বাংলাদেশি যুবকের পাঁচ নক্ষত্রের আবিষ্কারক
- লিডারশিপ ডেস্ক
নাসায় কর্মরত বাংলাদেশি যুবক রুবাব খান। তিনি সূর্যের চেয়ে কয়েকশত গুণ বড় ৫টি নক্ষত্র আবিষ্কার করে সারা বিশ্ব তোলপাড় করে দেন। প্রায় সব মিডিয়ায় গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করা হয় এ রিপোর্ট। সঙ্গে উঠে আসে বাংলাদেশের নাম। তিনি বাংলাদেশে জন্মেছেন। তার পিতা নূরুর রহমান খান। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান। রুবাব খানের মা ফিকরিয়া বেগম। তিনি সেন্ট্রাল ওমেন্স ইউনিভার্সিটির দর্শনের অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর। সন্তানের কৃতিত্বে তারাও গর্বিত। রুবাব খান যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা গোডার্ড স্পেস ফ্লাইট সেন্টারের জিডব্লিউএসটি ফেলো। ন্যাশনাল এরোনটিক অ্যান্ড স্পেস এডমিনিস্ট্রেশন-এর ওয়েবসাইটে তার জীবনবৃত্তান্তে বলা হয়েছে, তিনি ২০১৪ সালে ওএসইউ ডিপার্টমেন্ট অব অ্যাস্ট্রনমি থেকে পিএইচডি অর্জন করেছেন। সেখানে তিনি কাজ করেছেন প্রফেসর ক্রিস্টোফ স্টানেক এবং ক্রিস্টোফার কোচানেকের অধীনে। ২০০৮ সালে অ্যাস্ট্রোফিজিক্সে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেন কলাম্বিয়া ইউনির্ভাসিটি থেকে। সেখানে তিনি গবেষণা করেছেন প্রফেসর সাবোলস মারকার সঙ্গে। রুবাব খান বলেছেন, তার প্রাথমিক গবেষণা বিশাল সব নক্ষত্রদের ওপর। তবে তিনি যে সুপার স্টারস আবিষ্কার করেন তার নাম দেয়া হয় ইটা টুইনস। এ নিয়ে ৭ই জানুয়ারি লন্ডনের ডেইলি মেইল একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়, দূরবর্তী ছায়াপথে এমন সুপার স্টার দৃশ্যমান হওয়া বিরল। এই ইটা টুইন থেকে গ্যাসের বিশাল বল নির্গত হচ্ছে। আমাদের পুরো সূর্য থেকে যে পরিমাণ ডাস্ট ও গ্যাস নির্গত হয় এর পরিমাণ তার দশগুণ। আমাদের সূর্যের চেয়ে ৫০ লাখ গুণ বেশি উজ্জ্বল ইটা কারিনেই। এর ফলে পৃথিবী থেকে ১০ হাজার আলোকবর্ষ দূরে এটিই সবচেয় উজ্জ্বল০ নক্ষত্র বলে মনে করা হয়। কিন্তু বিজ্ঞানীরা আমাদের ছায়াপথের বাইরের একটি ছায়াপথে একই রকম ৫টি বস্তু দেখতে পেয়েছেন। এর নাম দেয়া হয়েছে ইটা টুইনস। যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ডে নাসায় কর্মরত গবেষক ড. রুবাব খান বলেছেন, এই সুপার সাইজের নক্ষত্র জীবনের রাসায়নিক উপাদানের বণ্টন কি রকম তা জানতে সাহায্য করতে পারে। তিনি বলেন, প্রচণ্ড ভারি ও বড় নক্ষত্র সব সময়ই বিরল। তবে যে ছায়াপথে তারা রয়েছে সেখানে রাসায়নিক ও পদার্থবিদ্যার বিবর্তনে তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। এ নিয়ে জানুয়ারিতে মানবজমিনকে ইমেইলে একটি সাক্ষাৎকার দেন তিনি। তাতে তিনি বলেন, যে কোনো ক্ষেত্রে সফলতার জন্য চাই কঠোর পরিশ্রম। নাসায় অন্য অনেকের পাশে কাজ করার সুযোগ পেয়ে নিজেকে একজন বাংলাদেশি হিসেবে গর্বিত মনে করছি। রুবাব খান বলেন, বাংলাদেশে জন্ম নিয়েছেন তিনি। এ দেশকে কোনোদিন ভুলে থাকতে পারবেন না। বাংলাদেশের তরুণদের জন্য তিনি দিয়েছেন বেশ কিছু সুপারিশ। বলেছেন, লক্ষ্য স্থির করতে হবে জীবনের শুরুতে। সেভাবে নিজেকে প্রস্তুতও করতে হবে। চলার পথে হোঁচট খেলে চলা থামিয়ে দিতে নেই। রুবাব খান পরিবারের গ্রামের বাড়ি নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁওয়ের পাকুন্দা গ্রামে। তার পিতামাতা দুজনেই বলেছেন, রুবাবের পড়াশোনার জন্য কোনো কিছু আমরা তার ওপর চাপিয়ে দিইনি। আমাদের দুটি সন্তান। একটি মেয়ে। মেয়ে সুমাইয়া ফারাহ খান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে মাইক্রোবায়োলজির সহকারী প্রফেসর। দুটি সন্তানই বাংলা মিডিয়ামে পড়াশোনা করেছে। রুবাব খান মা-বাবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, তারা পাশে না থাকলে আমার এতদূর আসা সম্ভব হতো না। তিনি বলেন, প্রয়াত আবদুল্লাহ আল মুতি শরফুদ্দিন ও ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবালের লেখা আমাকে গভীরভাবে উদ্বুদ্ধ করেছে। ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবালের সায়েন্স ফিকশন, বিজ্ঞানীর গবেষণা জীবনের বর্ণনা এবং সার্বিক আদর্শ আমাকে মুগ্ধ করেছে। আধুনিক জ্যোতির্পদার্থবিদ্যার ওপর বিভিন্ন বাংলা সংবাদপত্রে ড. আবদুল্লাহ আল মুতির নিয়মিত লেখা আমাকে আকৃষ্ট করেছে। রুবাব খান বলেন, এখন বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা ও কাজের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে আসছেন। যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরা বিভাগগুলোতে এখন পিএইচডি করা শিক্ষার্থী রয়েছে। গুগল, ইন্টেল, আইবিএম, অ্যামাজন, ফেসবুকের মতো বড় প্রযুক্তিনির্ভর কোম্পানিগুলো ঘন ঘন বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের নিয়োগ করছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে এতসব সফল বাংলাদেশির চেয়ে আমি বেশি উচ্চকাঙ্ক্ষী ছিলাম না। আমি যে বিষয়টি বেছে নিয়েছি সেটা ক্যারিয়ার নির্ভর ছিল না। তিনি বলেন, আমি যখন পিএইচডি ডিগ্রি সম্পন্ন করছিলাম তখনই নাসায় ২ বছরের পোস্ট ডক্টরাল ফেলোশিপের জন্য আবেদন করি। ইন্টারন ও স্টাফ রিসার্চারস হিসেবে নাসা তরুণ, যুবকদের নিয়োগ করলেও যারা মার্কিন নাগরিক নয় তারা যদি নাসায় কাজ করতে চান তাহলে তাদের জন্য পোস্ট ডক্টরাল ফেলোশিপ হলো সম্ভাব্য একমাত্র পথ। তাই কোনো বাংলাদেশি যদি নাসায় কাজ করতে চান তাহলে তাকে সবার আগে পিএইচডি পর্যন্ত পড়াশোনা সম্পন্ন করতে হবে। জ্যোতির্পদার্থ বিজ্ঞান বা অ্যাস্ট্রোফিজিক্সে আমার কোনো ডিগ্রি ছিল না। অনেকেই পদার্থবিজ্ঞান, গণিত, জীববিজ্ঞান, বায়োলজিক্যাল সায়েন্স, এমনকি প্রকৌশলে যারা ডক্টরেট সম্পন্ন করছেন তাদের ঘন ঘন নাসা পোস্ট ডক্টরাল প্রোগ্রামে নিয়োগ করা হয়। বাংলাদেশি তরুণ বা যুবকদের জন্য আপনার পরামর্শ কি? তাদের কাছে আপনি একজন আইকন। এমন প্রশ্নের জবাবে রুবাব খান বলেন, তাদের উচিত ক্যারিয়ার গড়ার জন্য আত্মউৎসর্গ ও কঠোর পরিশ্রম। যে বিষয়টিকে একজন শিক্ষার্থী সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে বা পছন্দ করে সেই বিষয়ে যদি সে কাজ করার সুযোগ পায় তাহলে সেটা হবে সর্বোত্তম। হাইস্কুল বা কলেজ পড়ুয়াদের মধ্যে একটি ধারণা আছে যে, জীবনে সফল হতে হলে তাকে শীর্ষস্থানীয় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেই হবে। পড়তে হবে উচ্চ মানসম্পন্ন একটি সাবজেক্টে। কিন্তু প্রকৃত বাস্তবতা হলো, এই যে উচ্চ মানসম্পন্ন সাবজেক্টের কথা বলা হচ্ছে তা কিন্তু প্রতি ৪-৫ বছর পরপর পরিবর্তন হয় (কখনও কম্পিউটার সায়েন্স, কখনও এপ্লায়েড ফিজিক্স, কখনও ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং যুগের চাহিদা হয়ে ওঠে)। কঠোর পরিশ্রম না করে শুধু একটি শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়লে তাতে সফলতা আসবে সামান্যই। তাই সবকিছুর মূলে হলো কঠোর পরিশ্রম। এই একটি বিষয়ের ওপর সবই নির্ভর করে। বাংলাদেশি একজন শিক্ষার্থীর অ্যাস্ট্রোফিজিক্সে ক্যারিয়ার গড়ার জন্য বেশ কতগুলো পথ আছে। তা হলো- ১. এইচএসসি পরীক্ষার পর এসএটি এবং টোফেল সম্পন্ন করা উচিত। তারপর যুক্তরাষ্ট্রের কোন শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার মতো সামর্থ্য থাকতে হবে। এ দুটি জিনিস থাকলে আন্ডারগ্রাজুয়েটের জন্য আবেদন করতে হবে। ২. পদার্থবিজ্ঞান, এপ্লায়েড ফিজিক্স, গণিতে ব্যাচেলর ও মাস্টার্স ডিগ্রি সম্পন্ন করতে হবে বাংলাদেশে। দিতে হবে জেনারেল জিআরই, পদার্থবিজ্ঞানের ওপর জিআরই পরীক্ষা। এরপরই যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পদার্থ অথবা অ্যাস্ট্রোনমি পিএইচডি প্রোগ্রামে আবেদন করা যাবে। ৩. বাংলাদেশে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিদ্যা বা এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো বিষয়ে পিএইচডি সম্পন্ন করতে হবে। এটা করার সময় আন্তর্জাতিক যোগাযোগ থাকতে হবে। ভারতেও অনেক বিশ্ববিদ্যালয় আছে, যারা অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের ওপর ডিগ্রি ও গবেষণার সুযোগ দিয়ে থাকে। এটা একটা ভালো সুযোগ হতে পারে। বাংলাদেশের আগ্রহী শিক্ষার্থীদের জন্য আমার সাজেশন হলো, জীবনের প্রারম্ভেই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। সামনে যত সুযোগ আসবে তা হাতছাড়া না করে, তার সবটার সদ্ব্যবহার করতে হবে। সব ক্ষেত্রে সফলতা না এলেও তা করতে হবে। প্রচলিত নয় এমন পরিপ্রেক্ষিতের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় তাদের অবশ্যই তার ক্যারিয়ার পরিকল্পনা নিয়ে এগুতে হবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যদি কেউ যুক্তরাষ্ট্র, ভারত বা চীনে আন্ডারগ্রাজুয়েট প্রোগ্রাম সম্পন্ন করার জন্য আবেদন করার প্রস্তুতি নেন তাহলে তার উচিত হবে না বাংলাদেশের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেয়াকে অবহেলা করা। এভাবেই একটি স্তর থেকে আরেকটি স্তরে পৌঁছার চেষ্টা করতে হবে সব সময়। এটা করলেই তাদের জন্য পিতামাতার সমর্থন পাওয়া সহজ হবে। বাংলাদেশে বিজ্ঞানকে, বিশেষ করে অ্যাস্ট্রোনমিকে জনপ্রিয় করতে কি করা উচিত বলে আপনি মনে করেন? রুবাব খান বলেন, আমি মনে করি বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করতে মিডিয়া উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, অনেক টেলিভিশন চ্যানেল আছে এখন। তারা অন্য দেশের অনেক শো আমদানি করে। তারা সায়েন্স সংক্রান্ত প্রোগ্রাম আমদানি করে এ কাজটি আরো সহজ করতে পারে। তা করা হলে দর্শকদের মধ্যে বিজ্ঞানে সচেতনতা বাড়বে। রুবাব খান বলেন, আমরা যে বিশ্বে বাস করি সে সম্পর্কে জানতে আমি সব সময় খুব আনন্দ পাই। তাই যখনই আমি অ্যাস্ট্রোফিজিক্সে পড়ার সুযোগ পেয়েছি তা যেন আমার কাছে সোনায় সোহাগা হয়ে উঠেছে। এটা গুরুত্বপূর্ণ যে, প্রযুক্তি হলো বিজ্ঞানের প্রায়োগিক দিক। বিজ্ঞানের গবেষণা ব্যাখ্যা করতে প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করতে হয়। এই দুটি জিনিসকে আলাদা করা যাবে না।