স্মার্ট গ্রামের গল্প
- লিডারশিপ ডেস্ক
শহরের বাসিন্দাদের কাছে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ একধরনের দাবি হলেও, ভারতের গ্রামাঞ্চলের প্রায় ২০ কোটি সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কাছে বিদ্যুৎ একধরনের সুবিধা, কিন্তু অধিকার নয়। এমনটাই মনে করেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন পদার্থবিদ অশোক দাস। শহরগুলোকে ‘স্মার্ট সিটি’ হিসেবে গড়ে তোলার প্রকল্পে ইতিমধ্যেই ভারত সরকার ৯৮ হাজার কোটি রুপি বরাদ্দ দিয়েছে। অশোক দাস বলেন, ‘বড় শহরে গ্রাহকদের আচরণে পরিবর্তন আনাটা একটা বড় সমস্যা। স্মার্ট সিটি গড়ে তোলার জন্য পেরিয়ে যেতে পারে দশকের পর দশক। কিন্তু সেই সময়ের ভেতর আমি হাজার খানেক গ্রামকে স্মার্ট ভিলেজে রূপ দিতে পারব।’
যুক্তরাষ্ট্রের সেমিকন্ডাক্টর শিল্পে এক দশক কাটিয়ে ২০০৫ সালে দেশে ফিরে অশোক দাস হয়ে যান একজন পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি পরামর্শক। কিন্তু তিনি লক্ষ করেন, নবায়নযোগ্য শক্তির উৎপাদনের পেছনে যতটা মনোনিবেশ করা হয়েছে, তার চেয়ে অনেক কম গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি সরবরাহের পেছনে, যা বেশি দরকার।
উপহার যখন আলো
২০১০ সালে ভারতের বিহার প্রদেশে অশোক দাসের নিজের শহরের কাছেই এক গ্রামে গিয়ে তিনি দেখেন, সেখানে তখনো বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি। মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দেখে তিনি এদের জন্য কিছু করার বিষয়ে কঠোর সংকল্প নেন তখন। স্মৃতিচারণা করে তিনি বলেন, ‘আমি আমার ভাগনিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তোমার জন্য কী আনব? জবাবে সে আমায় বলেছিল, “মামা, আমার সব আছে, শুধু আমাকে আলো এনে দাও!’”
সেই থেকে আলো উপহার দেওয়ার কাজে হাত দেন অশোক। তিনি বলেন, ভারতের পরিবেশবান্ধব শক্তি উৎপাদকদের প্রবণতা আছে বিদ্যুৎ বিক্রি করেই দায়সারাভাবে দায়িত্ব সম্পন্ন করার। পর্যাপ্ত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অনেক ক্ষেত্রেই গোটা ব্যবস্থায় ধস নামে। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নেন ‘স্মার্ট গ্রিড টেকনোলজি’ নামের এমন এক প্রযুক্তি উদ্ভাবনের, যা গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের গোটা শক্তি উৎপাদনব্যবস্থাকেই দূর থেকে নিয়ন্ত্রণের সুবিধা দেবে।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে সানমকশা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে স্মার্ট ন্যানোগ্রিড প্রযুক্তি পরিচালিত ভারতের প্রথম স্মার্ট ভিলেজের মর্যাদা পায় ওডিশা প্রদেশের ছোটকি গ্রাম। এই প্রযুক্তিতে ব্যবহৃত হয় একটি ৩০ কিলোওয়াটের সৌরকোষ (সোলার প্যানেল); শক্তির ব্যবহার এবং সিস্টেমের অবস্থা কেমন সে তথ্য সংগ্রহের জন্য থাকে মিটার এবং সেন্সর।
দূর থেকে নিয়ন্ত্রণ
মিটার এবং সেন্সরের মাধ্যমে সংগৃহীত তথ্য চলে যায় প্রতিষ্ঠানটির ক্লাউডভিত্তিক পর্যবেক্ষণব্যবস্থায়। প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা তারপর যেকোনো জায়গায় বসে এই তথ্যগুলো পান এবং কাজে লাগাতে পারেন। এই সুবিধার ফলে অনেক দূরে থেকেও চাহিদা অনুযায়ী জোগানের বিষয়টি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়, এমনকি কৃষিকাজে সেচ এবং খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রয়োজনের সময় বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু বা বন্ধ করা যায়। তারহীন ওয়াই-ফাই হটস্পটের মাধ্যমে গ্রামবাসী পাচ্ছেন ইন্টারনেট ব্যবহারের সুবিধা। মুঠোফোনের ছোট একটি অ্যাপের মাধ্যমে খরচের হিসাব জানা, বিল পরিশোধ করা এবং সেবাসম্পর্কিত অভিযোগ জানানোর সুবিধা তাঁরা পাচ্ছেন। সামগ্রিক ব্যবস্থায় কোনো সমস্যা দেখা দিলে দূর থেকেই নির্দেশনা দিয়ে পূর্ব প্রশিক্ষিত গ্রামবাসীকে দিয়ে তাৎক্ষণিক সমাধান করানো যায়।
প্রকল্পের ব্যয় এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
ফিনল্যান্ডের প্রতিষ্ঠান ওয়ার্টসিলার সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচির এই স্মার্ট ভিলেজের গোটা প্রকল্প চালুর খরচ বহন করেছে। তারপর থেকে যত খরচ, তা মেটাচ্ছে ব্যবহারনির্ভর গ্রামের কমিটি। গত বছর এক বিবৃতিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এক হাজার দিনের ভেতর ভারতের প্রত্যেক গ্রামকে বিদ্যুতের আওতায় আনার ঘোষণা দিয়েছিলেন। গত মাসে প্রদত্ত ২০১৬ সালের স্মার্ট সিটিজ ইন্ডিয়া অ্যাওয়ার্ডের স্মার্ট ভিলেজ বিভাগে পুরস্কার জিতেছে সানমোকশা প্রতিষ্ঠানটি।
এই প্রকল্পের প্রধান বিবেচ্য বিষয় হলো শক্তি ব্যবস্থাপনা। অশোক দাস মনে করেন, এই প্রকল্পের মাধ্যমে গ্রামগুলোকে সত্যিকার অর্থেই চৌকস করে গড়ে তোলা সম্ভব হবে, পানির ব্যবহার কতটুকু হলো এবং কৃষিকাজে যে বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, সেগুলো পর্যবেক্ষণ করা যাবে। তবে এই গ্রামগুলো এতটাই প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত যে, সেখানে ইন্টারনেট সুবিধা পৌঁছে দেওয়ার জন্য কৃত্রিম উপগ্রহের সাহায্য নিতে হয়। কাজেই এটি খুব ব্যয়বহুলও বটে। কিন্তু এতে যে যোগাযোগব্যবস্থাটি ব্যবহৃত হয়েছে, তা ভবিষ্যতের ই-গভর্ন্যান্স, টেলিমেডিসিন এবং টেলিএডুকেশন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন পদার্থবিদ অশোক দাস।