নারী উদ্যোক্তাদের নিয়ে কাজ করছেন সেলিমা আহমেদ
- লিডারশিপ ডেস্ক
সেই ২৫ বছর বয়স থেকে শুরু। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই-এ যোগ দেওয়া কনিষ্ঠ সদস্যদের মধ্যে অন্যতম নারী সেলিমা আহমেদের শুরুটা তখন থেকেই। এরপর অনেক সময় গড়িয়ে গেছে। একে একে বাংলাদেশের নারীদের নিয়ে এগিয়ে গেছেন এই নারী সর্বত্র। বাংলাদেশ সরকারকে উৎসাহিত করেছেন নারীদের আলাদা চেম্বার অব কমার্স তৈরির জন্য। অর্জন করেছেন নানা সম্মাননা। ব্যবসায়িক জীবন আর ব্যক্তিগত জীবনের পরতে পরতে সাফল্যের সোনালি ছোঁয়া। পরিশ্রম করতে শিখেছেন, প্রমাণ করেছেন চেষ্টা থাকলে কোনো সাফল্যই আসলে অধরা থাকে না। দেশীয় নারীদের জন্য অসামান্য অনুপ্রেরণীয় এই মানুষটি জানিয়েছেন তার জীবনের নানা ঘটনা।
ছবি আঁকার শখটা ছিল খুব ছোটবেলা থেকেই। শুধু কী ছবি? ইচ্ছে ছিল ক্যামেরা হাতে দেশে-বিদেশে ছুটে বেড়ানোর। সাংবাদিক হয়ে পুরো বিশ্বকে চমকে দেওয়ার। কিংবা ব্যাংকার! কিন্তু আরও অনেকের মতো খুব ছোটবেলায় বেশিকিছু বুঝে ওঠার আগেই নিজের স্বপ্নের আকাশের পুরো ছবিটাই পাল্টে যায় এই ছোট্ট মেয়েটির। চারুকলা? উহু! বিয়ের পর সেসব ভাবনা চলে গিয়ে সদ্য ইন্টারমিডিয়েট পাস করা মেয়েটির মাথায় ভর করে বসে ক্যারিয়ারের ভাবনা। সাংবাদিকতা নয়, ধীরে ধীরে সে জায়গাটি পুরোপুরি দখল করে বসে নতুন স্বপ্ন। নিজেকে প্রমাণ করার স্বপ্ন। তিনি নিটল-নিলয় গ্রুপের বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান ও পরিচালক মিসেস সেলিমা আহমেদের কথা।
‘ছোটবেলা থেকেই খুব চাইতাম আমার একটা আলাদা পরিচয় হবে। আমাকে সবাই চিনবে। মনে আছে, বাবার কাছ থেকে কখনো আলাদা করে নিজের জন্য খরচ নিতাম না। শ্বশুরবাড়িতে এসে স্বামীর কাছ থেকে কখনো কিছু নিইনি।’
নিজের অতীতকে মনে করতে গিয়ে স্বপ্নালু গলায় বলে ওঠেন। বাংলাদেশের কর্পোরেট নারী ও নারী উদ্যোক্তাদের কাছে প্রচণ্ড জনপ্রিয় দেশ-বিদেশে অসংখ্য অ্যাওয়ার্ড এবং সম্মান জয়ী সেলিমা আহমেদ। জীবনের শুরু থেকেই ক্যারিয়ার সচেতন ছিলেন। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ম্যানেজমেন্টে বিবিএ আর এমবিএ শেষ করে ছুটে বেড়ান পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। আমেরিকার স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে জাপান, মালয়েশিয়া, আয়ারল্যান্ড, কানাডা— যেখানেই যখন জ্ঞান আহরণের সুযোগ পেয়েছেন ছুটে গিয়েছেন সেলিমা।
‘মানুষ অনেক সময় কিছু পারে না। আবার শিখতে চায় না। কিন্তু আমি মনে করি সবারই আগে শেখা উচিত। এখন সবাইই বলতে চায় যে আমি জানি। তবে আমি পছন্দ করি জানি না বলতে। কারণ জানি না বললেই জানতে পারার ব্যাপারটা আসবে। শিখতে পারবে সবাই।’ নতুন কিছু জানার প্রতি নিজের আগ্রহকে প্রকাশ করতে গিয়ে বলে ওঠেন সেলিমা আহমেদ।
আর এ কারণেই বই পড়তে খুব বেশি ভালোবাসেন এই নারী। জানতে ভালোবাসেন। শুধু বই-ই নয়, নিজের অবসর সময় গান শুনতে, টিভি দেখতে আর চলচ্চিত্র দেখতে পছন্দ করেন তিনি। গানের প্রতি ভালোবাসার কথা বলতে গিয়ে নিজের পরিবারের কথা মনে করেন সেলিমা আহমেদ। ‘পরিবার থেকেই গানের প্রতি খুব আগ্রহ দেখানো হতো। আর তাই শেখা হয়েছিল গানকে বেশ আগ্রহ নিয়ে। এরপর শ্বশুরবাড়িতে এসে দেখি এখানে গানকে নিয়ে আরও বেশি উন্মাদনা। আমি সত্যি গান গাইতে খুব ভালোবাসি।’
খুব পছন্দের গান কোনগুলো? জানতে চাইলে মেলোডিয়াস আর রোমান্টিক ঘরানার গানের প্রতি নিজের মুগ্ধতা প্রকাশ করেন। এ ছাড়া চলচ্চিত্র আর বইয়ের ক্ষেত্রে একটু ঘরোয়া, ভালোবাসার কিংবা কমেডি মুভি বেশি পছন্দ তার।
রান্না-বান্না করতে প্রচণ্ড ভালোবাসেন তিনি। ইচ্ছে হলেই পরিবারের জন্য রান্না করতে বসে যান তিনি। ‘মন খারাপ থাকলেই রান্না করি আমি। আসলে রান্না করলে মনটা অন্যদিকে চলে যায়। এর বাইরে অবশ্য মন খারাপ হলে ঘুমিয়েও পড়ি। কারণ জানি, আজকে মন খারাপ নিয়ে ঘুমোতে গেলে কাল মন ঠিকই ভালো হয়ে যাবে আমার।’ বলতে গিয়ে হাসেন সেলিমা আহমেদ।
এমনিতে পোশাকের বেলায় যখন যেটা মানানসই সেটাই গায়ে জড়ান। এমনিতে শাড়িতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন তিনি। ভালোবাসেন মানুষের ভিড়কে। দেশের বাইরে গেলে এখানকার মানুষের ভিড়কেই বেশি মিস করেন।
তবে বাইরে হোক কিংবা দেশে, সানগ্লাস, সুগন্ধি আর ঘড়ি ছাড়া চলেই না তার। ঘড়ি নিয়ে আগ্রহ রয়েছে।
তবে এতকিছু করতে ভালো লাগলেও বাস্তবে অবসর সময় একদমই পান না আন্তর্জাতিক মহলে ব্যবসায়ী হিসেবে খ্যাতিপ্রাপ্ত এই নারী। পরিবারকে নিজের সময়ের অর্ধেকটা দিতে চাইলেও সেটা করার সুযোগ মেলে না তার। মানুষকে সব সময়ই সাহায্য করতে চেয়েছেন তিনি। সব সময়ই থাকতে চেয়েছেন মানুষের পাশে। সব ধরনের মানুষ বিশেষত নারীদের কল্যাণে নিজের অবস্থান থেকে কাজ করে যাচ্ছেন অনর্গল। তাঁর হাতে তৈরি হয় আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিপ্রাপ্ত বাংলাদেশের অন্যতম প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি। নারীদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে উঠে আসে নারী উদ্যোক্তাদের কথা। কাজ শুরু হয় নারী উদ্যোক্তাদের নিয়ে।
‘বর্তমানে আমার অধীনে প্রায় ৩,০০০ সদস্য নারী উদ্যোক্তাসহ অলিখিত প্রায় ১০,০০০ নারী উদ্যোক্তা আছেন। কিছুদিন পরই আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে প্রায় ৯,০০০ নারী উদ্যোক্তাকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার।’
শুধু তাই নয়, কিছুদিনের ভেতরে গাজীপুরে সেলিমা আহমেদের নেতৃত্বে তৈরি হচ্ছে নারী উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ ও তাদের মানগত উন্নয়ন করার জন্য একটি বিশাল হোস্টেল অ্যাকাডেমি। বলতে গেলে এক কথায় বাংলাদেশের নারীদের এগিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে তাদের পুরো বাংলাদেশের উন্নয়নের বিশাল কাজকে নিজের কাঁধে অনেকটাই তুলে নিয়েছেন সেলিমা আহমেদ। তবে কেবল তিনি একা কাজ করলে কোনো পরিবর্তন আসবে না বলে মনে করেন ব্যবসায় নোবেল পুরস্কার অসলো পুরস্কারপ্রাপ্ত এই নারী।
‘কেবল একজন কোনো কাজ করে কখনো ভালো কিছু করতে পারেনি, পারবে না। আর তাই আমাদের সবার উচিত নিজ নিজ জায়গা থেকে টাকা দিয়ে না হোক, দরকার পড়লে কয়িক পরিশ্রম করে হলেও দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য কিছু না কিছু করা।’ বিশেষ করে তরুণদের জন্য একবুক আশা নিয়ে উদ্দীপনা ভরা কণ্ঠে উচ্চারণ করেন সেলিমা আহমেদ।