বিলুপ্ত প্রাণের সন্ধানে একজন শাহরিয়ার
- লিডারশিপ ডেস্ক
জীববিজ্ঞান নিয়ে মার্কিন মুল্লুকে পড়তে গিয়েছিলেন শাহরিয়ার সিজার রহমান। পড়তে পড়তে মাথায় ঢুকে গেল বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের চিন্তা। ফিরে এলেন দেশে। নেমে পড়লেন বিলুপ্ত প্রাণীর সন্ধানে।
তারুণ্যে যখন জীবনের পথ ঠিক করার সময় এলো তখন চিন্তা করছিলাম কী করব। দেখলাম, বন্য জগৎ তো আমাকে সবচেয়ে বেশি টানে। সে পথে পা বাড়াতে দোষ কী। বিদেশে পড়ার সময়েই স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে বণ্যপ্রাণী সংরক্ষণের বিভিন্ন কাজ করতে করতে ঠিক করে ফেললাম জীবনের চলার পথ।
ঢাউস এক বাক্স নিয়ে গেলাম শ্রীমঙ্গলের স্থানীয় পশু হাসপাতালে। ঢাকনা খুলতেই পশু চিকিৎসকের চক্ষু চড়কগাছ। তার ভেতরে আছে ইয়া মোটা এক অজগর। উদ্দেশ্য কয়েক দিন আগে অজগরটার শরীরে স্থাপন করা ট্রান্সমিটারটি ঠিক কী অবস্থায় আছে তা এক্স রে করে দেখা। কিন্তু চিকিৎসক বেঁকে বসেছেন। বললেন, ‘আমরা গরু-ছাগলের চিকিৎসা করি। এর কোনো চিকিৎসা জানা নেই।’ বলছিলেন শাহরিয়ার সিজার রহমান। বিলুপ্ত প্রাণীর সন্ধানে ছুটতে গিয়ে এমন অনেক অভিজ্ঞতাই হয়েছে তার।
অ-তে অজগর
২০১০ সালে লাউয়াছড়ার বনে সম্পূর্ণ নিজের প্রচেষ্টায় অজগর নিয়ে কাজ শুরু করেন সিজার। তখনও অবশ্য এ বিষয়ে অভিজ্ঞতা তার শূন্য। কিন্তু অদম্য ইচ্ছার জোরে থেমে না থেকে কাজ এগিয়ে গেল জোর কদমে। একটি এনজিওর অর্থিক সহায়তায় অজগরের দেহে রেডিও ট্রান্সমিটার স্থাপন করে তাদের জীবনচক্র জানার চেষ্টা শুরু হলো। এ গবেষণা থেকে বেরিয়ে এলো অভিনব সব তথ্য। সিজার দেখলেন অজগর গহিন বনে না থেকে মানুষের বসতভিটার একেবারে কাছাকাছি লুকিয়ে থাকছে। এর কারণ দুটি। বনে খাদ্য সংকট। আরেকটি কারণ হলো বন উজাড় করে মানুষের বাসস্থান অজগরের বাসভূমিকে গ্রাস করছে। ফলে তারা মানুষের কাছাকাছি থেকে তাদের পোষা বিভিন্ন পশু-পাখি শিকার করছে। এ ছাড়া লাউয়াছড়ায় অন্যান্য প্রজাতির সাপ ও প্রাণীর ওপরও সমীক্ষা চালানো হয়। সেখানে পাকা রাস্তা হওয়ায় সড়ক দুর্ঘটনায় কী পরিমাণ বন্যপ্রাণী মারা যাচ্ছে তার ওপরও কাজ করছেন সিজার ও তার দল।
পার্বত্য চট্টগ্রামের রত্নভাণ্ডার
পার্বত্য চট্টগ্রামে কাজ শুরু হয়েছিল ঘোরাঘুরির ফাঁকে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সৌন্দর্য টানত শাহরিয়ার সিজার রহমানকে। মাঝে মধ্যেই যেতেন সেখানে। চিন্তা করলেন গবেষণার পরিধি এ এলাকায় বিস্তৃত করলে কেমন হয়। এর মধ্যে তার সঙ্গে যোগ দিলেন আরও কিছু সমমনা বন্যপ্রাণী গবেষক। যার যার কাজগুলো ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন অ্যালায়েন্স বা সিসিএ নামে এক প্লাটফরমে আনার চেষ্টা করলেন তারা। প্রথমে কচ্ছপ নিয়ে গবেষণা শুরু হলো। যার ফলে প্রথমবারের মতো দেশের মাটিতে আরাকান ফরেস্ট টার্টেল নামে অতি বিরল প্রজাতির এক কচ্ছপের সন্ধান পেলেন তারা। এ এলাকায় কাজ করতে করতে ক্রমে তাদের সামনে উন্মোচিত হতে লাগল প্রাণীবৈচিত্র্যের এক নতুন দ্বার।
সিজার বলেন,’আসলে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশাল এলাকায় এখনও কিছু জায়গা আছে যা সত্যিই দুর্গম। শহর থেকে লটবহর নিয়ে গিয়ে সেখানে গবেষণা কাজ চালানো সহজ না। তাই চিন্তা করলাম স্থানীয় আদিবাসীদের দিয়ে সংরক্ষণের কাজ করতে হবে। তাও সহজ ছিল না। প্রথমে তাদের বিশ্বাস করাতে হয়েছে যে আমরা কোনো ক্ষতি করতে আসিনি বরং এতে তাদের লাভ হবে। এ ছাড়া এসব বন্যপ্রাণী তারা শিকার করে খেত। শিকারি থেকে তাদের আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি সংরক্ষক বানাতে। আমার এমন বহু অভিজ্ঞতা হয়েছে যে, কোনো পাড়ায় গিয়ে কথা বলছি এমন সময় কেউ হয়তো বলল অমুক প্রাণী তো কয়েকদিন আগেই শিকার করেছি বা একে কয়েকদিন আগে বনে দেখেছি। তারা এসব প্রাণীর হাড়গোড় বা চামড়া দেখাতে লাগল। প্রথমে আমরা তাদের কিছু ক্যামেরা দিলাম। বলা হলো এরকম কোনো পশু-পাখি দেখলেই তারা যাতে ছবি তুলে রাখে। তার ফল এলো অভূতপূর্ব। কয়েক মাস পরে দেখলাম, তারা যেসব প্রাণীর কথা বলছে তার বেশির ভাগই দেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এরপর আমরা এসব আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে সংরক্ষণের বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে আরও ক্যামেরা এবং যন্ত্রপাতি দিলাম।’
তারা আছে আমাদের বনেই
স্থানীয় মানুষকে সম্পৃক্ত করে শাহরিয়ার সিজার রহমানদের ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন অ্যালায়েন্সের গবেষণা পদ্ধতি দিতে লাগল অভূতপূর্ব ফল। বলা হচ্ছে গাউর বা ভারতীয় বনগরু বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কিন্তু সিসিএর সহায়তায় স্থানীয় আদিবাসী জীববিজ্ঞানীদের বসানো ক্যামেরা ট্র্যাপে ধরা পড়েছে গাউরের ছবি। তার মানে এ প্রজাতি এখনও এ ভূখণ্ডে আছে। শুধু কি গাউর? সান বিয়ার বা সূর্য ভাল্লুক নামে ভাল্লুকের একটি প্রজাতিকেও খুঁজে পেলেন তারা। এছাড়া মেঘলা চিতা বা ক্লাউডেড লেপার্ড, চিতা বিড়াল, মর্মর বিড়াল বা মার্বেলড ক্যাটসহ বিপন্ন অনেক প্রাণীর অস্তিত্বের প্রমাণ দিচ্ছে সিসিএর ক্যামেরা। সাম্বার হরিণ, বন্য কুকুর বা ঢোল, বন ছাগলের ছবিও উঠে এসেছে এতে।
বাঘ আছে বাঘ নেই
সিসিএর কর্মীরা পার্বত্য চট্টগ্রামে খুঁজে পেয়েছেন বাঘের পায়ের ছাপও। ধারণা করা হচ্ছে সুন্দরবনের বাইরে বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রামেও রয়েল বেঙ্গল টাইগারের উপস্থিতি আছে। এ ব্যাপারে বিস্তারিত অনুসন্ধান চলছে। যে বাঘের ছাপটি পাওয়া গেছে তা প্রায় ১৩ সেন্টিমিটার। দেশের অন্যান্য বন্য প্রাণীবিদরা পার্বত্য চট্টগ্রামে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের উপস্থিতির সম্ভাবনার কথা এর আগেই জানিয়েছেন।
এখনও আছে আশা…
নির্বিচারে বন ধ্বংস, শিকারসহ নানা কারণে বাংলাদেশের অনেক বন্যপ্রাণী বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে চলে গেলেও শাহরিয়ার সিজার রহমান বলেন, ‘এত কিছুর পরও কিন্তু সব প্রজাতি হারিয়ে যায়নি। ৯০ ভাগ হয়তো শেষ হয়ে গেছে; ১০ ভাগ আছে। যদি বনকে আমরা আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনতে পারি তাহলে বন্যপ্রাণীরা আবার ফিরে আসবে। বাসস্থান ঠিক থাকলে তার বাসিন্দারা সেখানে থাকতে বাধ্য। আমাদের সামনে তো দৃষ্টান্ত আছে। আমরা যেসব এলাকায় কাজ করেছি সেখানকার আদিবাসী মানুষ যেমন ম্রো, ত্রিপুরা তারা বেশির ভাগই শিকারি। কিন্তু শিকার বন্ধ করে তারা অনেকেই এখন সংরক্ষণের কাজ করছে আমাদের সঙ্গে। আমরা তাদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছি বন্যপ্রাণী বেঁচে থাকলে তাদেরই লাভ। আসলে এই মুহূর্তে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে যে প্রথাগত পদ্ধতিতে সরকারিভাবে আগানো হচ্ছে তা কাজে দিচ্ছে না। সংরক্ষণের প্রচেষ্টা তখনই সফল হবে যখন স্থানীয় মানুষকে এর সঙ্গে সম্পৃক্ত করা যাবে। কারণ তারাই বনের সবচেয়ে কাছে থাকেন। সময় এসেছে তাদের দিকে নজর ফেরাবার। আবারও বলছি, সব আশা ফুরিয়ে যায়নি। সত্যিকারভাবে কাজ করলে হারিয়ে যাওয়া প্রাণী আবার ফিরে আসবে আমাদের বনে।’