বিমান চালনার অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ করে দেয় সে প্রতিষ্ঠান। অনলাইনে খুব সহজেই তাদের কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন সিলিয়া। বলছিলেন, ‘অনলাইনে সমবয়সী আমেরিকানদের দেখতাম, ফড়িংয়ের মতো উড়ে বেড়াচ্ছে। আর আমার সমাজে “আমি পাইলট হতে চাই”, এ কথা যতবার বলেছি, একজন মেয়ে বলে সবাই খুব তাচ্ছিল্যের চোখে তাকিয়েছে। জেদ জমতে থাকল আর বুঝতে পারলাম, কম বয়সে ফ্লাইয়িং শুরু করা মানে হচ্ছে এই ক্যারিয়ারে এগিয়ে থাকা।’
তারপর আর দেরি কেন! বাসার কাউকে কিছু না বলে ফ্লাইয়িং স্কুলে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পাঠালেন সিলিয়া। অনলাইনে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সাক্ষাৎকারও নিল সে প্রতিষ্ঠান। এর কিছুদিন পর একদিন তাঁর বাসায় হইহই রইরই পড়ে গেল। সিলিয়া বলেন, ‘কারণ, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভিসা আবেদনের কাগজপত্র পাঠানো হয়েছে আর তা আব্বুর হাতে গিয়ে পড়ল। আব্বু-আম্মু চাইতেন পড়াশোনার জন্য দেশের বাইরে যাই, কিন্তু এসএসসি পাসের পর। আমিও জেদ করে খাওয়া-ঘুম ছেড়ে দিলাম। আব্বু-আম্মু আমার স্বপ্নের ওজনটা বুঝতে পেরে শেষ পর্যন্ত রাজি হলেন।’
প্রশিক্ষণ বিমানের ককপিটে সিলিয়াসিলিয়া পাড়ি জমালেন যুক্তরাষ্ট্রে। ভর্তি হলেন মেইনল্যান্ড হাই স্কুলে। পাশাপাশি চলল বিমান প্রশিক্ষণ। স্বপ্ন খানিকটা পূরণ হয় যুক্তরাষ্ট্রের ফিনিক্স ইস্ট এভিয়েশনে। এ প্রতিষ্ঠান থেকেই প্রথম বিমান চালানোর সুযোগ পান তিনি। এরপর জোটে ব্যক্তিগত বিমান চালনার সনদ। কিন্তু সিলিয়ার স্বপ্ন আরও বড়। সম্প্রতি অ্যারোনটিক্যাল সায়েন্স উইথ কমার্শিয়াল অ্যাভিয়েশন বিষয়ে স্নাতক পড়ার সুযোগ পেয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। তবে সিলিয়া বেছে নিয়েছেন ‘দ্য হার্ভার্ড অব স্কাই’ (আকাশের হার্ভার্ড) খ্যাত এমব্রি-রেডল অ্যারোনটিক্যাল ইউনিভার্সিটি। এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি প্রতি সেমিস্টারে চার হাজার ডলার বৃত্তি পাবেন।
স্নাতক শেষ হলে ফ্লাইট ইনস্ট্রাক্টর হিসেবে কাজ করার সুযোগ পাবেন দুই বছর। তারপর দেশে ফেরার ইচ্ছা সিলিয়ার। স্বপ্ন দেখেন দেশি এয়ারলাইনসের পাইলট হওয়ার। এ ছাড়া কাজ করতে চান দেশীয় পণ্য নিয়ে। তিনি বলেন, ‘আমি সব সময় ছুটি শেষে দেশ থেকে ফেরার সময় বন্ধু ও শিক্ষকদের জন্য বাঁশ-বেতের ঘর সাজানোর উপকরণ, নকশিকাঁথা, মাটির গয়না নিয়ে আসি। সবাই খুব প্রশংসা করে এসব পণ্যের। হারিয়ে যেতে বসা এমন সব কুটির শিল্প নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা আমার।’
সিলিয়া কিন্তু আরও একটি ইচ্ছার কথা বলছিলেন আলাপের একদম শুরুতে। ‘ছোটবেলা থেকেই প্রথম আলোর ভাষা প্রতিযোগসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিতাম। স্বপ্ন দেখতাম, একদিন আমাকে নিয়েও “স্বপ্ন নিয়ে”তে প্রতিবেদন লেখা হবে।’ এই ছোট ছোট স্বপ্ন পূরণ নিশ্চয়ই তাঁকে আরও বড় স্বপ্ন দেখতে সাহস জোগাবে।
ঢাকায় যোগাযোগ করা হলো সিলিয়ার পরিবারের সঙ্গে। প্রকৌশলী এস এম আবদুস সালাম ও ফেরদৌসী সালাম দম্পতির তিন সন্তানের মধ্যে সিলিয়া সবার বড়। ফেরদৌসী সালাম বলেন, ‘আমরা চেয়েছিলাম মেয়ে ডাক্তার হোক। কিন্তু ওর পাইলট হওয়ার স্বপ্নের কাছে সেদিন হার মেনেছি। অত ছোট বয়সে কোনো মা-বাবা তাঁর সন্তানকে একা একা দেশের বাইরে তো নয়ই, ঘরের বাইরেও ছাড়তে চায় না। আজ সে তাঁর স্বপ্ন পূরণের পথে অনেক দূর এগিয়েছে। এখন আমার সাহসী অলরাউন্ডার মেয়ের জন্য গর্ব হয়।’

সূত্র: প্রথম আলো

Sharing is caring!

Leave a Comment