গল্পের জনকের গল্প
- লিডারশিপ ডেস্ক
প্রথমেই বলে রাখি, আমি কিন্তু গল্পের জনক! কেন? সে গল্প আছে যথাস্থানে। আপাতত আমার গল্প বলি। যে রাতে আমার জন্ম হয়েছিল সে রাতে নাকি অনেক তুফান হয়েছিল। সারা রাতের ওই তুফানে ভাঙল বহু বাড়িঘর। সেই তুফানের রাতের পরদিন সকাল ছয়টার দিকে আমার আব্বা তাঁর দ্বিতীয় পুত্রপ্রাপ্তির সুখে ‘আল্লাহু আকবর’ বলে আজান দিলেন। কিন্তু তখন আশপাশে এমন কোনো জনমনিষ্যিও ছিল না, যিনি সে আজান শুনে আন্দাজ করবেন বাড়িতে কেন আজান দেওয়া হচ্ছে—পুত্রের জন্ম হওয়ার আনন্দে, নাকি দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার আর্তিতে। হ্যাঁ, ঝড়-তুফান মাথায় নিয়ে আমি জন্মেছিলাম।
তারপর শৈশবেই দেখলাম নানা রকম মানুষজন। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত এক দুর্গম গ্রামে আমার জন্ম। সুনামগঞ্জের ট্যাকেরঘাট নামের এ গ্রামটি চুনাপাথর খনির জন্য বিখ্যাত ছিল একসময়। আব্বা চাকরি করতেন ওখানে। বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গার লোকজনে পূর্ণ ছিল ছোট্ট ট্যাকেরঘাট। মনে পড়ে, খুব ছোটবেলায় গ্রাম থেকে সুনামগঞ্জ যাওয়ার আগের রাতে উত্তেজনায় ঘুম আসত না আমার। শহরে যেতে হলে পাড়ি দিতে হতো ২৪-২৫ কিলোমিটার পথ, ঘুম থেকে উঠতেও হতো তাই খুব ভোরে—ফজরের আজানের সঙ্গে সঙ্গে। এরপর খনি প্রকল্প কোম্পানির একমাত্র নৌকায় নদীপথে সুনামগঞ্জের উদ্দেশে যাত্রা। বর্ষার মৌসুম না হলে যাত্রাটা হতো অনেকটা নিরুদ্দেশের মতো। নানা শাখা-প্রশাখা পেরিয়ে যেতে হতো বলে এই ছোট পথটাও যেতে হতো ঘুরে ঘুরে। মাঝেমধ্যেই চরে আটকে যেত নৌকা। নৌকা চরে আটকে গেলে আমার কাছে খুব দুর্বিষহ মনে হতো। ইচ্ছে হতো উড়াল দিয়ে চলে যাই। আমার এ গল্পগুলো হয়তো ধান ভানতে শিবের গীত হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু যদি চলচ্চিত্রের সঙ্গে আমার সংশ্লিষ্টতার কাহিনি বলতে হয়, তবে লেজের সঙ্গে লেজ জোড়া দিয়ে এসবও আসবে। কেননা, সবকিছু নিয়েই তো আজকের আমি!
ছেলেবেলায় যখন ঘুরপথে যেতে হতো, নৌকা যখন আটকে যেত চরে, তখন মনে বাসা বাঁধত একটি বাসনা—বৈমানিক হব। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে বিজ্ঞান নিয়ে আমার পড়াশোনা সে কারণেই।
অন্যদিকে আর পাঁচজন মধ্যবিত্ত বাবা-মায়ের মতো আমার আব্বা-মায়ের কাছে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কম্পিউটার সায়েন্স—এসব শব্দ প্রবল আরাধ্যপূর্ণ, স্বপ্নজাগানিয়া; আমার নিজের না হলেও আব্বা ও মায়ের স্বপ্নে হররোজ ঘুরপাক খেত এসব শব্দ। ফলে তাঁদের স্বপ্ন, তাঁদের উচ্চাশা যেন চেপে বসেছিল আমার ওপর। কিন্তু কেন জানি না, আব্বা-মায়ের ওই উচ্চাশার বলয় থেকে নিজের অজান্তেই আস্তে আস্তে পিছলে যাচ্ছিলাম আমি।
কলেজ শেষে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় ‘ক ইউনিট’-এর অপেক্ষমাণ তালিকায় দাঁড়িয়ে আছি—ভাবছি, কোন বিষয়ে পড়ব, কোন বিষয় পাব; তখন ক ইউনিটের প্রায় সব বিষয় বণ্টন শেষ, বাকি আছে কেবল মনোবিজ্ঞান। তো, আমার ভাগ্যে জুটল সেই মনোবিজ্ঞান। স্বপ্ন ছিল বৈমানিক হওয়ার, পড়ছি মনোবিজ্ঞানে—কী যে এক অসহায়ত্ব বুকে। আমি মনোবিজ্ঞানে পড়ি—কথাটা কাউকে বললেই লোকজন বলত, ‘পাগলের ডাক্তার।’ বিষয়টা কিন্তু বেশ ভালোই লাগত আমার। যতটা না ‘পাগল’-এর জন্য, তার চেয়েও বেশি ‘ডাক্তার’ বলার কারণে! মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, আগামী বছর আবার ভর্তি পরীক্ষা দেব, এই বছর শুধু কোনো মতে ভর্তিটা হয়ে থাকি।
ঢাকাবাসের প্রথম দিকে উঠেছিলাম মেসে, সেখানে অনেক কিছুর সঙ্গে ছিল ‘পরাধীনতা’ও। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর হলের গণরুমের ‘স্বাধীনতা’র লোভে ফজলুল হক হলের ১০০১ নম্বর কক্ষে যাত্রা। সেখানে মধ্যরাত অবধি রাজনীতির মিছিল—এসবে মন থেকে না চাইলেও চিৎকার দিতেই হতো প্রায় চৌকির নিচে থাকা একটি সিটে একটু জায়গা পাওয়ার জন্য।
দিন চলে যাচ্ছিল দিনের নিয়মে। দ্বিতীয়বার আমার আর ভর্তি পরীক্ষা দেওয়া হলো না। ওদিকে ধীরে ধীরে মনোবিজ্ঞানের সঙ্গেও তৈরি হলো একধরনের দূরত্ব। এই দূরত্বের অনেক কারণ আছে—বিশ্ববিদ্যালয়ের ছকবাঁধা পড়াশোনা যেমন আমার ভালো লাগত না, তেমনি না-পছন্দ ছিল নোট ও ফটোকপিময় লেখাপড়া। অথচ আমার বেশির ভাগ বন্ধুবান্ধবের ঝোঁক সেদিকেই। তো, আমি কী করি?
বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ফটোকপিময় পড়াশোনার চেয়ে বাইরে গিয়ে এক পাতা সাদা কাগজ হয়ে করতে থাকলাম আড্ডাবাজি, শিখতে থাকলাম অনেক নতুন কিছু। নিঃসন্দেহে অনেক বেশি আনন্দময় ছিল সেই দিনগুলো। দিনের বেলা কাটত উজ্জ্বল সব স্বপ্ন নিয়ে, আর রাতে গণরুমের ছারপোকা ও আরশোলার সঙ্গে বসবাস। পরে অবশ্য সিঙ্গেল সিট পেয়েছি তৃতীয় বর্ষে উঠে। এত কিছুর মধ্যেও স্বপ্ন আমাকে ছাড়ে না—নিজের মতো করে, আনন্দ নিয়ে কিছু একটা করতে চাই। এর মধ্যে যুক্ত হয়েছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদের সঙ্গে। তত দিনে মনোবিজ্ঞানের সঙ্গে আমার মনের অদ্ভুত সম্পর্ক চলছে—এই প্রেম, এই বিচ্ছেদ। কিন্তু পোক্ত সম্পর্ক বলতে যা বোঝায়, তখন আমার সেটি চলচ্চিত্র সংসদের সঙ্গে। সেই সব দিন যেন সোনাঝরা! মনে পড়ছে, সংগঠনের টিএসসির রুমে সে সময় ত্রুফো, গদার, সত্যজিৎ রায়, আব্বাস কিয়ারোস্তামি কিংবা বা কিস্লোভ্স্কিদের সঙ্গে আমাদের বসবাস। আর আমরা ভাবছি, জগতে এর চেয়ে উত্তম, এর চেয়ে আনন্দময় কাজ আর কী হতে পারে! তখন আমার মনে বড় হয়ে উঠছে ছবি বানানোর বাসনা। এর মধ্যেই এল সুযোগ—যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বৃত্তি। উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান ও চলচ্চিত্রের ব্যবহারিক দিকের মিল-অমিল নিয়ে পড়ার পরিকল্পনা থাকলেও থিতু হলাম কমিউনিকেশনের কোর্সেই। সঙ্গে ছিল যুক্তরাষ্ট্রের চোখ দিয়ে দেখা বাধ্যতামূলক জগৎ বোঝাপড়া-বিষয়ক বিষয় রাষ্ট্রবিজ্ঞান।
এখানে লা-ক্রস ক্যাম্পাসে এসে মনোবিজ্ঞানের প্রতি প্রেম পুরোটাই ছুটে গেল আমার। আস্তে আস্তে গাঢ় থেকে গাঢ়তর সম্পর্ক হলো বিশ্বায়ন আর সিনেমার সঙ্গে। তবে শুধু কি সম্পর্ক গাঢ় হলেই চলবে? আমার মনে হলো, চলচ্চিত্রের কাজ বুঝতে হলে, জানতে হলে সরাসরি কাজ করতে হবে। শুরু করলাম চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ ভাইয়ের সঙ্গে কাজ। তাঁর সঙ্গে এক বছর নীরবে তীব্র সাহস আর অনুপ্রেরণা নিয়ে রানওয়ে ছবির কাজ করলাম। এ কাজ করতে করতেই অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার সুযোগ এল। এবার পূর্ণ বৃত্তি নিয়ে সিডনি ফিল্ম স্কুল ও মেলবোর্নে আরএমআইটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়লাম দুই বছর। ফিরে এসে আবারও পড়াশোনা, আবারও বিদেশে। এবার পড়াশোনা করতে চলে গেলাম দক্ষিণ কোরিয়ায়। চলচ্চিত্র বিষয়ে এবার মাস্টার্স করার পালা। পরিচালনায় মেজর করব।
পড়াশোনার অংশ হিসেবে প্রথম বছর স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রগুলো বানাতে বানাতেই এত দিনের স্বপ্নের শুয়োপোকা প্রজাপতি হয়ে উঠতে চাইল। আমিও এখন বানাতে পারি বড় দৈর্ঘেযর ছবি, চলে এল এই আত্মবিশ্বাস। অতঃপর শুরু হলো চেষ্টা। ২০১৩ সালে সে চেষ্টা পূর্ণতার আলোয় উদ্ভাসিত হলো ইমপ্রেসের ‘বুটিক ছবি’র কাজে সুযোগ পাওয়ার মধ্য দিয়ে।
যে গল্প বলার জন্য এত গল্পের আয়োজন, সেই জালালের গল্প-এর জন্ম এভাবেই। এর মধ্যে সেই বিশ্ববিদ্যালয়-জীবন থেকে শুরু করে জীবনের নানা বন্দরে আমাকে ভালোবাসা ও মায়া দিয়ে আগলে রাখা বন্ধু তন্বী হয়ে গেছে আমার বউ।
জালালের গল্প-এর শুটিং শুরু হবে। কিন্তু সূচনাপর্বেই বিপত্তি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে গোটা দেশ তখন উত্তাল, অস্থিতিশীল। লাগাতার হরতাল-অবরোধ। দেশজুড়ে চলছে পেট্রলবোমার তাণ্ডব। আজ এখানে বোমা হামলা তো কাল ওখানে। এ অবস্থায় আমাদের সামনে একটিই প্রশ্ন ছিল, কী করব? সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম, শুটিং করব। যেই কথা সেই কাজ, শুটিং শুরু হলো। হরতাল-অবরোধের মধ্যেই আমরা নেমে পড়লাম কাজে। একদিন রাতে শুটিংয়ে যাওয়ার সময় আমাদের গাড়িকে ধাক্কা দিল এক ট্রাক। অল্পের জন্য রক্ষা পেলাম আমি এবং আমার সাত সঙ্গী। আমার ছেলের বয়স তখনো ২১ দিন পূর্ণ হয়নি। এভাবে নানা মজার আর শিক্ষণীয় অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে ধীরে ধীরে নির্মাণ শেষ হলো আমার ছবি জালালের গল্প-এর। আমার ছেলের নামও ঠিক হয়েছে তত দিনে: শুদ্ধ শপথ গল্প! আমি আর তন্বী হয়ে গেলাম গল্পের মা ও বাবা। আমার ছবির নাম জালালের গল্প, ছেলের নামও গল্প। ছবি আর ছেলে—আমার কাছে দুটোই এখন সমার্থক।
আমার প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি মুক্তি পাওয়ার পর সন্তানের প্রথম মুখদর্শনের উচ্ছ্বাসের মতো জালালের গল্প নিজেই তাঁর পথ খুঁজে আমাকেও নিয়ে যাচ্ছে দেশ-দেশান্তরে। আর কী বলব—পতুর্গালের আভাঙ্কা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের পুরস্কার পেয়েছে ছবিটি। এর প্রধান অভিনেতা মোশাররফ করিমও পেয়েছেন সেরা অভিনেতার পুরস্কার। উৎসবে বিচারকমণ্ডলী যখন ছবিটির প্রশংসা করছিলেন, আমার বারবার মনে পড়ছিল দেশের কথা। ২০১৪ সালে ১৯ তম বুসান চলচ্চিত্র উৎসবের এশিয়ান সিনেমা ফান্ড পেয়েছে জালালের গল্প। দেশের বাইরে বিভিন্ন স্থানে প্রদর্শিত হয়েছে ছবিটি। সেখানে এটি নিয়ে যখন উচ্ছ্বসিত হয়েছেন দর্শকেরা; বুঝেছি, এ তো কেবল শুরু—যেতে হবে বহুদূর।
বাংলাদেশের দর্শকও পরম ভালোবাসায় ছবিটিকে গ্রহণ করেছেন। এই দর্শকদের ভালোবাসার কারণেই আরও নতুন গল্প বলার উৎসাহ পাই। নিজের ছেলের প্রতিটি নতুন কার্যকলাপ যেমন বিস্ময় নিয়ে দেখি, তেমনি দেখি আমাদের দেশে সিনেমার অবস্থাও। তবে সেই অবস্থার জন্য আমি যতটা না শঙ্কিত তার চেয়ে আনন্দিত অনেক বেশি। আমার বিশ্বাস, আমাদের নিজেদের বলা গল্প আস্তে আস্তে গ্রহণ করবেন দর্শক। এই ডিসেম্বরে আমার মাস্টার্স শেষ হবে। ফিরে আসব দেশে। কেননা, গল্পের সঙ্গে আত্মীয়তার সম্পর্ক বাঁধতে চাইলে খুব দ্রুত আবার নতুন কাজ শুরু করতে হবে। তার প্রস্তুতিই এখন চলছে। আর আস্তে আস্তে ‘গল্পের বাবা’ হওয়ার জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা করে চলেছি আমি!
আবু শাহেদ ইমন: চলচ্চিত্রকার