গাজীপুরের আনিকার ডেনমার্ক জয়
- লিডারশিপ ডেস্ক
নাম তার শাহজিয়া শাহরিন আনিকা। ইতিমধ্যে বর্ষসেরা স্বর্ণকিশোরীর খেতাব পেয়েছে একটি বেসরকারি টেলিভিশন থেকে। আর ওখানেই থেমে থাকেনি স্বপ্নে বিভোর কিশোরী আনিকা। তার মেধা, চিন্তা, উপস্থিত বুদ্ধিমত্তাকে জানান দিতে ছুটে চলেছে দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। এরই মধ্যে সুযোগ আসে ডেনমার্কে বিশ্বের সবচেয়ে বড় নারী সম্মেলন-২০১৬-এ অংশ নেয়ার। আর সুযোগ হাতছাড়া করতে নারাজ গাজীপুরের এই কিশোরী। আর যেই কথা সেই কাজ। চলে গেল সেই সুদূর ডেনমার্কে। ডেনমার্কে অনুষ্ঠিত হয় উইমেন ডেলিভার কনফারেন্স-২০১৬ (ডড়সবহ ফবষরাবৎ পড়হভবত্বহপব-২০১৬)। যা ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত হয়েছে। গেল, দেখল, জয় করল ডেনমার্কের ওই সম্মেলন। সম্মেলনে বিশ্বের ১৬৯টি দেশ থেকে ছয় হাজারের অধিক মানুষের সমাগম হয়েছিল। এতে বাংলাদেশের একটি দল অংশ নেয়। আর সেই দলের নেতৃত্ব দেয় আনিকা।
স্বর্ণকিশোরী নেটওয়ার্কের আট সদস্যের একটি দল গিয়েছিল ডেনমার্কে নিজের দেশের প্রতিনিধিত্ব করতে। আনিকার সঙ্গে ছিল আরও তিন স্বর্ণকিশোরী। ২০১৪ সালের বর্ষসেরা ঢাকার মনামী মেহনাজ, রানার-আপ রাজশাহীর আতিয়া সানজিদা ঐশী এবং ২০১৫ সালের রানার-আপ বাগেরহাটের নওশীন শারমিলি। স্বর্ণকিশোরী নেটওয়ার্ক ফাউন্ডেশনের পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম, ইফতেখারুল চিশতী ও অপু মাহফুজকে নিয়ে ছিল বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল আইয়ের বিশেষজ্ঞ টিম। পুরো দলটির নেতৃত্ব দিয়েছেন নেটওয়ার্কের প্রধান নির্বাহী ফারজানা ব্রাউনিয়া। আর স্বর্ণকিশোরী দলের নেতৃত্ব দেয় আনিকা। আনিকা ২০১৫ সালে বাংলাদেশের বর্ষসেরা স্বর্ণকিশোরী ও গাজীপুর জেলার মধ্যে সেরা স্বর্ণকিশোরী। বর্ষসেরা হওয়ার পুরস্কারস্বরূপ এই ইউরোপ ট্যুর।
শাহজিয়া শাহরিন আনিকা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলে, ‘জীবনের প্রথম বিদেশ ভ্রমণ। তাও আবার ইউরোপ। উত্তেজনার পারদ যে কতখানি উঁচু ছিল তা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। কিছু ভয়, কিছু উত্তেজনা, কিছু আনন্দ সব মিলিয়ে মিশ্র এক অনুভূতি কাজ করছিল। প্লেন টেক অফের সময় প্রথমবার কেন জানি না একটু কষ্ট হলো। পরে বুঝতে পারলাম দেশের মাটি ছেড়ে, নিজের মাকে ছেড়ে দূরে চলে যাওয়ার অনুভূতি ছিল সেটা। পুরো ভ্রমণের মধ্যে টেক অফের সময়টুকুই সবচেয়ে আকর্ষণীয়। এরপর ঘণ্টার পর ঘণ্টা একই দৃশ্য। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে দেখা যায় ওপরে আকাশ, নিচে মেঘ। মনে হচ্ছিল মস্তবড় এক পাখির পেটের ভিতর বসে আছি। কোপেনহেগেন বিমানবন্দরে নামতেই বিশাল এক বিলবোর্ডে লেখা ছিল ‘হোয়েন দ্য ওয়ার্ল্ড ইনভেস্টস ইন গার্লস অ্যান্ড উইমেন এভরিডেস উইনস’। উইমেন ডেলিভার কনফারেন্স-২০১৬-এর প্রতিপাদ্য এটি। পুরো শহর যেন নারীদের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই সম্মেলনের আয়োজন করতে মুখিয়ে আছে। কনকনে ঠাণ্ডা বাতাসের মধ্য দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মনে হচ্ছিল এই তাহলে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী দেশ। কথা হয়েছে নোবেলজয়ী ভারতের কৈলাস সত্যার্থীর সঙ্গে। তিনি বলছিলেন, সারা বিশ্ব তোমাদের থেকে শিখতে পারে।’ খুবই অবাক হয়েছি যখন আমাদের কার্যক্রমের বিবরণ শুনে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা প্রায় সব দর্শনার্থী এই একই কথা বলেছেন।
কিশোরী আনিকা ছোটবেলা থেকেই উপস্থিত বক্তৃতা, বিতর্ক, প্রকৃতি, পরিবেশ ও মানবিক উদ্যোগে ছিল সদা সরব। ২০১৫ সালে একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে মাতৃস্বাস্থ্য, কিশোরী স্বাস্থ্য ও বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ ক্যাম্পেইনভিত্তিক প্রোগ্রাম স্বর্ণকিশোরীর জেলা পর্যায়ের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে। নিজ দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও কর্মতত্পরতা দিয়ে অর্জন করে বর্ষসেরা স্বর্ণকিশোরীর খেতাব। দেশের ৬৪ জেলা থেকে আগত জেলা সেরা ৬৪ স্বর্ণকিশোরীর মধ্যে প্রথম স্থান অর্জন করে নেয় আনিকা। পুরস্কার হিসেবে পায় মেডেল, শিক্ষাবৃত্তি ও বিদেশ সফর। গত বছরের ২৩ নভেম্বর চূড়ান্ত পর্ব অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনে। ওই অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক তাকে মেডেল পরিয়ে দেন। আনিকার মা সংগঠক ও শিক্ষক মাহবুবা সুলতানা। তিনি গাজীপুরের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পরিবেশবাদী ও সেবামূলক বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। তিনি বলেন, ‘আমি চেয়েছি মেয়েকে সামাজিক সচেতনতা ও মানবিক বোধ শিক্ষা দিতে। সব বাবা-মায়ের চাওয়া তার সন্তান যেন মানুষের মতো মানুষ হয়। আর আমি চেয়েছি আমার সন্তান শুধু মানুষ নয়, হবে দেশের সম্পদ। নিজের যোগ্যতাবলে নিজের অবস্থান তৈরি করবে এই সমাজের, এই দেশের কোথাও না কোথাও। চিন্তা-চেতনায় সৎ থেকে দাঁড়াবে মানুষের পাশে। একজন মা হয়ে এই স্বপ্নগুলো লালন করি প্রতিনিয়ত। প্রায় প্রতিটি ক্লাসে সরকারি-বেসরকারি বৃত্তি নিয়ে ছোটবেলা থেকেই সে তার মেধার পরিচয় দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। এ বছর মাধ্যমিক পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে রেখেছে কৃতিত্বের স্বাক্ষর। জাতীয় দিবসগুলোয় বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ, জেলা শিশু দিবসে জেলা প্রশাসন আয়োজিত অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করা, আরও নানান কার্যক্রমে নিজেকে নিজের মধ্যেই প্রতিযোগী করে তৈরি করছিল। আমার সেই ছোট্ট মেয়েটি আজ কিশোরী। নির্বাচিত হয়েছে জাতীয় পর্যায়ে স্বর্ণকিশোরী হিসেবে। অংশগ্রহণ করেছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় নারী সম্মেলনে।’
আনিকা আরও জানায়, সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো ১৬৯টি দেশ থেকে আসা প্রতিনিধি দলের মধ্যে বাংলাদেশের দলটিই সবচেয়ে বড়। সরকারি-বেসরকারি সংস্থা ও স্বর্ণকিশোরী মিলে অর্ধশতাধিক। এ দলে যাদের দেখে আমরা আরও বেশি অনুপ্রাণিত হয়েছি তারা হলেন অর্থ প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান এমপি, অধ্যাপক ডা. হাবিবে মিল্লাত এমপি, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম। সেখানে পতাকা নিয়ে এতজন বাঙালিকে একসঙ্গে দেখে মনে হচ্ছিল এক টুকরো বাংলাদেশ যেন জায়গা করে নিয়েছে ডেনমার্কের বুকে। সেদিন ৬ হাজার মানুষের ১২ হাজার চোখ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল একদল স্বপ্নবাজ মানুষের দিকে। যাদের স্বপ্ন বাংলার প্রতিটি মেয়ের নিরাপদ মাতৃত্ব এবং সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা। একদিন শুধু ডেনমার্ক নয়, গোটা বিশ্ব তাকিয়ে থাকবে সুস্বাস্থ্যে বলিষ্ঠ বাংলাদেশের দিকে এ আকাঙ্ক্ষাই এখন আমাদের চিন্তা-চেতনায়। যখনই সময় পেয়েছি, ঘুরে দেখেছি উইমেন ডেলিভারের প্রতিটি স্টল। নারীর ক্ষমতায়ন, নারীর অধিকার, নিরাপদ মাতৃত্ব, কিশোরীর স্বাস্থ্য, শিক্ষা এসব নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠন এসেছিল তাদের দৃষ্টিভঙ্গি সবার সামনে তুলে ধরতে। মূল উদ্দেশ্য নিরাপদ মাতৃত্ব। বোধ করি এ কারণেই এ কনফারেন্সের নাম উইমেন ডেলিভার।’
আনিকার মা আরও বলেন, ‘খুবই সাধারণ একজন মা আমি। আর আমার একমাত্র সন্তান আমার মেয়ে কতই না অসাধারণ। এই এক জীবনে এই পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী একজন মা আমি। রত্ন আছে আমার ছোট্ট ঘরে। তাই আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। এই জীবনে কত চড়াই-উতরাই, কত সুখ-দুঃখ, কষ্ট, হাসি-কান্না। কত কত পরিচয়, বন্ধুত্ব, শুভাকাঙ্ক্ষী। অথচ কেউ এই একজনের চেয়ে প্রিয় নয়। স্নেহ-মায়া-মমতা আর দায়িত্ববোধ নিয়ে অবিচ্ছেদ্য এক সম্পর্ক আমার আর আমার মেয়ের মধ্যে।’
আনিকা বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলে, ‘অনেক অভিজ্ঞতা, আনন্দ, জ্ঞান, দায়িত্ব, কর্তব্য এবং স্মৃতি নিয়ে ফিরে এলাম প্রিয় দেশে। যা কিছু অর্জন করেছি, ছড়িয়ে দেব ভবিষ্যৎ মায়েদের মাঝে। আমরা ইয়ুথ লিডাররা নেতৃত্ব দেব জাতিকে মাতৃমৃত্যুমুক্ত করার মহাসংগ্রামে।’
গাজীপুরের জয়দেবপুর সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হাবিবুর রহমান বলেন, ‘আনিকা লেখাপড়ার পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে এবং বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়ে আমাদের জন্য, বিদ্যালয়ের জন্য সম্মান বয়ে এনেছে। তাই তাকে নিয়ে আমরা গর্ববোধ করি।’